জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচার শুরুর পর থেকে আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকের মধ্যে হামলা, সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে। প্রতীক বরাদ্দ থেকে গতকাল সোমবার পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ, গোলাগুলি, নির্বাচনী ক্যাম্পে আগুন, ভাঙচুর ও পোস্টার ছেঁড়ার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় আহত হয়েছে উভয় পক্ষের নেতাকর্মী; হচ্ছে পাল্টাপাল্টি মামলা।
টাঙ্গাইল-৫ আসনে নৌকার প্রার্থী মামুনুর রশিদ মামুনের তিন কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। রোববার রাতে উপজেলার বাঘিল ইউনিয়নের জুগনী এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। আহতরা হলেন বাঘিল ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক রোকনুজ্জামান রোকন, কর্মী এমদাদুল ও সিয়াম।
মামুনুর রশিদ জানান, রাতে বাঘিল ইউনিয়নে তাঁর কর্মী-সমর্থক মোটরসাইকেল র্যালি বের করে। জুগনী এলাকায় পৌঁছালে সদর আসনের বর্তমান এমপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ছানোয়ার হোসেনের সমর্থকরা তাঁর সমর্থকের ওপর গুলি চালালে তিনজন আহত হন। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ছানোয়ার হোসেন। টাঙ্গাইল সদর থানার ওসি লোকমান হোসেন জানান, ঘটনায় জড়িত সন্দেহে স্বতন্ত্র প্রার্থীর দুই সমর্থককে আটক করা হয়েছে।
গতকাল কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক জহিরুল ইসলাম মুন্সীসহ চারজনকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে আহত করা হয়। আহত অন্য তিনজন হলেন উপজেলা যুবলীগের প্রচার সম্পাদক আবুল খায়ের, বড়করই ইউনিয়ন যুবলীগের সহসভাপতি মহিউদ্দিন ও গাড়িচালক মো. ইউসুফ। আহতরা কুমিল্লা-৭ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মুনতাকিম আশরাফ টিটুর সমর্থক। টিটুর অভিযোগ, জহিরুল কয়েকজন সহযোগী নিয়ে নবাবপুর ইউনিয়নে পোস্টার বিতরণ করে ফেরার পথে নৌকার প্রার্থীদের হামলার শিকার হন। এ সময় তাদের প্রাইভেটকারও ভাঙচুর করা হয়। নৌকার প্রার্থী ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত বলেছেন, হামলার বিষয়টি তাঁর জানা নেই।
কুমিল্লা-১০ আসনে জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রার্থী জোনাকি হুমায়ুনের গণসংযোগে হামলায় দু’জন আহত হয়েছেন। গতকাল দুপুরে নাঙ্গলকোট উপজেলার পেরিয়া ইউনিয়নের কাকৈরতলা বাজারে এ ঘটনা ঘটে। নাঙ্গলকোট থানার ওসি দেবাশীষ চৌধুরী জানান, জাপা প্রার্থীর গণসংযোগে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মী হামলা চালায়। লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বগুড়া-৪ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী জিয়াউল হকের পক্ষে কাজ করার অভিযোগ তুলে আওয়ামী লীগের তিন নেতাকর্মীকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে জাসদ মনোনীত প্রার্থী রেজাউল করিম তানসেনের কর্মী-সমর্থকের বিরুদ্ধে। গতকাল দুপুরে উপজেলার শিমলা বাজারে এ ঘটনা ঘটে। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেন তানসেন। নন্দীগ্রাম থানার ওসি আজমগীর হোসাইন জানান, এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দিয়েছেন জিয়াউল হক।
এক রাতে নওগাঁ-৫ আসনের নৌকার প্রার্থী নিজাম উদ্দিন জলিল জনের পাঁচটি নির্বাচনী ক্যাম্পে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হয়েছে। এসব ঘটনা ঘটানোর অভিযোগ উঠেছে স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ান ছেকার আহমেদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া নওগাঁ-১ আসনের নৌকার প্রার্থী খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের একটি ক্যাম্পে আগুন ও ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছে। রোববার রাতে নওগাঁ সদরের বক্তারপুর ইউনিয়নের চকতারতা মোড়, মুক্তারপাড়া মোড়, হাল ঘোষপাড়া মোড়, তিলকপুর ইউনিয়নের ছিটকীতলা মোড়, পৌর শহরের কালীতলা এলাকা এবং পোরশার নিতপুর ইউনিয়নে এসব ঘটনা ঘটে। এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী। রোববার রাতে নওগাঁ-৬ আসনের এমপি ও নৌকার প্রার্থী আনোয়ার হোসেন হেলালের নির্বাচনী ক্যাম্পের চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর ও ব্যানার-পোস্টার ছিঁড়ে ফেলার ঘটনা ঘটেছে। আত্রাই উপজেলার সাহাগোলা ইউনিয়নের হাতিয়াপাড়া মোড়ে এ ঘটনা ঘটে।
এ ছাড়া নওগাঁর রানীনগরে গতকাল স্বতন্ত্র ও নৌকা প্রার্থীর সমর্থকের মধ্যে মারামারিতে অন্তত ১০ জন আহত হন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিকেলে কাশিমপুর এলাকায় ট্রাক প্রতীকের লোকজন নির্বাচনী প্রচারে বের হলে নৌকার সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। সেখানে দু’পক্ষে ছয়জন আহত হন। এর জেরে রানীনগর বাস টার্মিনাল এলাকায় উভয় পক্ষে মারামারি হয়। সেখানেও আহত হন বেশ কয়েকজন। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় উপজেলা শ্রমিক লীগের সাবেক সহসভাপতি সজীব মৃধাকে কুপিয়ে জখম করা হয়েছে। রোববার রাতে পৌর শহরের কুমারপট্টি এলাকায় উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের ভেতরে এ ঘটনা ঘটে। সজীব এ ঘটনার জন্য উপজেলা যুবলীগের সহসাধারণ সম্পাদক রকিবুল ইসলাম এবং উপজেলা শ্রমিক লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক জনি সরদারকে দায়ী করেছেন। কলাপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোতালেব তালুকদার বলেন, নিজেদের মধ্যে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা নিয়ে এ ঘটনা ঘটেছে।
জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী ডা. মুরাদ হাছানের (ঈগল প্রতীক) নির্বাচনী ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী মাহবুবুর রহমান হেলালের সমর্থকরা। এ ঘটনায় ডা. মুরাদের ১০ সমর্থক আহত হয়েছেন। গতকাল রাত ৯টায় সরিষাবাড়ী পৌর এলাকার তাড়িয়াপাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
স্থানীয়রা জানান, রাত ৯টার দিকে ডা. মুরাদের কর্মী-সমর্থকরা তাড়িয়াপাড়ায় নির্বাচনী ক্যাম্পে যাচ্ছিলেন। পৌঁছামাত্র ওত পেতে থাকা নৌকার কর্মী-সমর্থকরা লাঠিসোটা ও দেশি অস্ত্র নিয়ে তাদের ওপর হামলা চালায়। সংবাদ পেয়ে সরিষাবাড়ী থানার ওসি মুশফিকুর রহমানের নেতৃত্বে পুলিশ গিয়ে উভয় পক্ষকে সরিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
নাটোর-৪ আসনে নৌকার প্রার্থী সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারীর সমর্থকদের তৈরি একটি বাঁশের নৌকা রোববার রাতে পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। গুরুদাসপুর উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের বেড়গঙ্গারামপুর ৭ নম্বর ওয়ার্ডে এ ঘটনা ঘটে। এদিকে নাটোর-১ আসনের বর্তমান এমপি ও নৌকার প্রার্থী শহিদুল ইসলাম বকুলের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলে দুর্বৃত্তরা।
লক্ষ্মীপুর-৩ আসনে নৌকার প্রার্থী গোলাম ফারুক পিংকুর নির্বাচনী প্রচারের গাড়ি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছে। রোববার রাতে সদর উপজেলার লাহারকান্দি ইউনিয়নের পশ্চিম সৈয়দপুর গ্রামের বক্সআলী বাড়ির সামনে এ ঘটনা ঘটে। পিংকুর দাবি, এ ঘটনা জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী ঘটিয়েছে।
কুষ্টিয়া-৪ আসনে নির্বাচনী আচরণবিধি মানছেন না নৌকার প্রার্থী সেলিম আলতাফ জর্জ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুর রউফের কর্মী-সমর্থক। তাদের বিরুদ্ধে নির্বাচনী কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ ও পোস্টার ছেঁড়ার পাল্টাপাল্টি অভিযোগ উঠেছে। সোমবার ভোরে কুমারখালীর কয়া ইউনিয়নের সুলতানপুর বেলতলা এলাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ এবং রোববার রাতে কুমারখালী স্টেশন বাজার এলাকায় নৌকা ও ট্রাক প্রতীকের পোস্টার ছেঁড়ার ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া রোববার দুপুরে কুমারখালী পৌরসভার কাজীপাড়া রেলগেট এলাকায় ন্যাশনাল পিপলস পার্টির প্রার্থী শহিদুল ইসলামকে আটকে রেখে চাঁদা দাবির অভিযোগ উঠেছে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা সিয়ামের বিরুদ্ধে। এসব ঘটনায় সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে চারটি লিখিত অভিযোগ করেছেন ওই তিন প্রার্থী।
খুলনা-৩ আসনে নৌকার প্রার্থী এস এম কামাল হোসেনের একটি প্রচার ক্যাম্পে অগ্নিসংযোগ করা হয়। রোববার রাতে যোগীপোল ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডে এ ঘটনা ঘটে। পাবনা-৩ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল হামিদ মাস্টারের নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর, পোস্টার ছেঁড়া এবং এক সাংবাদিকের বাড়িতে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় অভিযুক্ত দু’জনকে শোকজ করা হয়েছে। নোটিশ পাওয়া ব্যক্তিরা হলেন চাটমোহর উপজেলার অমৃতকুণ্ডা গ্রামের ফোরকান আলী বিশ্বাস ও তাঁর শ্বশুর একই গ্রামের এস এম আলম বাবলু।
চট্টগ্রাম-১০ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক সিটি মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলমের পোস্টার ও ব্যানারে আগুন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে নৌকার প্রার্থী মহিউদ্দিন বাচ্চুর সমর্থকদের বিরুদ্ধে। গতকাল সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা মোস্তফা কামালের কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ করেন মনজুর আলম। মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে নৌকার প্রার্থী মৃণাল কান্তি দাসের নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের বিরুদ্ধে। রোববার রাতে সদর উপজেলার মোল্লাকান্দি ইউনিয়নের চৈতারচর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। লক্ষ্মীপুর-১ আসনে নৌকার প্রার্থী আনোয়ার হোসেন খানের পোস্টার ছিঁড়েছে দুর্বৃত্তরা। রোববার রাতে রামগঞ্জ উপজেলার ভাটরা ইউনিয়নের কয়েকটি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
রাজশাহী-৬ আসনে নৌকার প্রার্থী পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের দুটি নির্বাচনী ক্যাম্পে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বাঘা পৌরসভার মর্শিদপুর ও বাজুবাঘা ইউনিয়নের জোতজয়রাম গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে নৌকার প্রার্থী ও বর্তমান এমপি এ কে এম শামীম ওসমান একটি উঠান বৈঠকে বক্তব্য রাখার সময় কে বা কারা দুটি ঢিল ছুড়ে মারে। এতে এক নারী আহত হন। গতকাল বিকেলে সদর উপজেলার ফতুল্লার পিলকুনি পাঁচতলা এলাকায় মোবারক মিয়ার বাড়ির সামনে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি বলেছেন, ফতুল্লার মানুষ শামীম ওসমানের প্রতি ক্ষুব্ধ। এসব কারণে কেউ ঢিল ছুড়তে পারে।
এদিকে নির্বাচনী প্রচার ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে মানিকগঞ্জ-২ আসনে নৌকার প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সোমবার সারাদিন হরিরামপুর উপজেলা পরিষদের সামনে উত্তেজনা দেখা যায়। ওই আসনে নৌকার প্রার্থী বর্তমান এমপি মমতাজ বেগম এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী জাহিদ আহম্মেদ টুলু। এর আগে রোববার হরিরামপুর উপজেলা পরিষদ চত্বরে দুই প্রার্থীর অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষে কয়েকজন আহত হন। এ ঘটনায় উভয় পক্ষ থানায় তিনটি মামলা করেছে।
সমকাল