হামলা হুমকি বাধায় অশান্ত নির্বাচনের পরিবেশ

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রচারণার দ্বিতীয় দিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। পাল্টাপাল্টি পোস্টার ছিঁড়ে দেওয়া হয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী ও তাঁর সমর্থকদের হুমকি-ধমকি ছাড়াও প্রচারণায় হামলার অভিযোগ উঠেছে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। এ ছাড়া হামলা চালিয়ে প্রচার মাইক ও নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুরের অভিযোগ করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। প্রতিপক্ষের এ হামলা-হুমকিতে অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে নির্বাচনী পরিবেশ। এসব ঘটনায় একাধিক মামলা করা হয়েছে এবং আহত হয়েছেন উভয় পক্ষের নেতাকর্মী। ময়মনসিংহে নির্বাচনী ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মারধরে নিহতের ঘটনায় একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

ফরিদপুর-৩ আসনে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকে রাত পর্যন্ত একাধিক স্থানে মোটরসাইকেল মহড়া দিয়ে ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। বেশ কয়েকটি স্থানে স্বতন্ত্র প্রার্থী এ. কে. আজাদের ঈগল প্রতীকের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্পের সামনে অবৈধ অস্ত্র দিয়ে গুলি ছোড়াসহ দুটি ক্যাম্প ভাঙচুর ও একটি ক্যাম্পে তালা মেরে বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর আগে মামুদপুরে হামলা করে আহত করা হয়েছে দুই কর্মীকে। শহরের আলীপুরে ভয়ভীতি দেখিয়ে প্রচারণায় বাধা দেওয়া হয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীর কোনো মিছিল বা প্রচারণা বের হলে মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে তাদের আশপাশে মহড়া দিচ্ছে হেলমেট পরিহিতরা। আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামীম হকের লোকজন এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে দু’পক্ষের চারজনকে আটক করেছে পুলিশ।

জানা গেছে, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ফরিদপুর সদরের মাচ্চর ইউনিয়নের দয়ারামপুর স্কুলের সামনে ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী এ. কে. আজাদের একটি নির্বাচনী ক্যাম্পের সামনে চিহ্নিত সন্ত্রাসী ক্রসফায়ারে নিহত নায়েব আলীর ভাই সাহেব আলী কোমর থেকে পিস্তল বের করে দুই রাউন্ড গুলি ছোড়ে। একই দিন ঈশান গোপালপুরের ৯ নম্বর ওয়ার্ড বিষ্ণুপুরে স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুর করা হয়। একই ইউনিয়নের লক্ষ্মীদাশের হাটে স্বতন্ত্র প্রার্থীর আরেকটি নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুর করে বাঁশ-খুঁটি উঠিয়ে নিয়ে যায় প্রতিপক্ষ। ওমেদিয়া বাজারে একটি দোকানে স্থাপন করা স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্প তালা মেরে বন্ধ করে সেটি আর না খুলতে হুমকি দেওয়া হয়েছে। ১ নম্বর ওয়ার্ডে রাতের আঁধারে পোস্টার ছিঁড়ে ফেলার পাশাপাশি পটকা ফুটিয়ে কর্মীদের হাতে থাকা লিফলেট ছিঁড়ে ফেলেছে।

ঈগল প্রতীকের প্রার্থীর নির্বাচনী সমন্বয়ক শোয়েবুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের প্রচার- প্রচারণায় যেভাবে বাধা দেওয়া হচ্ছে, তাতে আমাদের সমর্থকদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের সমর্থকরা ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ হারাবেন।’ তবে অভিযোগ অস্বীকার করে ঈশান গোপালপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মজনু বলেন, কোনো ভাঙচুর বা নির্বাচনী ক্যাম্প বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা ঘটেনি।

ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার ওসি শহিদুল ইসলাম বলেন, পুলিশ রাতে দুটি মামলায় অভিযুক্ত দু’পক্ষের চারজনকে আটক করেছে। তারা হলেন এ. কে. আজাদের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি মুন্নু মোল্লা (৫৫) ও রনি মোল্লা (৩৭)। অন্যদিকে নৌকা প্রার্থী শামীম হকের গ্রুপের আজাদ মোল্লা (৩০) ও আসাদ মোল্লা (৩৫)।

নৌকা পোড়ানোর অভিযোগ তুলে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে সমাজকল্যাণমন্ত্রীর ভাই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে ১৯৯১ সালে সমাজকল্যাণমন্ত্রী নূরুজ্জামান আহমেদ ক্ষুব্ধ হয়ে নৌকা পুড়িয়েছিলেন। তখন তিনি জাতীয় পার্টি ও বিএনপির পক্ষে কাজ করতেন। তিনি নারী নেতৃত্ব মানেন না বলেও একাধিক জায়গায় বলেছেন। এখন তিনি নৌকার প্রার্থী হয়েছেন। নৌকা পোড়ানোর অভিশাপ তাঁকে পেয়ে বসেছে। এবার তাঁকে হারতে হবে। সমাজকল্যাণমন্ত্রী নূরুজ্জামান আহমেদের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির এমন অভিযোগ তুলে নির্বাচনী প্রচারণায় বক্তব্য দিয়েছেন মন্ত্রীর ছোট ভাই কালীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান মাহবুবুজ্জামান আহমেদ। এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি সিরাজুল হকের কর্মী সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। লালমনিরহাট-২ (আদিতমারী ও কালীগঞ্জ) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী সিরাজুল হক ঈগল প্রতীক এবং টানা তৃতীয়বারের মতো নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করছেন নূরুজ্জামান আহমেদ। আদিতমারী উপজেলা চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা ইমরুল কায়েস ফারুক ও মন্ত্রীর ছোট ভাই মাহবুবুজ্জামান আহমেদ স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন। পরিবারের গৃহদাহ সমাজকল্যাণমন্ত্রীকে ভোগাবে বলে মনে করছেন তৃণমূল নেতাকর্মী। তবে নৌকা পোড়ানোর অভিযোগ নিয়ে সমাজকল্যাণমন্ত্রীর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

চট্টগ্রামের পটিয়ায় ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জাতীয় সংসদের বর্তমান হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর নির্বাচনী প্রচারণায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর নেতাকর্মী হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গতকাল বিকেলে উপজেলার কাশিয়াইশ ইউনিয়নে এ ঘটনা ঘটে। রামদা, কিরিচ ও চায়নিজ কুড়াল দিয়ে হুইপের গাড়িবহরের ছয়টি গাড়ির চাকা কেটে দেওয়া হয়। প্রতিপক্ষের হামলায় ২৫-৩০ জন ঈগল সমর্থক আহত হন। প্রতিপক্ষের হামলায় হুইপ সামশুল হক চৌধুরী অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন বলে জানান স্থানীয়রা। খবর পেয়ে পটিয়া নির্বাচন অনুসন্ধান কমিটির চেয়ারম্যান ও চন্দনাইশ আদালতের জ্যেষ্ঠ সহকারী জজ শেখ মুহিবুল্লাহ, পটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলাউদ্দিন ভুঁইয়া জনি, পটিয়া সার্কেলের এএসপি আতিকুর রহমান ঘটনাস্থলে ছুটে যান।

চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনের নৌকা প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী মুজিবুর রহমান সিআইপির সমর্থকদের মধ্যে ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনের এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন। এতে ইটের আঘাতে আহত মহাজনপাড়া এলাকার নেপাল দাশের ছেলে রনি দাশ (২৯) এবং দক্ষিণ জলদী এলাকার আবুল কাসেমের ছেলে জসীম উদ্দিনকে (৩২) চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়।

পটুয়াখালী-৩ (দশমিনা-গলাচিপা) আসনের ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আবুল হোসেন আজাদের প্রচার মাইক ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছে নৌকার সমর্থকদের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় গতকাল বুধবার দশমিনা উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাসান সেরনিয়াবাতসহ ১০ জনের নাম উল্লেখ করে থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ঈগল প্রতীকের সমর্থক হিরন শরীফ। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে ছাত্রলীগ নেতা হাসান সেরনিয়াবাত জানান, ওই ছেলেটি রিকশাসহ মাইক নৌকার মিছিলের মধ্যে ঢুকে পড়ায় প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। কোনো ভাঙচুর করা হয়নি।

রাজবাড়ী-২ (পাংশা-বালিয়াকান্দি-কালুখালী) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী নুরে আলম সিদ্দিকী হকের ঈগল প্রতীকের প্রচারণায় বাধা দেওয়ায় জাকির হোসেন হিরু নামের এক ইউপি সদস্যকে আটক করেছে কালুখালী থানা পুলিশ। গতকাল দুপুরে কালুখালী উপজেলার রতনদিয়া বাজার এলাকা থেকে তাঁকে আটক করা হয়। হিরু রতনদিয়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য।

এদিকে ময়মনসিংহ সদরে নির্বাচনী ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভাই ও ভাতিজাদের মারধরে রফিকুল ইসলাম নিহতের ঘটনায় মামলা করা হয়েছে। নিহতের মেয়ে বাদী হয়ে নিহতের ভাই ফারুক হোসেন এবং অপর ভাই ওয়াজ উদ্দিনের স্ত্রী মর্জিনা খাতুন, তাঁর ছেলে জাকির হোসেন রাজু ও আরিফুল ইসলাম সাজুকে আসামি করে থানায় মামলা করেন। ওই মামলায় মর্জিনাকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ।

জয়পুরহাট-২ (কালাই-ক্ষেতলাল-আক্কেলপুর) আসনে নৌকার পোস্টার ছেঁড়া নিয়ে দুই প্রার্থীর কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে আহতের ঘটনায় পাল্টাপাল্টি মামলা করা হয়েছে। দু’পক্ষের অভিযোগের পর মঙ্গলবার রাতে পুলিশ সেগুলো মামলা হিসেবে রেকর্ড করে।

মুন্সীগঞ্জ-৩ (সদর-গজারিয়া) আসনের নৌকার প্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছে। মঙ্গলবার গভীর রাতে সদরের হোগলাকান্দি গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। নৌকা প্রতীকের লোকজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের দায়ী করেছে। পুলিশ বলছে, ক্যাম্প ভাঙচুরের সঙ্গে কে বা কারা জড়িত, তা শনাক্ত করতে তদন্ত চলছে।

গাজীপুর-৩ আসনের নৌকার প্রার্থী ও সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য রুমানা আলীর কর্মীদের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেন সবুজের সমর্থকদের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে। গতকাল দুপুরে শ্রীপুরের বরমী ইউনিয়নের বরনল এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এতে ট্রাক প্রতীকের প্রার্থী সবুজের কর্মী আবদুল মালেক, মাসুদা বেগম ও সুমি আক্তার আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত আবদুল মালেক সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

সমকাল