হামাসের ত্রিমুখী ফাঁদে ইসরায়েল

ওয়াশিংটন পোস্ট :  বিগত সময়ের যুদ্ধগুলোর অভিজ্ঞতা নিয়ে হামাস গাজার অভ্যন্তরে যে টানেল নির্মাণ করেছে তা শুধু টানেল নয়, বরং রীতিমতো এক গোলকধাঁধা। সঠিক পথ না জানলে এ টানেলে ঢুকে আবার বের হওয়াই কঠিন। গাজায় স্থল অভিযান শুরুর পর থেকে এই টানেলের ভয়াবহতা ইসরাইল এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। হামাসের যোদ্ধারা এখন তিনদিক থেকে ইসরাইলীদের মোকাবেলা করছে। ইসরাইলী বাহিনী কখনো ধ্বসে যাওয়া ভবনের ছাদ থেকে আক্রমনের মুখে পড়ছে, কখনো বা ধ্বংসস্তুপ আর ধুলোয় ভরা রাস্তায় তাদের গেরিলা বাহিনীর মুখে পড়তে হচ্ছে আবার কখনো মাটির নীচের টানেল থেকে হুট করে হামাস যোদ্ধাদের আবির্ভাব ঘটছে। ওয়াশিংটন পোস্ট অবলম্বনে বিস্তারিত থাকছে আজকের প্রতিবেদনে।
ভয়েস ওভার-১
হামাসের তৈরি টানেলের ভেতরে আছে হাঁটার রাস্তা, আবার আছে মিসাইল ও রকেটের মতো ভারী অস্ত্র রাখার স্থান । আবার নিরাপদে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু পথ। ইসরাইলী কর্মকর্তারা ধারনা করছেন, গাজা জুড়ে প্রায় ১৩শ টানেল তৈরি করেছে হামাস। যা প্রায় ৩শ মাইল এলাকা জুড়ে গাজা উপত্যাকাকে মাকড়শার জালের আবৃত করে রেখেছে। অথচ লম্বায় গাজা ২৫ মাইলের বেশি নয়।
সামরিক বিশ্লেষকদের মতে গাজায় হামাস যে টানেল তৈরি করেছে তা বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে সুগঠিত ও সুবিন্যাস্ত ভূগর্ভস্থ নেটওয়ার্ক। ইসরাইলী কর্তৃপক্ষ সেনাদেরকে টানেলে প্রবেশ করতে নিষেধ করেছে কারণ তাতে হত্যা বা জিম্মি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
টানেলের ভেতর ইসরাইলী সেনারা কতটা অসহায় অবস্থায় পড়েছিল, সেই অভিজ্ঞতা থাকার কারণে এবার ইসরাইলী নীতি নির্ধারকেরা দূর থেকেই হামাসের টানেল ধ্বংসের পরিকল্পনা করেছেন। এছাড়া গাজায় টানেলের আশপাশে অনেক বেসামরিক নাগরিক, নারী ও শিশু থাকার কারণে ইসরাইল টানেলের বিরুদ্ধে খুব বড়ো করেও কোনো বিধ্বংসী অভিযানও চালাতে পারছে না। গাজার উত্তরাঞ্চল খালি করার জন্য ইসরাইলী সেনারা বারবার হুমকি দেয়া স্বত্বেও অনেক স্থানেই এখনো বেসামরিক লোকদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
হামাসের টানেলগুলো খুব সম্প্রতি তৈরি করা নয়। এগুলো তৈরি করা হয়েছে দুই দশক ধরে একটু একটু করে। এর চারপাশের আবরণ কনক্রিটের, এখানে হ্যান্ড ট্রলি ব্যবহার করার মতো রাস্তা আছে, বৈদ্যুতিক লাইট আছে, টানেলের কমিউনিকেশন রক্ষার জন্য পৃথক ডিভাইস আছে। আলো- বাতাসের চলাচলের জন্য আছে ভেন্টিলেশন ফ্যান।
অনেক টানেলের পথ বেশ সরু, অনেকটা হামাগুড়ি দিয়ে যেতে হয়। আবার কিছু আছে বেশ প্রশস্ত। এমনকী ছোটখাটো যান চলাচল করতে পারবে এমনও কিছু রাস্তা টানেলের ভেতর তৈরি করা হয়েছে।

ইসরাইলী বাহিনী হামাসের এই টানেলের নাম দিয়েছে গাজা মেট্রো। টানেলগুলো থাকার কারণেই গাজার যে কোনো স্থানে হুট করেই হামাস সেনারা আবির্ভুত হতে পারছেন। রশদ ফুরিয়ে গেলে পুনরায় সরবরাহ করতে পারছে। কেউ আহত হলে তাকে নিয়ে আবার টানেলের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যেতে পারছে। হামাস নেতারা বলেছেন, এই টানেলগুলোতে বেসামরিক কেউ থাকতে পারবেন না। সাধারণ বিমান হামলা থেকে বাঁচার জন্য যে টানেল তৈরি করা হয়, এগুলো সেরকম নয়। তাই শুধুমাত্র প্রশিক্ষিত যোদ্ধারাই এর ভেতর থাকতে পারবেন।

ইসরাইলী সেনারা এরই মধ্যে টানেল থেকে বের হওয়া হামাস যোদ্ধাদের সাথেও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছেন। বেশ কিছু টানেল এরই মধ্যে ইসরাইলীরা ধ্বংস করেছে বলেও তাদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। তবে হামাসের সক্ষমতা নিয়ে সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোস্টেও সাথে কথা বলেছেন বৈরুতে অবস্থানরত সিনিয়র হামাস নেতা আলী বারাকা।
তিনি বলেন, তাদের সেনারা ভূগর্ভস্থ টানেলগুলোতে অবস্থান করছে এবং শত্রুদের মোকাবেলার জন্য পরিপূর্নভাবে প্রস্তত হয়ে রয়েছে। আল কাসসামের প্রায় ৪০ হাজার সেনা যুদ্ধ করার জন্য তৈরি হয়ে আছে, সাথে আছে অন্যান্য স্বাধীনতাকামী সংগঠনের আরো ২০ হাজার সদস্য। ইসরাইল কখনোই ৬০ হাজার সেনার সম্মিলিত আক্রমন মোকাবেলা করতে পারবে না।
ইসরাইল ২০১৪ সালে গাজায় সর্বশেষ স্থল অভিযান পরিচালনা করে। ৫০ দিন ব্যাপী সেই অভিযানে ইসরাইলী সেনারা ৩২টি টানেলকে ধ্বংস করেছিল যার মধ্যে ১৪টি দিয়ে আবার ইসরাইলের ভেতরেও হামাস সেনারা চলে যেতে পারতো। হামাস গর্ত খুড়তে খুড়তে ইসরাইলের অভ্যন্তরে চলে গিয়েছিল এবং সেখানেও টানেল বিস্তৃত করেছিল যাতে সেখান থেকে পরবর্তীতে ইসরাইলী সামরিক ঘাটিগুলোতে হামলা চালানো যায়।
বিষয়টি বুঝতে পেরে ইসরাইল ২০১৪ সালে হামাসের টানেল ধ্বংস করাকে অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারন করে। এবার ৭ অক্টোবর হামাস যে অভিযান চালিয়েছে, তখন তারা টানেল ব্যবহার করে ইসরাইলে প্রবেশ করেনি। বরং হামাস যোদ্ধারা সীমান্ত বেড়া ভেঙে প্রকাশ্যেই ইসরাইলে প্রবেশ করে।
ভিন্ন বাস্তবতায় ইসরাইল এবার আর শুধু টানেল ধ্বংস করেই থামতে চায় না। এবার তারা গাজার সামরিক ও প্রশাসনিক শক্তি হিসেবেও হামাসকে নি:শেষ করে দিতে চায়। একইসঙ্গে হামাসের হাতে থাকা ২ শ ৪২ জন জিম্মিকেও উদ্ধার করতে চায়। জিম্মিদের হামাস কোথায় রেখেছে তা এখনো নিশ্চিত নয়। তবে ইসরাইলীরা ধারনা করছে টানেলের ভেতর কোনো সুরক্ষিত স্থানেই তাদের রাখা হয়েছে।

হামাস জিম্মিদশা থেকে ৮৩ বছর বয়স্ক ইসরাইলী নারী ইওচেভড লিফশিটজকে মুক্তি দেয়। মুক্তি পাওয়ার পর তেলআবিবে উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা তাকে একটি মোটর সাইকেলের পেছনে বসিয়ে অনেকটা পথ যায়। এরপর তারা পৌঁছে যান টানেলে। টানেলের ভেতর ঢুকে প্রায় এক কিলোমিটার হাটানো হয়। চারপাশে কাঁদামাটির গন্ধ। টানেলটি তার কাছে মাকড়শার জালের মতো মনে হয়েছে। টানেলের পর টানেল ছাড়া আর কিছুই সেখানে নেই। এরপর তাদের একটি বড়ো কক্ষে নেয়া হয়, যেখানে আগে আরো ২৫ জন জিম্মিকে এনে রাখা হয়েছিল। মুক্তি পাওয়ার আগ পর্যন্ত দুই সপ্তাহ তাকে সেখানে রাখা হয়।

ইসরাইলের বার ইলান বিশ^বিদ্যালয়ের ভূতত্ববিদ জোয়েল রসকিন মনে করেন, গাজার নীচে মাটিতে যে বালির স্তর রয়েছে তা প্রায় ৫ লাখ বছরের পুরনো। এতটা পুরনো শহর হওয়ার কারণেই গাজার মাটি টানেল করার জন্য খুবই উপযোগী। আর এ কারণে এই টানেলগুলো যখন খোড়া হয় তখনও উপর থেকে কোনো শব্দই টের পাওয়া যায় না।
কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় সেচ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে গাজায় পানির কূপ স্থাপন করার বিষয়টি বহু পুরনো সংস্কৃতি। রাফা থেকে মিশর পর্যন্ত সুবিশাল টানেল তৈরি করে ৮০’র দশকে কীভাবে পন্য পাচার করতো, সেই অভিজ্ঞতা সম্পর্কেও আনেকের ধারনা আছে। হামাস এ সব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই ২০০৫ সালের পর থেকে নিজেদের মতো করে এই টানেলগুলো নির্মাণ করে।
আগে যে টানেলগুলো দিয়ে অবৈধ পন্য পাচার করা হতো হামাস এখন সেগুলো দিয়েই সিমেন্ট, ইলেক্ট্রনিকস এমনকী পুরনো গাড়ির ভাঙা অংশ আনা নেয়া করছে। এগুলো দিয়ে তৈরি করছে প্রয়োজনীয় অস্ত্র। হামাস পুরো গাজাকেই টানেলের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। ভূগর্ভস্থ এই কাঠামো দিয়েই হামাস তার কমান্ড এন্ড কন্ট্রোল সেন্টার পরিচালনা করছে। সমরাস্ত্র, বিস্ফোরক, খাবার ও জ্বালানী তেল পরিবহন করছে। এমনকী টানেলের নীচে স্থাপান করা হয়েছে রকেট তৈরির ফ্যাক্টরি।
ইসরাইলী সেনাবাহিনী বলছে, ২০১৪ সালে তারা গাজার খুব ভেতরে প্রবেশ করেনি কারণ তাদের পরিকল্পনা ছিল যেসব টানেল ইসরাইলের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ইসরাইলের ভেতর প্রবেশ করেছে শুধুমাত্র সেগুলো ধ্বংস করা। তারা সেবার গাজার ভেতর মাত্র ২ মাইল পর্যন্ত প্রবেশ করেছিল। তবে এবার তারা আরো এগুতে চায়।

আগের যুদ্ধে ইসরাইলী সেনারা স্মোক বোমা ব্যবহার করে হামাসের টানেলের ভেন্টিলেশনের পথগুলো সনাক্ত করে করে এগুতো। এপর বুলডোজার দিয়ে তা টানেলগুলো খনন করতো এবং শেষে বিস্ফোরক দিয়ে টানেলটি উড়িয়ে দিতো। হামাসের টানেলগুলো ফুটবল মাঠের মতো বড়ো বড়ো এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এবং একটি টানেল অপরটির ভেতর দিয়ে মাকড়শার জালের মতো করে নির্মাণ করা হয়েছে।

ইসরাইলের ইন্সটিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজের সিনিয়র গবেষক কবি মাইকেলের মতে, কোনোভাবেই হামাসের টানেলে ইসরাইলী সেনাদের প্রবেশ করা ঠিক হবে না। মাটির ৩০-৪০ মিটার নীচে নেমে প্রতিপক্ষের সাথে যুদ্ধ করা কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়।
ইসরাইল এরই মধ্যে টানেলে যাওয়ার জন্য আলাদা কিছু ব্যাটেলিয়ন প্রস্তুত করেছে। তাদেরকে বেশি কাজে লাগানো প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। পাশাপাশি, রোবটও ব্যবহার করা যেতে পারে। সেন্সর ব্যবহার করে বা উন্নত গোয়েন্দাবৃত্তির মাধ্যমে টানেলগুলোর অবস্থান সনাক্ত করা ইসরাইলের জন্য বেশি জরুরি।
ইসরাইল সেনারা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিটের সেনারা এসব টানেল চিহ্নিত করে তা ধ্বংস করে দিতে কাজ করছে। ইসরাইল বিগত কয়েক বছরে বিপুল অর্থ ব্যয় করে হার্ড অবসটেকল ওয়াল বা প্রতিবন্ধক দেয়াল তৈরি করেছে। এটি তারা বসিয়েছে সীমান্ত বেড়ার নীচে। পাশাপাশি, তারা গ্রাউন্ড সেন্সরও স্থাপন করেছে। যদি কেউ হামাগুড়ি দিয়ে বা অন্য কোনোভাবে নড়াচড়াও করে তাহলেও সেই গতিবিধি সেন্সরে ধরা পড়বে। এই সেন্সর তারা গাজাতেও নিয়ে গিয়েছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সেন্সর তেমন একটা কাজে আসছে না, কারণ এগুলো নিরব পরিবেশে বেশ সক্রিয় থাকে, কিন্তু ধ্বংস্তুপের ভেতর বা যুদ্ধ পরিবেশে তেমন একটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না। এ কারণেই গাজার স্থল অভিযানে এত ভারী সব ট্যাংক ও সামরিক যান একের পর এক ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
ওয়াশিংটনে কার্নেই এন্ডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসে কর্মরত জর্ডানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারওয়ান আল মুয়াশের মনে করেন, হামাসকে অতো সহজে ধ্বংস করে দেয়া সম্ভব নয়। এই যুদ্ধের কোনো সামরিক সমাধান নেই। স্বল্পসময়ে এই যুদ্ধ শেষ হচ্ছে না।
অন্যদিকে, কাতার ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক ফিলিস্তিনি বিশেষজ্ঞ আদিব জিয়াদেহ মনে করেন, ইসরাইলের হামলার জবাব দিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা আছে হামাসের। পুরোপুরি প্রস্তুতি নেয়া ছাড়া হামাসের পক্ষে ৭ই অক্টোবরের মতো হামলা চালানো অসম্ভব। এই হামলার ফল কী হবে সে হিসাব করেই তারা অভিযান পরিচালনা করে।