মোতালেব জামালী : গাজা উপত্যকায় হামাসের বিরুদ্ধে স্থল অভিযান চালানোর জন্য গাজা সীমান্তে জড়ো করা হয়েছে কয়েক লাখ রিজার্ভ সৈন্য। হামাসের রকেট হামলা থেকে বাঁচাতে দক্ষিন ইসরাইলে গাজার সীমান্তবর্তী এলাকাসহ বিভিন্ন শহর ও ইহুদি বসতি থেকে সরিয়ে নেয়া হয় হাজার হাজার লোক। হামাসের রকেট হামলার কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ ইসরায়েলের সব ধরণের কর্মকান্ড। বাতিল করা হয়েছে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর শত শত ফ্লাইট। বন্ধ করে দিতে হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সব অবকাঠামো। মোটকথা হামাসের হামলা ও পরে গাজায় সামরিক অভিযানের কারণে ইসরাইলের অর্থনীতি বড় ধরণের ক্ষতির মুখে পড়েছে। হামসের সাথে যুদ্ধ ইসরাইলের অর্থনীতিকে কিভাবে পঙ্গু করে দিচ্ছে তা নিয়ে থাকছে আজকের প্রতিবেদন।
হামাসের সাথে ইসরাইলের চলমান যুদ্ধ এখন গড়িয়েছে চতুর্থ সপ্তাহে । যুদ্ধের জন্য প্রতিদিন ইসরাইলের ব্যয় হচ্ছে স্থানীয় মুদ্রায় ১শ কোটি শেকেল বা ২৪ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার। সম্প্রতি দেশটির একটি রেডিও চ্যানেলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এ তথ্য জানিয়েছেন ইসরাইলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ।
গত মাসে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু অনেকটা গর্ব করে বলেছিলেন , মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মুসলিম দেশের কাছে ইসরাইলের গ্রহনযোগ্যতা বাড়তে থাকায় শান্তি ও সমৃদ্ধির নতুন এক মধ্যপ্রাচ্যের উদ্ভব ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু গত ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের আকস্মিক হামলার পর হঠাৎ করেই বদলে যায় দৃশ্যপট। নেতানিয়াহুর নতুন মধ্যপ্রাচ্য গড়ার স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটে।
গাজা উপত্যকায় স্থল অভিযানের জন্য তলব করা হয়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার রিজার্ভ সৈন্য। এসব রিজার্ভ সেনা বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরিরত ছিলেন। তারা যুদ্ধের ময়দানে চলে যাওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠানে কাজের ব্যাঘাত ঘটছে। অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, রেষ্টুরেন্ট ও ষ্টোরে এখন লোকবল সংকটে বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। দেশটিতে এখন নেই কোন পর্যটক। অথচ পর্যটন খাত থেকে ইসরাইলের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো মোটা অঙ্কের অর্থ আয় করে।
হামাসের রকেট হামলার কারণে ইসরাইলের প্রধান গ্যাসক্ষেত্রটি বন্ধ করে দিতে হয়েছে। শ্রমিকের অভাবে কৃষি খামারগুলো পড়ে আছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। এছাড়া হামাসের রকেট হামলা থেকে বাচাতে ২ লাখ ৫০ হাজার বাসিন্দাকে তাদের বাড়ীঘর থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে বলে মিডিয়াকে জানিয়েছে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী বা আইডিএফ।
দক্ষিন ইসরাইলে ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় ১ হাজার ৪০০ লোক নিহত হয়েছে। ২শ ৪০ জনের বেশি লোককে ধরে গাজায় নিয়ে জিম্মি করেছে হামাস। এরপর সেদিন থেকেই গাজায় সর্বাত্মক বিমান হামলা শুরু করে ইসরাইল। এতে হজিার হাজার আবাসিক ভবন মাটির সাথে মিশে গিয়ে পুরো গাজা উপত্যকা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। নিহত হয়েছে ৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি। যাদের ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু বলে জানিয়েছে গাজার হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়। গাজার সাথে ইসরাইলের ক্ষয়ক্ষতির তুলনা চলে না। তবে ইসরাইলের নাগরিকরাও ভয় , আতংক এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে।
২০১৪ সালেও হামাসের সাথে প্রায় দুই মাসের যুদ্ধে ইসরাইলের অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে তা কাটিয়ে উঠে অনেকটা ঘুরে দাড়িয়েছিল ইসরাইল। এবারের যুদ্ধ চলতে পারে কয়েক মাস ধরে। ইসরাইল সরকার হামাসকে গাজা উপত্যকা থেকে নিমূল করতে চায়। এতে যুদ্ধের ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে পরিচিত গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো বড় ধরণের ক্ষতির মুখে পড়বে। যা ইসরাইলকে দীর্ঘমেয়াদে ভোগাতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
ইসরাইলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ জানিয়েছেন, চলমান যুদ্ধের কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের বিভিন্ন খাতের বরাদ্দ সংশোধন করতে হবে। ইসরাইলি মিডিয়া জানিয়েছে, চলমান যুদ্ধের কারণে আংশিকভাবে পঙ্গু হয়ে যাওয়া যাওয়া অর্থনীতির ওপর পরোক্ষ খরচের কোন মূল্যায়ন নেই স্মোট্রিচের দেওয়া হিসেবে।
এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের এক প্রতিবেদনে ঋণমান বা ক্রেডিট রেটিং আউটলুকে ইসরাইলকে ‘স্থিতিশীল’ থেকে ‘নেতিবাচক’ অবস্থায় নামিয়ে আনা হয়েছে। হামাসের সঙ্গে চলমান যুদ্ধের কারণে ইসরাইলে বিনিয়োগ ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বলেও জানিয়েছে এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল। অর্থনীতি ও নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে এ প্রভাব আরো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর আগে আন্তর্জাতিক ঋণমান নির্ণয়কারী অপর সংস্থা ফিচ রেটিংস ইসরাইলের অর্থনীতিতে নেতিবাচক ঋণমানের পূর্বাভাস দেয়।
গাজায় চলমান সংঘাত আরো তিনটি ফ্রন্টে বিস্তার ঘটার আশঙ্কা ইতিমধ্যেই জোরালো হয়ে উঠেছে। এগুলো হচ্ছে- লেবানন, অধিকৃত পশ্চিমতীর ও সিরিয়া। লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ ইতিমধ্যেই হামাসের পক্ষ নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে ইসরাইলে রকেট ও ক্ষেপনাস্ত্র হামলা করছে। এর পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ইসরাইলও লেবাননে হিজবুল্লাহর অবস্থানে বিমান ও গোলন্দাজ হামলা জোরদার করেছে।
সিরিয়ার সাথেও ইসরাইলের সংঘাতের আশঙ্কা বাড়ছে। ইসরাইলি যুদ্ধ বিমানগুলো গত কয়েকদিনে সিরিয়ার প্রধান বিমানবন্দরগুলোতে একাধিকবার বোমা বর্ষণ করে সেগুলোকে ব্যবহারের অযোগ্য করে দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে সিরিয়ার সরকার। অন্যদিকে, অধিকৃত পশ্চিমতীরেও বিক্ষুব্ধ ফিলিস্তিনিদের সাথে ইসরাইলি সেনাদের সংঘাতের আশঙ্কা জোরালো হয়ে উঠছে দিন দিন।
একাধিক ফ্রন্টে দীর্ঘমেয়াদি সংঘাত ইসরাইলের অর্থনীতিকে আগের মতো সহজেই ঘুরে দাড়াতে দেবে না বলে মরছেন অর্থণৈতিক বিশ্লেষকরা। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নিতানিয়াহুর বিচার বিভাগের বিতর্কিত সংস্কারের উদ্যোগের প্রতিবাদে দীর্ঘদিন ধরে যে ব্যাপক গণবিক্ষোভ হয়েছে তা ইসরাইলের অর্থনীতিকে ইতিমধ্যেই অনেকটা দুর্বল করে দিয়েছে। এর উপর বর্তমান যুদ্ধের কারণে অর্থনীতি আরো মুখ থুবড়ে পড়বে বলে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
ইসরাইলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ দেশের ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে একটি অর্থনৈতিক সহায়তা পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছেন। এই পরিকল্পনার মধ্যে যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসা খাতের জন্য এক বিলিয়ন ডলার অনুদান হিসেবে রাখা হয়েছে। সমালোচকরা বলছেন, বরাদ্দকৃত এই অর্থ যথেষ্ট নয়। বর্তমান জোট সরকারের সমর্থক আল্ট্রা অর্থোডক্সদের সহায়তা ও বসতি নির্মান সমর্থক দলগুলোর জন্য বরাদ্দ কয়েকশ বিলিয়ন ডলার থেকে অর্থ সরিয়ে যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনৈতিক খাতগুলোতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন তারা।
চলতি সপ্তাহেই ইসরাইলের শীর্ষস্থানীয় ৩শ অর্থনীতিবিদের একটি দল প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচকে তাদের ‘বিবেক’ অনুযায়ী কাজ করার আহবান জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, ইসরাইলের অর্থনীতির উপর যে মারাত্মক আঘাত এসেছে তা কাটিয়ে উঠতে জাতীয় অগ্রাধিকার নির্ধারণ ও অর্থনৈতিক বরাদ্দের ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে জরুরি নয় এমন যেকোন খাত ও কর্মকান্ডে অর্থ বরাদ্দ দ্রুত বাতিল করতে প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর প্রতি আহবান জানান তারা। অর্থমন্ত্রী স্মোট্রিচ নিজে ইহুদি বসতি নির্মান সমর্থক একটি কট্টরপন্থি দলের নেতা।
করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশে^র অর্থনীতিই মারাত্মক সংকটের কবলে। হামাসের সাথে চলমান যুদ্ধ ইসরাইলি অর্থনীতির সংকটকে আরো গভীর করছে। ইসরাইলি মুদ্রা শেকেলের মান এখন ১৪ বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ পর্যায়ে নেমে এসেছে। অন্যদিকে, বেঞ্চমার্ক ষ্টক সূচকের অবস্থানও চলতি বছর কমেছে ১০ পয়েন্ট। ইসরাইলের অর্থনীতির প্রানশক্তি হিসেবে পরিচিত প্রযুক্তিখাতের অবস্থাও বর্তমান যুদ্ধ শুরুর অনেক আগে থেকেই নাজুক ছিল।
ইসরাইলের কেন্দ্রিয় ব্যাঙ্ক চলতি ২০২৩ সালে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পুর্বাভাষ ৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ দশমিক ৩ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। তবে কেন্দ্রিয় ব্যাঙ্কের গভর্ণর আমির ইয়ারোন এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছেন , ইসরাইলের অর্থনীতি স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে।
যুদ্ধ শুরুর সময়ে ইসরাইলেল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২০০ বিলিয়ন ডলার। হামাসের সাথে যুদ্ধ শুরুর পর জরুরি ভিত্তিতে ইসরাইলকে ১৪ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক সহায়তা দিতে কংগ্রেসের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। এই অর্থের অধিকাংশই সামরিক খাতে ব্যয় করা হবে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর ইসরাইলকে ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে।
হামাসের সাথে যুদ্ধের শুরুতেই রকেট হামলার আশঙ্কায় তামার গ্যাস ফিল্ডে উৎপাদন বন্ধ রাখতে শেভরনকে নির্দেশ দেয় নেতানিয়াহুর সরকার। জ¦ালানি বিশেষজ্ঞ আমিত মুর মনে করেন, এই গ্যাস ফিল্ডে উৎপাদন বন্ধ রাখার কারণে ইসরাইল প্রতি মাসে অন্তত ২০ বিলিয়ন ডলার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হবে।
লেবাননের হিজবুল্লাহ যদি পুরোদমে যুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তাহলে ইসরাইলের আরো দুটি গ্যাস ফিল্ডে উৎপাদন বন্ধ করে দিতে হবে নেতানিয়াহুর সরকারকে। এর ফলে ইসরাইল প্রতিমাসে গ্যাস বিক্রি থেকে মোটা রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হবে।
ইসরাইল ইনোভেশন অথোরিটি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী ড্রোর বিন বলেছেন, অনেক কোম্পানীতে কর্মরত প্রযুক্তিবিদসহ বিভিণœ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারিকে রিজার্ভ সেনা হিসেবে তলব করায় অনেক কোম্পানীতে মারাতœক লোকবল সংকট দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি এমন দাড়িয়েছে যে, আগামী কয়েক মাসের অনেকগুলো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।