হঠাৎ করে শেখ হাসিনা কেন ‘র’-এর সমালোচনায় মুখর
-
২২ মার্চ ২০১৭
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হঠাৎ করেই ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ এন্ড এনালাইসিস উইং বা ‘র’- এর সমালোচনায় মুখর হয়েছেন।
গত এক সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যে একাধিকবার ‘র’-এর সমালোচনা এসেছে। তবে ‘র’-এর সাম্প্রতিক কোন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেননি। ১৬ বছর আগের প্রসঙ্গ তুলেছেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেছেন, ২০০১ সালে ভারতের কাছে গ্যাস বিক্রির প্রতিজ্ঞা করে বিএনপি ক্ষমতায় এসেছিল। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে শেখ হাসিনা যখন ভারত সফরে যাচ্ছেন, তার আগে এ ধরনের বক্তব্যে অনেকেই খানিকটা বিস্মিত। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের সবচেয়ে ‘বিশ্বস্ত বন্ধু’ হিসেবে অনেকের কাছেই পরিচিতি। গত আট বছরে বিষয়টি অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গেছে বলে অনেকে মনে করেন।
কিন্তু হঠাৎ করে তিনি কেন ‘র’-এর সমালোচনার মুখর হলেন? এনিয়ে নানা বিশ্লেষণ এবং অনুমান আছে।
আরও পড়ুন: লন্ডনে হামলা ইসলামপন্থীদের কাজ: পুলিশ
সন্ত্রাসের কাছে ব্রিটেন হার মানবে না: টেরিজা মে
তওবা টিভিতে ইসলামী অনুষ্ঠানের সময় পর্ন প্রচার
ভারতের সাংবাদিক এবং বিশ্লেষক সুবীর ভৌমিক মনে করেন, এ ধরনের বক্তব্যের মাধ্যমে শেখ হাসিনা ভারতের বিজেপি সরকারকে একটি ‘বার্তা’ দিতে চাইছেন। কারণ ১৯৯৮ সালে ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সম্পর্ক খানিকটা শীতল হয়ে পড়েছিল।
ভারতের তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রজেশ মিশ্রের একটি উক্তি স্মরণ করিয়ে দিয়ে সুবীর ভৌমিক বলেন, ” ব্রজেশ মিশ্র বলেছিলেন, আমরা এক ঝুড়িতে সব ডিম রাখবো না। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের সাথে ভালো সম্পর্ক আছে কিন্তু অন্য দলের সাথেও ভালো সম্পর্ক তৈরি করবে।”
স্বাভাবিকভাবেই বিএনপি’র সাথে একটি যোগাযোগ গড়ে উঠে তৎকালীন বিজেপি সরকারের। মি: ভৌমিকের বলেন, এক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা রাখে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর তৎকালীন একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হয়তো সে বিষয়টি মাথায় রেখেছেন বলেই ধারণা করছেন মি: ভৌমিক।
তিনি বলেন , বিজেপি আগের বার ক্ষমতায় থাকার সময় যেহেতু এ ধরনের একটা ঘটনা ঘটেছে সেটা নিয়ে শেখ হাসিনার হয়তো কোন চিন্তা রয়েছে। তাছাড়া বর্তমানে বিজেপি নেতৃত্বের একটি অংশ মনে করেন, শেখ হাসিনা চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন এটা ভারতের জন্য সমস্যা হতে পারে।
মি: ভৌমিক বলেন, ” এ ধরনের একটা ক্ষেত্র তৈরি হয়তো হয়েছে। একটা ভয়ের জায়গা হয়তো তৈরি হয়েছে যে ভারত যদি অন্য কিছু করে ফেলে। তো তাই জন্য উনি (শেখ হাসিনা) হয়তো সিগন্যালটা দিতে চাইছেন যে ২০০১’র ভুলটা করো না। কারণ ২০০১’র পর তোমাদের (ভারতের) যে অভিজ্ঞতা হয়েছে সেটার কথা মাথায় রেখে ঔ ধরনের কিছু করো না।”
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতের সাথে সম্পর্ক বেশ ভালোই যাচ্ছে। বাংলাদেশে ২০১৪ সালে একতরফা জাতীয় নির্বাচনে ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থন নিয়েও বাংলাদেশের ভেতরে সমালোচনা রয়েছে। আওয়ামী লীগে বিরোধীরা মনে করেন, গত আট বছরে আওয়ামী লীগ সরকার সর্বাত্নকভাবে ভারতের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ‘র’-এর অতীত কর্মকাণ্ডের সমালোচনার মাধ্যমে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেখাতে চান যে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপিও অতীতে ভারতের সহায়তা নিয়েছিল। কারণ বাংলাদেশের অনেক নাগরিকের মাঝেই ভারত-বিরোধী মনোভাব দেখা যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল ধারনা করছেন ভারত সফরের আগে শেখ হাসিনার এ ধরনের বক্তব্যের বাড়তি মাত্রা রয়েছে। কারণ শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরে প্রতিরক্ষা চুক্তি অথবা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হবার কথা রয়েছে। এনিয়ে সরকার বিরোধীরা সমালোচনায় মুখর।
কিন্তু বাংলাদেশের দিক থেকে বহুল প্রত্যাশিত তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি অধরাই থেকে যাচ্ছে। সমালোচনা রয়েছে গত আট বছরে ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে যা চেয়েছে তার সবকিছুই পেয়েছে।
আসিফ নজরুল বলেন, ” ভারতের কাছ থেকে তিনি ( শেখ হাসিনা) যদি কিছু আদায় করতে না পারেন, তখন ওনার যে ইমেজটা হবে যে ভারতের কাছে সব সমর্পণ করে দিয়ে আসেন উনি। সে সমালোচনার একটা কাউন্টার (বিপরীত) পরিবেশ তিনি আগে থেকেই তৈরি করে রাখলেন। ”
শেখ হাসিনার তরফ থেকে বিএনপি’র বিরুদ্ধে ভারতের কাছে গ্যাস বিক্রির প্রতিশ্রুতি দেবার অভিযোগে আনা হলেও, ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতাসীন হবার পর ভারতের কাছে গ্যাস বিক্রি তো দূরের কথা উল্টো ভারতের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
মি: ভৌমিক বলছেন, “ভারত-বিরোধী জঙ্গিদের তৎপরতা খালেদা জিয়া সরকারের আমলে যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে ভারতরে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ঘুম ভেঙেছে। তারা যে প্রত্যাশাটা তারেক (তারেক রহমান) এবং বেগম জিয়ার কাছে করেছিল, সেটা মাঠে মারা গেছে।”
কিন্তু শেখ হাসিনা সরকার ২০০৯ সালে আবারো ক্ষমতাসীন হবার পর ভারতের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে। ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাংলাদেশে আশ্রয় না দেয়া, ভারতকে ট্রানজিট এবং ট্রান্সশিপমেন্ট দেয়াসহ নানা বিষয়ে গত আট বছরেই ভারত সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে বলে মি: ভৌমিক মনে করেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্ক এখন যে মাত্রায় আছে সেটি শেখ হাসিনার মাঠের বক্তৃতার মাধ্যমে তার উপর কোন প্রভাব পড়বে না । কারণ অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় আওয়ামী লীগের সাথে ভারতের সম্পর্ক অনেক বেশি গভীরে।
আসিফ নজরুল বলেন, ” ওনার (শেখ হাসিনার) সাথে ভারতের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের এতোই ভালো সম্পর্ক যে ‘র’ একটু সমালোচনা করলে ওনার কিছুই আসে যায় না । এ ব্যাপারে উনি (শেখ হাসিনা) কনফিডেন্ট (আত্মবিশ্বাসী)। ওনার ভালো করেই জানা আছে, ভারতের কাছে কখনোই আওয়ামী লীগের তুলনায় অন্য কোন বেটার (অধিকতর) বিকল্প নাই।”
আওয়ামী লীগের কয়েকজন সিনিয়র নেতার সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাইলে তারা জানালেন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের উপর তাদের কোন বিশ্লেষণ বা অনুমান করা ঠিক হবে না। ২০০১ সালের নির্বাচন এবং ‘র’ ভূমিকার বিষয়টিকে তারা এখন অতীত হিসেবেই দেখছেন।