সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ জাতীয় সংসদে সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা যখন তুলে ধরছিলেন, তখন ভাবছিলাম, উপস্থিত সাংসদদের মধ্যে এর প্রতিক্রিয়া কী রকম হতে পারে? অন্য অঞ্চলের মানুষ কি আসলেই উপলব্ধি করতে পারবে কী করুণ দশার মুখোমুখি হয় বোরো ফসলের ওপর নির্ভরশীল হাওরাঞ্চলের মানুষ? সাংসদের হাতে ছিল সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যান, যা হাওরাঞ্চলের মানুষের জন্য তো বটেই, গোটা দেশের জন্যও অপূরণীয়।
মনে পড়েছে, ২০১৭ সালের ভয়াবহ বন্যায় সব কটি হাওর তলিয়ে গেলে প্রথম আলো যে গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে, তাতে এই সাংসদই বলেছিলেন, ‘প্রতিটি হাওরের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে, নিজস্ব চরিত্র আছে। একেকটি হাওর একেক রকম। তাই ঢাকায় বসে পরিকল্পনা করলে হবে না। পরিকল্পনা করতে হবে মাঠে এসে, হাওরপারের মানুষকে নিয়ে। না হলে কোনো উদ্যোগই সফল হবে না।’
সেই গোলটেবিল বৈঠক আরও কিছু সুপারিশ করেছিল—হাওরের অর্থনীতিকে মূলধারায় নিয়ে আসা, শিশুশিক্ষায় গুরুত্ব দেওয়া, বাঁধ নির্মাণের দুর্নীতিতে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করা, হাওরের ফসল রক্ষায় হাওরাঞ্চলের মানুষকে যুক্ত করা এবং নদীতে পানির ধারণক্ষমতা বাড়ানো। সুপারিশগুলো নিঃসন্দেহে বাস্তবসম্মত। এখন ২০২২ সালে হাওরাঞ্চল যখন আবারও বিপর্যস্ত, তখন যেকোনো নাগরিকের মনে এ প্রশ্ন জাগা সংগত যে পাঁচ বছরের মধ্যে সেই সুপারিশগুলোর কয়টা বাস্তবায়ন করা হলো?
সার্বিক শিক্ষাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি হয়তো হয়েছে, কিন্তু বাকি সুপারিশগুলো তো এখনো সুপারিশ পর্যায়েই রয়ে গেছে। এর কারণ, ভুক্তভোগীরা ছাড়া কেউই উপলব্ধি করতে পারছে না কী কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হয় সেই অঞ্চলের মানুষ। যখন বাঁধ ভাঙতে শুরু করে, তখন ঘরে যার যা কিছু আছে, তা দিয়ে সেই বাঁধ আটকানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে সবাই। যখন শিলাবৃষ্টি শুরু হয়, পাহাড়ি ঢল চোখের সামনে ভাসিয়ে নিয়ে যায় খেতের পর খেত, তখন উপায়ান্তর না দেখে কৃষকেরা এ যুগেও ভয়ে পাগলের মতো তান্ত্রিক হিরালীদের ডেকে আনতে বাধ্য হন।
মোহাম্মদ সাদিকের ভাষায়, ‘তাদের বিশ্বাস হিরালী মন্ত্র পড়ে এই ঝড় ও শিলাবৃষ্টির গতিপথ বদলে দিতে পারে। হাঁক দিয়ে হাওরের বুক বরাবর ছুটে যায়। বিবস্ত্র-নগ্ন। মন্ত্র পড়ছে সে।’ শাহ আবদুল করিম ভাটির চিঠিতে লিখেছিলেন: ‘জল নামে রাস্তায় কোনো বাধাবিঘ্ন নাই।/ প্রচুর মাটি নেমে আসে চোখে দেখতে পাই।/ পাহাড়ি জল নিচে নেমে নদীপথে চলে/ এলাকা প্লাবিত হয় অকালবন্যার জলে।’
যতবারই এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়, অর্থাৎ বিপর্যয় আসার পর, সরকার নানাভাবে সহযোগিতার চেষ্টা চালায়। এই তাৎক্ষণিক চেষ্টায় তখন কোনো ত্রুটি থাকে না। কিন্তু তাৎক্ষণিক চেষ্টাটাই কি সমস্যার সমাধান? ২০১৭ সালের গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনায় প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন, দুর্যোগ চলাকালে সরকার যে দুর্গত মানুষের পাশাপাশি এসে দাঁড়ায়, সেই দাঁড়ানোটা ‘যথেষ্ট’ নয়। কেন যথেষ্ট নয়, তার সবিস্তার আলোচনা সেখানে ছিল। তারপর আরও পাঁচ বছর পার হয়ে গেলেও সেই আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা এখনো তো আছেই, সেই সঙ্গে আজ স্পষ্টভাবে এ কথাও বলার সময় এসেছে, দুর্যোগ এলেই শুধু হাওরাঞ্চলের মানুষের কথা ভাবলে চলবে না, হাওরের সমস্যাকে জাতীয় সমস্যার অন্তর্ভুক্ত করে স্থায়ী সমাধানের কথা ভাবতে হবে।
এবারও বাঁধ ভাঙার নেপথ্যে বারবার বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে দুর্নীতির প্রসঙ্গটি উঠে আসছে। এটা কি নতুন কোনো কথা? হাওরাঞ্চলের বাঁধ নির্মাণের দুর্নীতির প্রসঙ্গ ২০১৭ সালেও উঠেছিল। আগেও উঠেছে। আমরা দেখি, মানুষের বদল হয়, ঠিকাদার বদলায়, কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় না। এর কারণ, যারা দুর্নীতিতে জড়িত, তাদের দৃষ্টান্তযোগ্য শাস্তি হয় না। আমরা খুব বড় গলায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের কথা বলি, কিন্তু দুর্নীতিকাণ্ডের বিচারবহির্ভূত পরিবর্তনের কথাটি বলি না। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই দরকার দৃষ্টান্তমূলক বিচার। এরপর ভবিষ্যতে যে যে জায়গায় বাঁধ নির্মাণ বা বাঁধ সংস্কার জরুরি, সেই কাজ যাদের ওপরই পড়ুক, তাদের সঙ্গে স্থানীয় প্রতিনিধি, গ্রাম প্রতিনিধিসহ অভিজ্ঞ কৃষকদের যুক্ত করে এর সমাধান করলে সে উদ্যোগ সফলভাবে বাস্তবায়িত হতে পারে।
এর আরেকটি দিক হলো প্রাকৃতিক, যা অতিবৃষ্টির কারণে সৃষ্টি হয়। অতিবৃষ্টিজনিত পানি নদী, খাল, বিল ধারণ করতে পারে না বলেই বাঁধবিপর্যয় ঘটে। এর জন্য এবারও নদী খননের কথা উঠছে। এটাও নতুন কোনো দাবি নয়। দীর্ঘদিন ধরে উঠছে। শাহ আবদুল করিম কত আগে স্পষ্টভাবেই বলেছিলেন, ‘বন্যানিয়ন্ত্রণ করা হলো মূল কারণ/ নদী খনন না হলে তা হবে না বারণ।’ তিনি অবশ্য সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর তীর উঁচু করে বাঁধতে বলেছিলেন, যাতে পানি কোনোভাবেই নদীর বাইরে না আসতে পারে। বলেছিলেন, বৃষ্টির পানি যাতে কোথাও বাধা না পেয়ে নিচে নেমে যেতে পারে, তার জন্য সব রাস্তা খুলে দেওয়া দরকার। এ ছাড়া তিনি স্লুইসগেট নির্মাণসহ আরও কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন, যা পরবর্তী সময়ে কিছুটা বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু আজও নদী খননের কাজটি বাস্তবায়িত হয়নি। সব স্তরের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি সত্ত্বেও এই বিষয় যে কেন আজও গুরুত্ব পাচ্ছে না, এ প্রশ্ন শুধু হাওরবাসীর নয়, অন্য অঞ্চলের সচেতন মানুষেরও।
এর বাইরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বোরো ধান রক্ষার আরেকটি পরিকল্পনা এখনই হাতে নেওয়া প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে দ্রুত ফলনশীল ধান উৎপাদন। এ বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করেছেন বিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরী। তিনি ইতিমধ্যে একবার রোপণ করা গাছে বোরো মৌসুমেই পাঁচবার ধান ফলাতে সক্ষম হয়েছেন।
দীর্ঘদিন ধরে একই পদ্ধতিতে চাষ করে অভ্যস্ত আমাদের কৃষকেরা হয়তো সহজেই তা গ্রহণ করবেন না, আমাদের কৃষি বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউও তো কোনো রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই আবেদ চৌধুরীকে ‘জিনবিজ্ঞানী’ বলে সসম্মান এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কৃষকদের বুঝিয়ে তাঁদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করে ঝড়বৃষ্টির সময়ের আগেই যদি ‘বৈশাখী ধান’ বলে খ্যাত বোরো ধানকে ‘ফাল্গুনি ধান’-এ পরিণত করা যায়, তাহলে সবচেয়ে বড় উপকার তো দরিদ্র কৃষকদেরই হয়।
একসময় অনেক কিছুই গ্রহণ করতে চাইতেন না আমাদের কৃষক, কিন্তু পরে অনেক কিছুই তাঁরা গ্রহণ করেছেন। আমাদের ধারণা, লাভ দেখলে এই নতুন ফলনপ্রক্রিয়াও তাঁরা গ্রহণ করবেন। এর জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা যা বলে, বিষয়টি যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে উচ্চমহলকেই প্রথমে এই উদ্যোগ নিতে হবে, না হলে সংশ্লিষ্ট মহল এতে ভালো কিছু দেখার বদলে শুধু ত্রুটিই খুঁজে পাবে!
শুরুতে বলা হয়েছে, প্রতিটি হাওরের চরিত্র আলাদা, তাই ছোট-বড় ১৪২টি হাওরের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে স্থায়ী সমাধানে পৌঁছাতে নানামুখী উদ্যোগ দরকার। হাওরাঞ্চলে প্রকৃত প্রতিনিধি শাহ আবদুল করিম ভাটির চিঠিতে একসময় তাঁর আশঙ্কার কথা বলেছিলেন:
বর্তমান অবস্থায় এবং জ্ঞানী-গুণীর মতে।
এই ভাটি এলাকা এখন সাগর হওয়ার পথে॥
ধারণা করা হয়, ‘সাগর’ থেকেই ‘হাওর’ শব্দের উৎপত্তি, তাই বলে ভাটি এলাকা সাগরে পরিণত হোক, এটা আবদুল করিম যেমন চাইতেন না, তেমনই পরিণতি অন্য কারও কাম্য নয়। এখন মাননীয় মন্ত্রীর পরিকল্পিত মেগা প্রকল্প ‘উড়ালসড়ক’-এ ওঠার আগেই হাওরের মানুষের জীবন যাতে বারবার বিপন্ন না হয়, সেদিকেই আমাদের বিশেষভাবে খেয়াল রাখা দরকার।
মোস্তাক আহমাদ দীন লেখক, গবেষক এবং লিডিং ইউনিভার্সিটির শিক্ষক