হলফনামা যেন নিতান্তই এক আনুষ্ঠানিকতা

ড. বদিউল আলম মজুমদার : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থী প্রদত্ত হলফনামার ভিত্তিতে আমরা প্রতিনিয়ত অনেক প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রকাশ হতে দেখছি। হলফনামায় প্রদত্ত তথ্যের অসংগতির ভিত্তিতে তৈরি এসব প্রতিবেদনের ওপর পাঠকের সব মন্তব্যই নেতিবাচক। আমাদের আশঙ্কা, যে উদ্দেশ্যে আদালত কর্তৃক হলফনামার মাধ্যমে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের তথ্য প্রদানের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল, তা আজ যেন নিতান্তই আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। কারণ, তথ্য গোপনের কারণে হলফনামা ভোটারদের সামনে প্রার্থীদের সঠিক তথ্য তুলে ধরতে এবং তাদের ‘ইনফমর্ড ডিসিশন’ নিতে সহায়তা করতে পারছে না।

প্রার্থীদের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামা আকারে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশা, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের খতিয়ান, আয়ের উৎস, নিজেদের এবং নির্ভরশীলদের সম্পদ ও দায়-দেনার তথ্য প্রকাশের উদ্দেশ্য হলো, ভোটারদের ক্ষমতায়িত করা, যাতে তারা ভোটকেন্দ্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। ভোটারদের এ ধরনের তথ্যভিত্তিক ক্ষমতায়নের গুরুত্ব অপরিসীম। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের মতে: ‘… নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হবে যদি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে ভোটাররা না জানে। তাদের ‘এ’ কিংবা ‘বি’-এর পক্ষে ভোট দেওয়ার কোনো ভিত্তি থাকবে না। এ ধরনের নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না, নিরপেক্ষও হবে না।’ আদালত আরও বলেন, ‘গণতন্ত্র যাতে গুন্ডাতন্ত্র এবং উপহাসে পরিণত না হয়, তা নিশ্চিত করতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য ভোটারদের তথ্য পাওয়া জরুরি।’ [পিইউসিএল বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া (২০০৩) ৪এসসিসি]। তাই হলফনামা প্রার্থীদের জন্য আমলনামার মতো কাজ করার কথা। কারণ, তথ্য গোপনের জন্য মনোনয়নপত্র, এমনকি নির্বাচন বাতিল হওয়ার বিধান আইনে রয়েছে।

কিন্তু উপরোক্ত রায়কে ভন্ডুল করার লক্ষ্যে আবু সাফা নামে এক দুর্বৃত্তের মাধ্যমে জালিয়াতি করে সম্পূর্ণ গোপনে আপিল করা হয়। মামলার মূল বাদীদের আপিলের ব্যাপারে নোটিশ দেওয়া হয়নি; নির্বাচন কমিশনকেও জানানো হয়নি। আপিলকারী ছিলেন একজন তৃতীয় পক্ষ; তৃতীয় পক্ষকে সাধারণত আপিল করতে দেওয়া হয় না। তৎসত্ত্বেও শুনানিতে মূল মামলার বাদীদের অনপুস্থিতিতেই লিভ টু আপিল একতরফাভাবে গৃহীত হয়। এ খবর শোনার পর মূল বাদীদের পক্ষ থেকে ‘কেভিয়েট’ দেওয়া হয়, যাতে পরবর্তী শুনানি তাদের অনপুস্থিতিতে না হয়। কিন্তু ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার মাত্র দু’দিন আগে, আপিল বিভাগের চেম্বার জজ বিচারপতি জয়নুল আবেদীন আবারও একতরফা শুনানির ভিত্তিতে হলফনামা প্রদানের ওপর স্থগিতাদেশ প্রদান করেন। ফলে ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা হলফনামা ছাড়াই মনোনয়নপত্র জমা দেন।

এর পর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন হলে প্রধান বিচারপতি এম রুহুল আমিনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগ আবু সাফাকে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেন, যা তাঁর আইনজীবীরা পালন করতে ব্যর্থ হন। এমনি প্রেক্ষাপটে আদালত ২০০৭ সালের ১১ ডিসেম্বর আপিলটি খারিজ করে দেন এই যুক্তিতে, যেহেতু আপিল আবেদনে একজন কাল্পনিক ব্যক্তির নাম এবং ভুয়া কাগজপত্র ব্যবহার করা হয়েছে, তাই এটি আপিলই হয়নি। এভাবে আদালতের নির্দেশে প্রার্থী সম্পর্কে ভোটারদের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত হয়।

২০০৫ সালে হাইকোর্টের দেওয়া রায়টি ঘোষণার পরপরই আমরা সুজনের পক্ষ থেকে এটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিই। এ লক্ষ্যে হলফনামার তথ্য সন্নিবেশিত করে প্রার্থীদের সম্পর্কে তুলনামূলক চিত্র তৈরি করে ভোটারদের মধ্যে বিতরণ করি। একই সঙ্গে ‘ভোটার-প্রার্থী মুখোমুখি অনুষ্ঠান’-এর আয়োজন করি। সুজনের অব্যাহত প্রচেষ্টা এবং গণমাধ্যমের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন অ্যাডভোকেসির ফলে এখন ভোটারদের তথ্যভিত্তিক ক্ষমতায়নের আমাদের শুরু করা কাজটি অনেকে, বিশেষত গণমাধ্যম স্ব-উদ্যোগে করছে।

আমরা মনে করি, আমাদের নির্বাচনী অঙ্গন তথা রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করতে হলে হলফনামা প্রদানের বিধান একটি অতি কার্যকর হাতিয়ার হতে পারে। এ জন্য নির্বাচন কমিশনকে একাধিক উদ্যোগ নিতে হবে। প্রথমত, হলফনামার ছকে গুরুতর সীমাবদ্ধতার কারণে প্রার্থীদের তথ্য গোপন করার সুযোগ রয়ে গেছে। যেমন– ছকটিতে প্রার্থীদের ‘প্রা ইভেন্ট ইন্টারেস্ট’ ও আয়ের বিস্তারিত উৎস প্রদর্শনের বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে। অনেকে হলফনামায় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মূল্য উল্লেখ করেন না। যার ফলে প্রার্থীর মোট সম্পদের পরিমাণ নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। আইন অনুযায়ী, সম্পদের ক্ষেত্রে প্রার্থীরা অর্জনকালীন মূল্য উল্লেখ করেন। তাই প্রকৃত ও পরিপূর্ণ তথ্য পেতে হলে ভবিষ্যতে হলফনামার ছকটিতে পরিবর্তন আনতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিরুদ্ধ হলফনামা প্রদানের বিধান সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। তৃতীয়ত, হলফনামার তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখতে হবে এবং মিথ্যা তথ্য প্রদানকারী (যেমন– মৎস্যজীবী, রাজনীতিবিদ) ও তথ্য গোপনকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুততার সঙ্গে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। যাচাই-বাছাইয়ে কমিশন চাইলে এনবিআর ও দুদকের সহায়তা নিতে পারে। প্রসঙ্গত, হলফ করে মিথ্যা তথ্য দেওয়া ফৌজদারি অপরাধও বটে।

হলফনামার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা পরিলক্ষিত হয়েছে। তা হলো, ওয়েবসাইটে অনেক দেরিতে তথ্য দেওয়া, সব আসনের পরিপূর্ণ তথ্য না থাকা, কোনো আসনের তথ্য দেওয়া থাকলেও সব প্রার্থীর তথ্য না থাকা, দলভিত্তিক পরিচয়-সংবলিত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ না করা, এক প্রার্থীর জায়গায় অন্য প্রার্থীর তথ্য থাকা, আয়কর রিটার্ন জমা না দেওয়া, কিংবা শুধু আয়কর প্রত্যয়নপত্র জমাদান ইত্যাদি। আশা করি, কমিশন এসব সমস্যা সমাধানেও আন্তরিক হবে।

আমাদের দেশে বেশ কিছুদিন থেকেই অনেক অরাজনৈতিক ব্যক্তি, বিশেষত ব্যবসায়ীকে রাজনৈতিক অঙ্গনে উড়ে এসে জুড়ে বসতে দেখা যায়। মূলত রাজনীতিতে আগন্তুক এসব ব্যক্তিই সাধারণত হলফনামায় তথ্য গোপন করেন। কিন্তু হলফনামায় তথ্য গোপন করলে সংসদ সদস্য হওয়া যায় না এবং থাকাও যায় না। তাই নির্বাচন কমিশন কর্তৃক হলফনামার তথ্য খতিয়ে দেখা হলে অনেক বসন্তের কোকিল ও অবাঞ্ছিত ব্যক্তিকেই নির্বাচনী অঙ্গন থেকে দূরে রাখা যাবে।

পরিশেষে, নিঃসন্দেহে প্রার্থীদের পক্ষে ভোটারদের অবগতির জন্য তথ্য প্রকাশের বিধানটি ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। কিন্তু প্রার্থীরা তথ্য গোপন করলে বা ভুল তথ্য দিলে ভোটাররা বিভ্রান্ত, এমনকি তথ্য প্রদানের উদ্দেশ্যই ভন্ডুল হয়। তাই যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই করার মাধ্যমে কমিশনের তথ্যগুলোর সঠিকতা নিশ্চিত করা এবং এগুলোর বিতরণে পদক্ষেপ নেওয়া আবশ্যক।

ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক,
সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক

সমকাল