স্মৃতিতে জেনারেল ওসমানী

ইব্রাহীম চৌধুরী খোকন

(১ ঘন্টা আগে) ২১ আগস্ট ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ৯:৪৯ পূর্বাহ্ন

mzamin

facebook sharing button

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে এমন কিছু নাম আছে, যা কোনোদিন বিস্মৃত হয় না। সেইসব নামের শীর্ষে আছেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সমরনায়ক, সিলেটের সন্তান জেনারেল এম এ জি ওসমানী। তাঁর জীবন, ত্যাগ, নেতৃত্ব ও সাহস আজও প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর। দেশ তখন স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে। শত্রু সেনারা আত্মসমর্পণ করছে, আকাশে উড়ছে লাল-সবুজ পতাকা। কিন্তু ঢাকার ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার বদলে ওসমানী ফিরছিলেন হেলিকপ্টারে, সিলেটের আকাশ পথে। হঠাৎই গুলি ছোড়া হলো তাঁর হেলিকপ্টারের দিকে।

জ্বালানির ট্যাংক ফুটো হয়ে ফোয়ারার মতো বেরোতে লাগল অকটেন। মুহূর্তেই অগ্নিকাণ্ডের আশঙ্কা। পাইলট ভীতসন্ত্রস্ত, কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। তখনই ওসমানী অবিশ্বাস্য এক কাজ করলেন—নিজের হাত দিয়ে ট্যাংকের ফুটো বন্ধ করার চেষ্টা। তাঁর হাত পুড়ে যায়।

সঙ্গে ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও বঙ্গবন্ধুর তনয় শেখ কামাল। আতঙ্কিত পাইলটকে শান্ত করে ওসমানী বললেন— “যেখানে আছো, সেখানেই নামো। ম্যাপ দেখতে হবে না, সিলেটকে আমি হাতের তালুর মতো চিনি।”

পাইলট যেন প্রাণ ফিরে পেলেন। হেলিকপ্টার জরুরি অবতরণ করল শমশেরনগরের পুরোনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিত্যক্ত বিমানবন্দরে। মাটি স্পর্শ করতেই যাত্রীরা দ্রুত লাফ দিয়ে বেরিয়ে এলেন। মুহূর্তের মধ্যে হেলিকপ্টারটি বিস্ফোরণে জ্বলে উঠল। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দেশের মাটি প্রথমবার ছুঁয়েছিলেন ওসমানী।

কে বা কারা সেই গুলি ছুঁড়েছিল, আজও অজানা। তদন্ত হয়নি কখনও। ওসমানী নিজেও বলতেন, হয়তো এটি হত্যাচেষ্টা ছিল, তবে তাঁর হাতে প্রমাণ ছিল না।

১৯৮১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন তিনি। সে সময়ও তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ভোটের দুই দিন আগে, ১৩ নভেম্বর রাতে তিনি যাচ্ছিলেন সিলেটের ভাদেশ্বর মোকামবাজারে নির্বাচনী সভায়। তার আগে আমি সহযাত্রী আফছর উদ্দিনকে নিয়ে মোটরসাইকেলে চারখাই থেকে সড়ক রেকি করি। সবকিছু স্বাভাবিক দেখে আগাম দল হিসেবে সভাস্থলে চলে যাই। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটে অঘটন। অন্ধকার সড়কের মাঝখানে আচমকা ফেলে দেওয়া হয়েছিল বিশাল এক গাছের লম্বা গড়ালি। দক্ষ চালক নজরুল ইসলাম প্রাণপণ চেষ্টা করে গাড়ি থামাতে সক্ষম হন। অল্পের জন্য দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পান। প্রাণে বেঁচে যান ওসমানী।

সেদিন রাত ১২টায় তাঁর শেষ নির্বাচনী সভা ছিল। চরম উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনার মধ্যে আমি সভার লোকজনকে সামাল দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছিলাম। রক্তচক্ষুর সামনে কিছু বলতে বা জিজ্ঞেসও করতে পারছিলাম না। ফিসফিস করে বলেছিলেন—
“They wanted to kill me!”

কেন? কে তাঁকে হত্যা করতে চাইছিল? উত্তর আর মেলেনি। থানায় করা সাধারণ ডায়রিটি নিয়ে কোনও তদন্ত হয়নি। আমাদের রাজনীতির নানা বিতর্ক আর নাটকীয় উত্তেজনার মধ্যে এমন একজন সমরনায়কের সম্ভাব্য হত্যাচেষ্টা নিয়ে রাষ্ট্রীয় কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি।

যুদ্ধ শেষে ওসমানী নতুন বাংলাদেশে রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছিলেন না। ব্রিটিশ গণতন্ত্রের একান্ত অনুসারী ছিলেন। রাজনীতির কোন্দল ও সংকীর্ণতায় অসহায় হয়ে পড়েন। মুজিবনগর সরকারের সময় থেকেই তিনি এ দ্বন্দ্ব টের পেয়েছিলেন এবং লড়ছিলেন নিজের মতো করে। নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য দেখাতেন চরমভাবে। এসব নিয়ে মুখে কুলুপ এটে রাখতেন।

বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভায় তিনি প্রথমে প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েন। পরে বাকশাল প্রবর্তনের সময় গণতন্ত্র রক্ষার জন্য সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন তিনিই প্রথম। সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন— “বঙ্গবন্ধু, আপনিই তো আজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন। যে পদক্ষেপ গণতন্ত্রকে হত্যা করবে, আমি আপনার একজন অনুসারী হয়েও তা সমর্থন করতে পারি না।”
তাঁর সাহসী পদক্ষেপের পর আব্দুল্লাহ সরকার, ব্যারিস্টার মঈনুল ইসলাম, নুরুল ইসলাম প্রমুখও পদত্যাগ করেন।

পঁচাত্তরের রক্তাক্ত পরিবর্তনের পরে সামরিক শাসনের সময় স্বল্পকালীন উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ায় তিনি সমালোচিত হন। তবে তিনি ইঙ্গিত দিতেন—দেশের সার্বভৌমত্ব ও সেনাবাহিনীর বিশৃঙ্খলা সামাল দিতে তখন তাঁর সামনে বিকল্প ছিল না। রাষ্ট্র বা সেনাবাহিনীর কোনো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কখনও প্রকাশ্যে কথা বলতেন না।

নিজের কক্ষের দরজা বন্ধ করে দিনের পর দিন টাইপরাইটারে লিখতেন। প্রতিটি পৃষ্ঠার কার্বন কপি নিজ হাতে পুড়িয়ে ফেলতেন। বলতেন—এই পাণ্ডুলিপিতে মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী সময়ের অনেক না বলা কথা আছে। কিন্তু মৃত্যুর পর সেই দলিল কোথায় গেল, আজও অজানা। অনেকেই মনে করেন, সামরিক শাসকের নির্দেশেই তা গায়েব করা হয়েছিল।

ওসমানী ছিলেন এক অনন্য সৈনিক। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন, গণতন্ত্রের প্রশ্নে আপস করেননি। তাঁর সৈনিক জীবন ছিল বিরল—তিনি তিনটি ভিন্ন দেশের সেনাবাহিনীতে যুদ্ধ করেছেন। পৃথিবীর সামরিক ইতিহাসেও এমন দৃষ্টান্ত বিরল। ব্রিটিশের হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে তিনি ভারতীয় বাহিনীর বিপক্ষেও যুদ্ধ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতীয় পক্ষের সাথেও তাঁর টানাপোড়েন ছিল। কিন্তু সমরকৌশল ছিল তাঁরই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সামাল দিয়ে মুক্তির লড়াই চালিয়ে নেওয়া—এ কৃতিত্ব ইতিহাসের পাতায় তাঁরই।

আজও মনে হয়, রাষ্ট্র তাঁকে যথাযথ সম্মান দেয়নি। কে মাঠে ঘোষণা দিয়েছেন, কে রেডিওতে ঘোষণা দিয়েছেন—এসব বিতর্কই আমরা শেষ করতে পারিনি। ওসমানীর কাজকর্ম, তাঁর সমরকৌশল, চাষা-মজুরদের সামান্য ট্রেনিং দিয়ে গেরিলা যুদ্ধের কর্মকাণ্ড নিয়ে আমাদের আলোচনা বা গর্ব করার অবকাশ হয়নি। ওসমানী মুক্তিযুদ্ধে নিজের কৃতিত্ব নিয়ে কখনও কোনো দাবি করেননি, প্রচারও করেননি। তাঁর কোনো পারিবারিক উত্তরাধিকারও নেই। একাকী, নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়েছেন। সংসার নয়, সেনা পেশা আর দেশের জন্যই নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন জীবনভর। মৃত্যুর আগে তাঁর সব সহায়-সম্পত্তি দান করে গেছেন।

স্বাধীন দেশের লাল-সবুজের পতাকার প্রতিটি উড্ডীনে তাঁর বীরত্ব ধ্বনিত হয়। আজকের বাংলাদেশের স্বাধীন নাগরিকরা সে ধ্বনিকে শুনতে পায়?

১ সেপ্টেম্বর, তাঁর জন্মদিন। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি এই মহান বীরকে—বাংলাদেশ নামক দেশের বীর সন্তানকে। আমাদের উর্বর মাটির আগামীর প্রজন্ম যেন তাঁর জীবন থেকে সাহস, সততা, অনুগত্য ও গণতন্ত্রের প্রতি অটল বিশ্বাসের শিক্ষা নেয়।

ইব্রাহীম চৌধুরী খোকন, সম্পাদক, প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা
ibrahim.chowdhury@gmail.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here