হামলা-সংঘাতে উত্তেজনা, ভোটার খরারও শঙ্কা

হামলা-সংঘাতে উত্তেজনা, ভোটার খরারও শঙ্কা

উপজেলা ভোটের দ্বিতীয় ধাপেও সহিংসতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। নির্বাচনী প্রচারে হামলা-ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, প্রতিপক্ষকে হুমকি এবং প্রভাব বিস্তারের ঘটনায় জোরালো হয়েছে কেন্দ্রে ভোটার খরার শঙ্কাও। শনিবার রাতে পথসভা থেকে ফেরার পথে হামলার শিকার হয়েছেন চট্টগ্রামের চন্দনাইশের চেয়ারম্যান প্রার্থী জসিম উদ্দীন আহমেদ। বরগুনার পাথরঘাটা, বগুড়ার শিবগঞ্জ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় চেয়ারম্যান প্রার্থীর নির্বাচনী কার্যালয়ে ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে গতকাল রোববার মধ্যরাতে শেষ হয়েছে আনুষ্ঠানিক প্রচার। আগামীকাল মঙ্গলবার ১৫৬ উপজেলায় নেওয়া হবে ভোট।

নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে এ ধাপে ১৬০ উপজেলার তপশিল দিলেও চারটিতে ভোট বন্ধ রয়েছে। তিনটি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১ হাজার ৬৩৫ জন। এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ৬০৩, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৬৯৩ ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৫২৮ জন। অবশ্য তিন পদে এরই মধ্যে ২২ জন বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। এর মধ্যে কুমিল্লার আদর্শ সদর ও চট্টগ্রামের রাউজানের তিন পদের কোনোটিতে ভোট লাগছে না। এ ধাপের মতো আগামী ২৯ মে তৃতীয় ধাপের নির্বাচন ঘিরেও বিভিন্ন উপজেলায় প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে হামলা-সংঘর্ষ হয়েছে। শনিবার রাতে ফরিদপুরের ভাঙ্গায় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থীর পথসভায় হামলার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় এমপি মজিবুর রহমান নিক্সনের অনুসারীদের বিরুদ্ধে।

ইসি সচিবালয় জানায়, এ ধাপে সারাদেশে ৪৫৭ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। আগামী ২৩ মে পর্যন্ত তারা মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে কাজ করবে। নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে শুরুতে নানা কৌশলের কথা বলা হলেও প্রথম ধাপের পরে হাল ছেড়ে দিয়েছে ইসি। প্রথম ধাপে উপজেলা ভোটের সর্বনিম্ন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। ৮ মে ১৩৯ উপজলায় ভোট পড়ে মাত্র ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ।

এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেছেন, এর একটি বড় কারণ বিএনপি। ভোট বর্জন করায় তাদের কর্মী-সমর্থক কেন্দ্রে আসছেন না। আরেকটি বড় কারণ স্থানীয় নির্বাচনে ভোটাররা চাকরিস্থল থেকে ভোট দিতে আসতে চান না।

১৩ হাজার ১৬ কেন্দ্রের ৯১ হাজার ৫৮৯ ভোট কক্ষে ৩ কোটি ৫২ লাখ ৪ হাজার ৭৪৮ জন ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। তাদের মধ্যে পুরুষ ১ কোটি ৭৯ লাখ ৫ হাজার ৪৬৪, নারী ১ কোটি ৭২ লাখ ৯৯ হাজার ৪৭ ও ২৩৭ জন তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার। নির্বাচনে ৮৯ হাজার ৮৬৩ পুলিশ ও ১ লাখ ৯৩ হাজার ২৮৭ আনসার সদস্য দায়িত্বে থাকবেন। নির্বাচন ঘিরে সহিংসতা বিষয়ে ইসি আলমগীর বলেন, দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হবে বলে আশা করছে ইসি। ছোটখাটো  সমস্যা যাতে না হয়, সে জন্য পুলিশ প্রশাসন সতর্ক।

মুন্সীগঞ্জে হামলায় আহত ২৬

মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের গাওদিয়া ইউনিয়নে গত শুক্র ও শনিবার উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক এবং চেয়ারম্যান প্রার্থী বি এম শোয়েবের সমর্থকদের ওপর হামলায় অন্তত ২৬ জন আহত হন। এ জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রশিদ শিকদারের সমর্থকদের দায়ী করা হয়েছে। এ ছাড়া মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ীতে শনিবার সংবাদ সম্মেলন করে চেয়ারম্যান প্রার্থী রাহাত খান রুবেল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নির্বাচনী পরিবেশ বাধাগ্রস্ত করার অভিযোগ করেন।

ধামরাইয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় পাল্টাপাল্টি মামলা

ঢাকার ধামরাই উপজেলায় দুই প্রভাবশালী চেয়ারম্যান প্রার্থী খালেদ মাসুদ খান লাল্টু এবং আবদুল লতিফের অনুসারীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ, প্রচারে বাধা ও নির্বাচনী ক্যাম্পে তালা দেওয়ার ঘটনায় পাল্টাপাল্টি মামলা হয়েছে। শনিবার রাতে দুটি মামলায় অন্তত ৪০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

প্রার্থী লাল্টু স্থানীয় সংসদ সদস্য বেনজীর আহমদ এবং আবদুল লতিফ সমর্থন পেয়েছেন সাবেক এমপি এম এ মালেকের। গত শুক্রবার রাতে তাদের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ১৫ জন আহত হন।

চট্টগ্রামে প্রার্থীর গাড়িতে হামলা

চট্টগ্রামের চন্দনাইশে পথসভা শেষে ফেরার পথে চেয়ারম্যান প্রার্থী জসিম উদ্দীন আহমেদের গাড়িবহরে হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় তাঁর এক সমর্থককে মারধর করা হয়। গত শনিবার রাত ৮টার দিকে উপজেলার হাশিমপুর বাগিচাহাট খানদীঘি উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে এ ঘটনা ঘটে। পরে মারধরের শিকার নিবু বড়ুয়া থানায় মামলা করেন।

এদিকে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে হাটহাজারী উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সোহরাব হোসেন চৌধুরী নোমান অভিযোগ করেন, প্রতিদ্বন্দ্বী দুই চেয়ারম্যান প্রার্থী বহিরাগত সন্ত্রাসী দিয়ে ৩২টি ভোটকেন্দ্র দখল করে সিল মারার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গোপন বৈঠক করছেন।

দুই ওসির বিরুদ্ধে অভিযোগ

বাগেরহাটের ফকিরহাটে বর্তমান চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি স্বপন কুমার দাসের পক্ষ নিয়ে দুই ওসির বিরুদ্ধে প্রভাব বিস্তার এবং ভোটারদের হুমকি-ধমকি দেওয়ার অভিযোগ করেছেন মোটরসাইকেল মার্কার প্রার্থী শেখ ওয়াহিদুজ্জামান বাবু। গতকাল তিনি সিইসি বরাবর ই-মেইলে এ অভিযোগ করেন।

অভিযুক্তরা হলেন ফকিরহাট মডেল থানার ওসি আশরাফুল আলম ও জেলার ডিবির ওসি স্বপন রায়। জানতে চাইলে স্বপন রায় বলেন, ‘নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে বহিরাগত ঠেকানো ও অবৈধ অস্ত্র রুখতে রুটিন কাজ করেছি। কাউকে হুমকি-ধমকি দিইনি।’

নড়াইলে আ’লীগ নেতাকে মারধর

নড়াইল সদরে গত ১৫ মে শাহাবাদ ইউনিয়নের গোপীকান্তপুর গ্রামে চেয়ারম্যান প্রার্থী আজিজুর রহমান ভূঁইয়ার অনুসারীরা পিটিয়ে জখম করেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী তোফায়েল মাহমুদ তুফানের সমর্থক আশরাফ খান মাহামুদকে। আশরাফ শাহাবাদ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি। পরদিন শাহাবাদ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য দেলোয়ার হোসেন পান্নাসহ আটজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি।

এদিকে জাতীয় সংসদের হুইপ ও নড়াইল-২ আসনের এমপি মাশরাফি বিন মুর্তজার বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ করেছেন সদরের প্রার্থী তোফায়েল মাহমুদ তুফান। গতকাল বিকেলে তিনি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন।

সিলেটে একাধিক উপজেলায় উত্তেজনা

সিলেটের ২৮ উপজেলার ভোট মঙ্গলবার। এ নির্বাচন ঘিরে সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুরে দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকের মধ্যে হামলা ও গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। গত ১০ মে উপজেলার ফতেপুরে প্রার্থী রণজিত চৌধুরী ও দিলীপ কুমার বর্মণের সমর্থকদের মধ্যে ওই ঘটনা ঘটে।

ভোটারদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ, সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুরসহ কয়েকটি উপজেলায় অপ্রীতিকর ঘটনার আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রচারের সময় এসব উপজেলায় উত্তেজনাও দেখা গেছে।

তিন উপজেলায় কার্যালয়ে ভাঙচুর-আগুন

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় চেয়ারম্যান প্রার্থী মুরাদ হোসেন ভূঁইয়ার নির্বাচনী কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। শনিবার রাত পৌনে ২টার দিকে উপজেলার দক্ষিণ ইউনিয়নের গাজীর বাজারে এ ঘটনা ঘটে। মুরাদ হোসেনের অভিযোগ, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী মনির হোসেনের লোকজন আমার নির্বাচনী কার্যালয়ে আগুন দিয়েছেন। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মনির হোসেন।

বরগুনার পাথরঘাটায় শনিবার  রাত সাড়ে ৯টার দিকে চেয়ারম্যান প্রার্থী এনামুল হোসাইনের নির্বাচনী কার্যালয়ে হামলা-ভাঙচুর চালানো হয়। প্রতিপক্ষ চেয়ারম্যান প্রার্থী মোস্তফা গোলাম কবিরের সমর্থকদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করেন এনামুল। তবে মোস্তফা গোলাম বলেন, ‘প্রতিপক্ষ প্রার্থী ভাঙচুরের নাটক সাজিয়েছেন।’

বগুড়ার শিবগঞ্জের আটমুলের ভাইয়ের পুকুর এলাকায় শনিবার রাতে চেয়ারম্যান প্রার্থী ফিরোজ আহম্মেদ রিজুর নির্বাচনী কার্যালয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। রিজু জাতীয় পার্টির স্থানীয় সংসদ সদস্য শরীফুল ইসলাম জিন্নাহর শ্যালক। রিজু রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে গতকাল রোববার লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এতে তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও চেয়ারম্যান প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তার অনুসারীদের দায়ী করেছেন।

এ ছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার শাহপুর গ্রামে গতকাল দুপুরে আনারস মার্কার পক্ষে ভোট কেনার সময় টাকাসহ তিন যুবককে ধরে পুলিশে দেওয়া হয়। এ সময় টাকা নেওয়ার অভিযোগে চার নারীকেও ধরা হয়। আনারস প্রতীকের প্রার্থী আইনমন্ত্রীর সাবেক এপিএস রাশেদুল কাওসার ভূঁইয়া জীবন এ ঘটনাকে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেছেন। তবে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সাইদুর রহমান স্বপন বলেন, কালো টাকা দিয়ে কসবা সয়লাব করেছেন জীবন।

লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে স্থানীয় এমপি নুরউদ্দিন চৌধুরীর ভগ্নিপতি মামুনুর রশিদকে বিজয়ী করতে প্রতিপক্ষকে এলাকাছাড়া করার হুমকির অভিযোগ করা হয়েছে। আরেক প্রার্থী আলতাফ হোসেন গতকাল সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ করেন।
শরীয়তপুর সদরে চেয়ারম্যান প্রার্থী নুরুল আমিন কোতোয়ালের ওপর শনিবার হামলার অভিযোগ উঠেছে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কামরুজ্জামান আকন্দ উজ্জ্বলের সমর্থকদের বিরুদ্ধে।

নেত্রকোনার পূর্বধলায় চেয়ারম্যান পদে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য এটিএম ফয়জুর সিরাজ জুয়েল, পূর্বধলা উপজেলা যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক মাছুদ আলম টিপু ও কেন্দ্রীয় তাঁতীদলের সাবেক নেতা আসাদুজ্জামান নয়ন লড়ছেন। এখানে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেনের পছন্দের প্রার্থী আসাদুজ্জামানের লোকজন অপর দুই প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকের ওপর হামলা চালাচ্ছে। গত শুক্রবার রাতে এটিএম ফয়জুর সিরাজ জুয়েলের নির্বাচনী কার্যালয়ে ভাঙচুর ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে মাছুদ আলম তালুকদার টিপুর দুই সমর্থককে পিটিয়ে আহত করেছে দুর্বৃত্তরা।

ফরিদপুরে কাজী জাফর সমর্থিত প্রার্থীর ওপর হামলা

ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী মোখলেছুর রহমান সুমনের পথসভায় হামলা হয়েছে। এ সময় কয়েকটি গাড়ি, চেয়ার ও মাইক ভাঙচুর করা হয়। এতে আহত হয়েছেন অন্তত তিনজন। শনিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে উপজেলার মানিকদহ ইউনিয়নের ব্রাহ্মণকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে এ হামলার ঘটনা ঘটে।

জানা যায়, আগামী ২৯ মে তৃতীয় ধাপের নির্বাচন ঘিরে ব্রাহ্মণকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে গতকাল কাজী জাফরউল্লাহ সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী মোখলেছুর রহমানের পথসভা চলছিল। রাত সাড়ে ৮টার দিকে স্থানীয় সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান নিক্সন চৌধুরী সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী কাউছার ভূঁইয়ার লোকজন হামলা চালায়।

ভাঙ্গা উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সাইফুর রহমান মিরন বলেন, অতর্কিতভাবে তারা আমাদের গাড়ি ভাঙচুর করে। পরে হামলা চালায় পথসভায়।

সমকাল