জায়গা-জমি দখল করাই নেশা হয়ে উঠেছিল ঢাকা-৭ আসনের আওয়ামী লীগদলীয় সাবেক এমপি হাজী সেলিমের। পুরাকীর্তি (হেরিটেজ), নদীর জায়গা, সাধারণ মানুষের ভূমি, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের হল দখল করে বিতর্কিত এই নেতার পরিবার বানিয়েছে মার্কেট, বহুতল ভবন, তেলের পাম্প, ফলের আড়তসহ নানা স্থাপনা। সরকারি দলের দাপট দেখিয়ে লালবাগ এলাকায় যা খুশি তা-ই করেছেন হাজী সেলিম। এতে সহযোগী ছিলেন তাঁর দুই ছেলে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি সোলায়মান সেলিম ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সাবেক কাউন্সিলর ইরফান সেলিম।
একসময় সোয়ারীঘাটে কুলি ছিলেন হাজী সেলিম। তারপর বিএনপির রাজনীতিতে যোগ দেন। সুবিধা করতে না পেরে সওয়ার হন আওয়ামী লীগের ঘাড়ে। এরপর কয়েক দফায় আওয়ামী লীগদলীয় এবং স্বতন্ত্র এমপি হয়েছেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজে প্রার্থী না হয়ে ছেলে সোলায়মানকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি বানান।
নানা অপকর্মের কারণে একাধিকবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটকও হয়েছেন বাবা-ছেলে। তবে আইনের ফাঁকফোকর গলে আবার বেরিয়েও পড়েন। গত ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের কিছু দিন পরই গ্রেপ্তার হন হাজী সেলিম। গতকাল গ্রেপ্তার হয়েছেন তাঁর ছেলে সোলায়মান সেলিম। ছোট ছেলে ইরফান এখনও অধরা। তবে এ পরিবারের রাজত্ব বহাল আছে লালবাগ এলাকায়। ভয়ে এলাকাবাসী এখনও সেলিম পরিবারের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পান না।
স্থানীয়রা জানান, সদরঘাটের নবাববাড়িতে দেড় বিঘারও বেশি জায়গার ওপর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) একটি ছাত্রাবাস ছিল। পুরোনো হয়ে যাওয়ায় সেটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। ২০১৫ সালে সেটি দখল করে নেন হাজী সেলিম। এর পর সেখানে তৈরি করেন আটতলা একটি মার্কেট। ‘গুলশানারা চিঠি’ নামে ওই কাপড়ের মার্কেটের নিচতলাতেই রয়েছে পাঁচ শতাধিক দোকান।
এই মার্কেট দিয়েই শতকোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন হাজী সেলিম। এখনও মার্কেটটি সেলিম পরিবারেরই নিয়ন্ত্রণে।
ঠিক একইভাবে বাদামতলীতে বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে বিআইডব্লিউটিএর প্রায় পাঁচ কাঠা জমি দখল করে বানিয়েছেন ফলের আড়ত। নাম দেওয়া হয়েছে ‘এনটিসি ফলের আড়ত’।
লালবাগের বেড়িবাঁধ এলাকায় বিআইডব্লিউটিএর প্রায় এক বিঘা জমি দখল করে বানিয়েছেন এমটিসি ক্রোকারিজ মার্কেট। অবৈধভাবে নদীর জমি দখল করে মার্কেটটি বানানোর কারণে বিআইডব্লিউটিএ একাধিকবার উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে সেটি ভেঙে দেয়। ভেঙে দেওয়ার কয়েক দিন পরই আবার আরও শক্তপোক্ত মার্কেট তৈরি করে ফেলেন হাজী সেলিম।
আরমানিটোলাতে ঢাকা ওয়াসার মালিকানাধীন প্রায় ১০ কাঠা জায়গায় একটি পানির পাম্প ও ট্যাঙ্ক ছিল। ২০১০ সালে সেই জায়গাটি দখল করে হাজী সেলিম বানিয়েছেন ‘এমটিসি টাওয়ার’। ১৫ তলা ভবনটির নিচতলা কমার্শিয়াল।
নলগোলাতে প্রায় ১০ কাঠা খাস জমির ওপর বিহারিরা ঘরবাড়ি বানিয়ে বসবাস করত। হাজী সেলিম বিহারিদের উচ্ছেদ করে সেখানে বানিয়েছেন ‘হাজী সেলিম টাওয়ার’।
ইমামগঞ্জে নিরীহ কয়েকজনের জমি দখল করে হাজী সেলিম ছেলের নামে তৈরি করছেন ‘ইরফান টাওয়ার’। জমির মালিকদের সঙ্গে মামলাজনিত কারণে এর আগে কয়েকবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গিয়ে সেটার কাজ বন্ধ করে দেয়। কিছুদিন পর আবারও কাজ শুরু করেন। এভাবে সেখানে ১০ তলা পর্যন্ত অবকাঠামো তুলে ফেলেছেন।
বছর পাঁচেক আগে এক ঈদের ছুটির মধ্যে হেরিটেজ তালিকাভুক্ত চকবাজারের ‘জাহাজ বিল্ডিং’টি দখল করে ভাঙা শুরু করেন হাজী সেলিম। দু’দিনের মধ্যে ভবনটি নিশ্চিহ্ন করে ফেলেন। সেখানে এখন ১১ তলা ‘সোলায়মান টাওয়ার’।
এভাবে চকবাজার এলাকায় কয়েকজন নিরীহ মানুষের প্রায় দেড় বিঘা জমি দখল করে বানিয়ছেনে আশিক টাওয়ার।
জেলখানা রোডের চুড়িপট্টির দোকান দখল করে হাজী সেলিম নিজের নামে বানিয়েছেন ‘হাজী সেলিম টাওয়ার’। এক সময় বিএনপি নেতা বরকত উল্লাহ বুলুর সঙ্গে প্রায় ১০ কাঠা আয়তনের ওই জায়গা নিয়ে ঝামেলা ছিল। ২০০৯ সালের পর বুলুকে আর ওই এলাকায় ঘেঁষতে দেননি হাজী সেলিম।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে লালবাগের কামালবাগের চাঁদনীঘাট এলাকায় বধির স্কুল স্থাপনের জন্য প্রায় দুই বিঘা জায়গা বরাদ্দ দেয় সরকার। কিন্তু সেখানে আর বধির স্কুল তৈরি হয়নি। হাজী সেলিম সেই জায়গা দখল করে বানিয়েছেন ‘মদিনা ফিলিং স্টেশন’।
কামরাঙ্গীরচরের বেড়িবাঁধের লোহারপুলের পাশে বিআইডব্লিউটিএর দেড় বিঘা জায়গা দখল করে বানিয়েছেন লোহার মার্কেট।
সোয়ারীঘাট এলাকায় বিআইডব্লিউটিএর ৫ কাঠা জায়গা দখল করে বানিয়েছেন নিজের কোম্পানি মদিনা ট্যাঙ্কের সেলস সেন্টার।
samakal