হঠাৎ করে দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গ উঠলো কেন?

  • নয়া দিগন্ত অনলাইন
  •  ১৪ অক্টোবর ২০২২, ২০:৪৬
২০২৩ সালে সম্ভাব্য খাদ্য ঘাটতির আশংকায় এখনই নানা ধরনের সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হচ্ছে। – ছবি : সংগৃহীত

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তার বিভিন্ন বক্তব্যে দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনার কথা বলছেন।

বৈশ্বিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গ টেনেছেন। শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশে যাতে এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয় সেজন্য এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে।

গত বৃহস্পতিবার সেনাবাহিনীর এক অনুষ্ঠানে দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গটি আবারো উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ যাতে দুর্ভিক্ষের শিকার না হয় সেজন্য খাদ্য উৎপাদনের জন্য প্রতি ইঞ্চি জমি উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করতে হবে।

প্রশ্ন হচ্ছে, শেখ হাসিনা কি নিজে থেকেই দুর্ভিক্ষের কথা বলছেন নাকি সত্যিই দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে?

কেন দুর্ভিক্ষের কথা হচ্ছে?
বিশ্বজুড়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ যখন দিশেহারা তখন আরো খারাপ খবরের আভাস মিলছে।

২০২৩ সালে সম্ভাব্য খাদ্য ঘাটতির আশংকায় এখনই নানা ধরনের সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হচ্ছে।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোতেও খাদ্য সংকট জোরালো হবার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এরই মধ্যে সতর্ক করে বলেছে যে ২০২৩ সালে বিশ্বের ৪৫টি দেশে তীব্র খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এবং ২০ কোটি মানুষের জন্য জরুরি সহায়তার প্রয়োজন হতে পারে।

এফএও এবং ডব্লিউএফপির যৌথ রিপোর্টে বলা হয়েছে, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে দুর্ভিক্ষের আশংকা প্রবল।

এগুলোর মধ্যে রয়েছে ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া, সোমালিয়া ও সাউথ সুদান। এছাড়া ইয়েমেন ও আফগানিস্তানেরও একই দশা।

এর পাশাপাশি এশিয়া ও আফ্রিকার আরো কিছু দেশ আছে যেখানে তীব্র খাদ্য ঘাটতি হতে পারে বলেও রিপোর্টে উঠে এসেছে।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বেসলে সম্প্রতি এক বক্তব্যে বিশ্বজুড়ে খাদ্য ঘাটতির আশংকা প্রকাশ করেছেন। এজন্য তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অস্থিরতা ও যুদ্ধ-বিগ্রহকে দায়ী করেছেন।

তিনি বলেছেন, পৃথিবীর ৪৫টি দেশ এখন ‘দুর্ভিক্ষের দরজায় কড়া’ নাড়ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন রিলেশন্স কমিটির সামনে এক বক্তব্যে ডব্লিউএফপি নির্বাহী পরিচালক বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে এবং এর একটি বড় কারণ হবে যুদ্ধ এবং সারের সংকট।

‘এটা এমন এক ধরনের সংকট হতে যাচ্ছে যা আমরা জীবদ্দশায় দেখিনি,’ বলেন বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রধান।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক তাদের রিপোর্টে বলেছে, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সারের ব্যাপক সংকট তৈরি হয়েছে।

এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে আফ্রিকা মহাদেশে খাদ্য উৎপাদন ২০ শতাংশ কমে যাবে।

চলতি বছরের জুন মাসে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস সতর্ক করে বলেছেন, ২০২২ সালে কয়েকটি দুর্ভিক্ষ ঘোষণার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে এবং ২০২৩ সালে সেটি আরো খারাপ হতে পারে।

বিশ্বজুড়ে খাদ্যমূল্য কিছুটা কমেছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে সংকট শেষ হয়ে যাচ্ছে।

যেসব কারণে খাদ্যদ্রব্যের ঊর্ধ্বগতি হয়েছে সেগুলো এখনো বিদ্যমান আছে।

কেন এই অবস্থা?
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি এবং জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থা যে যৌথ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সেখানে কয়েকটি কারণ তুলে ধরা হয়েছে।

১. যুদ্ধ ও নানাবিধ সংঘাত খাদ্য ঘাটতির জন্য একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

পৃথিবীতে যত মানুষ খাদ্য সংকটে ভুগছে তার মধ্যে ৬০ শতাংশ বসবাস করে যুদ্ধ-বিগ্রহকবলিত এলাকায়।

ইউক্রেন যুদ্ধ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে যুদ্ধের কারণে খাদ্য ঘাটতি কতটা খারাপ হতে পারে। এই যুদ্ধ চলতে থাকলে পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে।

২. দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, জলবায়ুজনিত। পৃথিবীর অনেক দেশ হয়তো বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে, নয়তো খরায় ভুগছে।

এর ফলেও খাদ্য উৎপাদন ব্যহত হবার আশংকা রয়েছে।

৩. করোনাভাইরাস মহামারী বিশ্ব অর্থনীতিতে যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে সেটি এখনো কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়নি।

৪. জীবনযাত্রার ব্যয় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টিও খাদ্য ঘাটতির কারণ হতে পারে।

খাদ্যদ্রব্যের দাম যে হারে বাড়ছে তাতে অনেকের জন্য খাদ্য কেনা কঠিন হয়ে যাবে।

যেমন বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ২০১৯ সালের তুলনায় এখন তাদের পরিচালনা ব্যয় যতটা বেড়েছে সেটি দিয়ে তারা প্রতিমাসে ৪০ লাখ মানুষকে খাওয়াতে পারতো।

খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়ার যে আশংকা করা হচ্ছে, তার পেছনে আরেকটি কারণ হচ্ছে কৃষি উৎপাদনের জন্য সার ও ডিজেলের মতো উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়া।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রধান অর্থনীতিবিদ আরিফ হুসেইন ফিনান্সিয়াল টাইমস পত্রিকাকে বলেন, এখন সারের দাম বেশি এবং অনেকে কিনতে পারছেন না। এ বিষয়ে নজর দেয়া না হলে আগামী বছর সার পাওয়াই যাবে না।

কৃষ্ণ সাগর দিয়ে ইউক্রেনের খাদ্যশস্য বিশ্ববাজারে রফতানির জন্য গত জুলাই মাসে জাতিসঙ্ঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চুক্তি হয়েছে।

কিন্তু রাশিয়া অভিযোগ করছে তারা তাদের শস্য ও সার বিশ্ববাজারে রফতানি করতে পারছে না। এটা অব্যাহত থাকলে এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে রাশিয়া।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে, খাদ্য ও সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ৪৮টি দেশকে অতিরিক্ত ৯ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হবে।

বাংলাদেশের কী হবে?
বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, দুর্ভিক্ষ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে আশংকা প্রকাশ করেছেন সেটি একেবারে অমূলক নয়।

তিনি বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ খাদ্য রফতানি বন্ধ করেছে কিংবা রফতানি নিরুৎসাহিত করার জন্য শুল্ক আরোপ করেছে। বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকট দেখা দিলে বিভিন্ন দেশ রফতানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরো জোরালো করতে পারে।

‘সেজন্য প্রধানমন্ত্রী আগে থেকেই উৎপাদন বাড়ানোর যে কথা বলছেন সেটি বাস্তবসম্মত। কারণ, খাদ্যের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারের উপর নির্ভর করা ঠিক হবে না,’ বলেন জাহিদ হোসেন।

তিনি বলেন, খাদ্য সংকট দেখা দিলেই দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি হওয়ার জোরালো সম্ভাবনা তৈরি হয়।

খাদ্যমূল্য যদি অনেক বেড়ে যায় তখন দরিদ্র মানুষ খাবার কিনতে পারে না। লাগামছাড়া মূল্যস্ফীতি দরিদ্র মানুষের জন্য বড় ধরনের সংকট তৈরি করেছে বাংলাদেশে।

ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশে এবার বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় আমন ধানের ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেটি এখনো বলা যাচ্ছে না। অন্যদিকে বিশ্ববাজারেও খাদ্যের সংকট আছে।

এ দুটো পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য নাজুক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।

জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ যদি উৎপাদন বাড়াতে পারে এবং দরিদ্র মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিতে পারে তাহলে দেশটি পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে।

তবে আগামী বছরে যদি প্রতিকূল আবহাওয়া থাকে এবং বিশ্ববাজারে সংকট অব্যাহত থাকে তাহলে বাংলাদেশের জন্যও কঠিন সময়ে আসছে বলে অনেকে মনে করেন।

সূত্র : বিবিসি