- ড. আবদুল লতিফ মাসুম
- ২৭ জানুয়ারি ২০২১
ভিলেজ পলিটিক্স! প্রাচীন আমল থেকে আজ পর্যন্ত বিস্তৃত ইতিহাস ব্যাখ্যা করে এই স্বীকৃতি মেলে যে, রাজা-বাদশাহ ও নেতানেত্রীরা গ্রামকে রাজনীতির একক হিসেবে গ্রহণ করেছেন। ব্রিটিশরা তাদের শাসন-শৃঙ্খলার প্রয়োজনে ক্রমে সংস্কার করেছেন। অন্য দিকে ঔপনিবেশিক যুগের অবসানের পরে শাসক স্বীয় ক্ষমতা ও দলীয় স্বার্থ সংরক্ষণের কেন্দ্রভূমি হিসেবে গ্রামকে গড়তে চেয়েছে। মৌলিক গণতন্ত্র থেকে উন্নয়নের গণতন্ত্র পর্যন্ত সেই উদাহরণ বিস্তৃত করা যায়। গ্রাম সরকার, গ্রাম সভা ও গ্রাম পরিষদ ইত্যাদি নামেও সামরিক ও বেসামরিক শাসকরা ক্ষমতার ভিত শক্ত করতে চেয়েছে। বিস্ময়ের বিষয় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতা বা অগ্রহণযোগ্যতার জন্য গ্রামের মানুষকে বিক্ষোভ, মিটিং, মিছিল ও আন্দোলন কিছুই করতে হয়নি। গ্রামীণ সমাজের অনন্য বৈশিষ্ট্য বা স্বকীয় চরিত্রের কারণে কোনো কৃত্রিম সংস্কার স্থায়িত্ব অর্জন করেনি। আবহমান কাল থেকে গ্রামবাংলা তার নিজস্ব চরিত্র-বৈশিষ্ট্য ধারণ করেই টিকে আছে। যখনই যে শাসক এসেছে গ্রামীণ সমাজ তাকে গ্রহণ করেছে আদেশের মতো। আবার কখনোই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ায়নি তারা। যখন ক্ষমতার শেষ হয়েছে তাদের আনুগত্যেরও ইতি ঘটেছে। তার মানে তারা স্থিতাবস্থা বা স্ট্যাটাস ক্যু মেইনটেইন করে আদর্শিক বা দলীয় স্থায়ী ক্যাডারে পরিণত হয়নি। সন্দেহ নেই এর একটি ক্ষুদ্র অংশ সুবিধা, শঠতা, চতুরতা, প্রতারণা, মিথ্যাচার ও কূটকৌশল ব্যবহার করেছে। কিন্তু বৃহত্তর অংশ সহজ-সরল, সাহসী ও সাবলীল থেকেছে চিরকাল। এই ক্ষুদ্র অংশের কারণে গ্রামের রাজনীতি নেতিবাচকভাবে ‘ভিলেজ পলিটিক্স’ রূপে অভিহিত হয়ে আসছে। এরা এটিকে অন্যের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। বিরোধ জিইয়ে রাখে। সারা দিনই ধান্দা আর ফন্দি ফিকিরে কাটিয়ে দেয়। মামলা-মোকদ্দমা করে বেড়ায়। টাউট পরিচয়ের কারণে সাধারণভাবে এরা মেম্বার বা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয় না। কিন্তু সব কাজের কাজী অথবা পাজি হয়ে বেড়ায়। তাই ‘প্রচলিত গ্রামীণ রাজনীতিকে প্রকৃত অর্থে রাজনীতি না বলে বরং মানুষের সামাজিক সম্পর্ক বা কার্যাদি বা সমাজ জীবনের আন্তঃক্রীড়া বা ইন্টার অ্যাকশন বলে অভিহিত করাই শ্রেয়।’ (আবদুল মান্নান : ২০০৩:১২০)। রাষ্ট্রকেন্দ্রিক বা স্টেটসেন্ট্রিক রাজনীতি বলতে যা বোঝায় গ্রামীণ রাজনীতি তা নয়। সম্পদের বৈধ ও কর্তৃত্বপূর্ণ বণ্টনের নামই যদি হয় রাজনীতি সে রাজনীতির সাথে গ্রামবাংলার ব্যবস্থাপনা বা ইউনিয়ন পরিষদ জড়িত নয়। সুতরাং প্রচলিত রাজনীতি মানে গ্রামীণ রাজনীতি নয়। (এরিক জে. জেনসেন : ১৯৮৭)। আবার প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিটি কাজই যদি রাজনীতি হয় তাহলে গ্রামীণ মানুষের কার্যক্রম রাজনীতি হতে বাধ্য।
সাম্প্রতিককালে রাজনীতি, সম্পদ বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের একটি মোক্ষম উপায় হিসেবে দেখা দিয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, একটি নির্দিষ্ট বলয়ের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা অধিকমাত্রায় গ্রামীণ রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করছেন। একজন বিত্তহীন ব্যক্তি রাজনীতির প্রতি কোনোই আকর্ষণ অনুভব করে না। তবে সাম্প্রতিককালে সরকারের ত্রাণ বা উন্নয়ন কর্মে অংশগ্রহণের কারণে বিত্তহীনরাও রাজনীতির অংশীদার কারণ ঘটছে। গ্রামীণ সমাজের ব্যাপক সংখ্যক মানুষ রাজনীতি বিমুখ বা এ পলিটিক্যাল। তা ছাড়া রাজনীতি ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান হানাহানি, মারামারি তথা সহিংসতা বৃহত্তর গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে রাজনীতির প্রতি নির্বিকার করে তুলছে। তবে সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি, আধিপত্য বিস্তার, নেতৃত্বের আগ্রহ ইত্যাদি কারণে গ্রামীণ সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশ রাজনীতিতে আগ্রহ প্রকাশ করে থাকে। ইদানীং যারা যত বেশি ক্ষমতাসীন রাজনীতির সাথে জড়িত তারা তত বেশি শক্তি, ক্ষমতা ও আধিপত্য প্রদর্শন করছে। এসব গ্রামীণ এলিটরা কোনো আদর্শ বা নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়, কেবল স্বীয় স্বার্থের প্রতি প্রতিশ্রুতিশীল।
অতীতে, নিকট অতীতে কিংবা সাম্প্রতিককালে এ প্রবণতা স্পষ্ট যে, ক্ষমতাসীন সব দলই স্থানীয় সরকারকে তাদের ক্ষমতার স্বার্থে প্রাথমিক ভিত হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছে। ২০১৫ সালে দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ও প্রাতিষ্ঠানিকতাবিরোধী। প্রচলিত ও প্রকাশিত জনমত যে এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানায়নি তা সহজেই বলা যায়। এই নতুন ব্যবস্থায় সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, চিরায়ত গ্রামীণ নির্বাচন ব্যবস্থার অপলোপন। কালো টাকা ও পেশি প্রভাবিত হয়ে পড়েছে স্থানীয় প্রশাসন। একরকম প্রকাশ্যেই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের ভোট প্রদানে বাধ্য করা হয়েছে। তারাই স্লোগান দিয়েছে ‘চেয়ারম্যান ওপেনে, মেম্বার গোপনে’। এর ফলে দলীয় ছত্রছায়ায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যক্তির নামে সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠেছে। ধর্ষণ ও হত্যাসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যে, এই বাহিনী দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে না। এসব বাহিনী স্থানীয় প্রশাসনকে অকার্যকর করে ফেলেছে। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন ও ভিডিও ধারণ করে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় দলীয়করণে গজিয়ে ওঠা দুর্বৃত্ত দল। হাইকোর্ট বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন ও সুপারিশ পেশ করার জন্য একটি কমিটি করে। কমিটি যে দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে তা গ্রামীণ সমাজ কাঠামোতে রূপান্তর প্রশ্নে প্রাসঙ্গিক। কমিটি বলেছে, ‘দলীয়ভাবে স্থানীয় নির্বাচন সনাতন পঞ্চায়েত প্রথাকে বিলুপ্ত করেছে। গ্রামের মুরুব্বিদের যে প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল এবং সামাজিক শৃঙ্খলায় যে ভূমিকা ছিল তা খর্ব হয়ে পড়েছে। দলগতভাবে বিভক্ত সমাজে মুরুব্বিদের প্রভাব আর খাটছে না। ফলে দলীয় ছত্রছায়ায় অস্ত্র, মাদক ও অর্থবলে একশ্রেণীর লোক গ্রামে ত্রাসের রাজত্ব বিস্তার করে সাধারণ মানুষকে বঞ্চনা ও নির্যাতনের মাধ্যমে জিম্মি করে রেখেছে। স্থানীয় সন্ত্রাসী বাহিনী গঠন করে স্বেচ্ছাচারিতার চূড়ান্ত অবস্থা সৃষ্টি করেছে। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত নিয়মিত বাহিনীকেও যেন তারা অবজ্ঞা করছে। প্রকারান্তরে সরকার ও রাষ্ট্রকে ওই সন্ত্রাসী চক্র চ্যালেঞ্জ ছুড়ে রেখেছে। যার অবসান হওয়া উচিত। তাই আমরা মনে করি, নিয়মিত বাহিনীর মাধ্যমে সারা দেশে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করে এ ধরনের সন্ত্রাসী বাহিনী নির্মূল ও দ্রুত বিচারের সম্মুখীন করা এখন সময়ের দাবি।’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ৩০ অক্টোবর ২০২০)। কমিটির সুপারিশের সাথে দ্বিমত করার অবকাশ নেই। সেই সাথে এই উপলব্ধিও দরকার যে, গ্রামীণ রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের অবসান প্রয়োজন। সেই প্রয়োজনে দলীয় পরিচয়ের স্থানীয় সরকার নির্বাচন অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
বাংলাদেশ এমনিতেই ‘ঝগড়াপুর’ বা ঝগড়ার দেশ হিসেবে পরিচিত। স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের দলীয়করণ সেই ঝগড়াকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। অতিসম্প্রতি সমাপ্ত পৌরসভা নির্বাচনে যে রক্তারক্তি, হানাহানি ও হামলা-মামলা হয়েছে তা ওই অপ্রিয় সত্যকে প্রমাণ করে। একটি স্বাভাবিক অবস্থাকে অস্বাভাবিকতা দিয়েছে এই সিদ্ধান্ত। অনেকেই যুক্তি দেন যে, প্রতিবেশী দেশে এবং উন্নত গণতন্ত্রে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত হয়। সুতরাং বাংলাদেশে হলে আপত্তি কী? বাংলাদেশ যে পাশ্চাত্য নয় এটা বুঝতে হবে। সেখানে গণতন্ত্রের শিক্ষা ও দীক্ষা প্রাতিষ্ঠানিকতা পেয়েছে। প্রতিবেশী দেশে বিগত ৭৩ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে নির্বাচন হয়ে আসছে। আমাদের দেশে নির্বাচন অব্যাহতভাবে হয়নি। আমাদের নির্বাচন বারবার ব্যাহত হয়েছে ‘প্রকৌশল’-এর কাছে। তা ছাড়া আমাদের দেশের মানুষজন শিক্ষিত নয়, সচেতনও নয়। বরং হুজুগে বাঙ্গাল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায়, কৃত্রিমভাবে অতিমাত্রিক রাজনীতিপ্রবণ। ইদানীং ‘হাইব্রিড পলিটিশিয়ান’ শব্দটি বেশ জনপ্রিয়। দলীয় নির্বাচনটি সকল দলের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করলে আপত্তির কারণ ছিল না। এখন বিষয়টি সরকারি দলের জন্যও অস্বাভাবিক। সরকারি দলের নমিনেশন মানেই নির্বাচন বিজয়ের গ্যারান্টি। সে জন্য সরকারি দলের লোকেরা নমিনেশন বাগানোর প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। অভিযোগ, সরকারি দল থেকেই যে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে নমিনেশন বেচাকেনা হয়। তারা বলে থাকে স্থানীয় পর্যায়ের সুপারিশের ভিত্তিতে নমিনেশন দেয়া হয়। কিন্তু ভূরি ভূরি প্রমাণ আছে, সুপারিশ অগ্রাহ্য করে উপযুক্ত ব্যক্তিকে নমিনেশন না দিয়ে হাইব্রিড নেতাদের দেয়া হচ্ছে। ফলে দলে কোন্দল, মারামারি এমনকি খুনাখুনি লেগেই আছে। দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার পরিচালনার এই সিদ্ধান্ত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য বড় ধরনের ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। মাঝে শোনা গিয়েছিল যে, সরকার বিষয়টি বিবেচনা করছে। আমাদের ধারণা, হাইব্রিডদের তাড়নায় সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। এখনো সময় আছে। শান্তির স্বার্থে, স্বাভাবিকতার স্বার্থে এবং গণতন্ত্রের স্বার্থে সিদ্ধান্তটি পরিবর্তন করা হোক।
ছেলেবেলায় কবি বন্দে আলী মিয়ার একটি কবিতা পড়েছিলাম। তিনি লিখেছিলেন,
আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর,
থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর॥
আমাদের ছোট গ্রাম মায়ের সমান,
আলো দিয়ে, বায়ু দিয়ে বাঁচাইয়াছে প্রাণ॥
আম গাছ, জাম গাছ, বাঁশ ঝাড় যেন,
মিলে মিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন॥
আমাদের ছোট গাঁয়ে বড় বড় ঘর উঠেছে। সেখানে এখন আর কেউ মিলেমিশে থাকে না। রাজনীতি সবাইকেই সবার পর বানিয়ে দিয়েছে। আলো দিয়ে, বায়ু দিয়ে যে সনাতন গ্রাম আমাদের বাঁচিয়েছে এতকাল, সে গ্রাম আজ যান্ত্রিকতায় পর্যুদস্ত। এখন আম গাছ, জাম গাছ, বাঁশঝাড় ঠিকই আছে। আত্মীয়তার সেই সহজ সরল সম্পর্ক আর নেই। রাজনীতি বিষিয়ে দিয়েছে সবকিছু। কবিগুরুর ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়, ছোট ছোট গ্রামগুলো’ এখন অশান্তির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। আর বিদ্বজ্জনরা সবকিছুর জন্য দায়ী করছেন গ্রামীণ সমাজের অতিমাত্রিক রাজনৈতিক রূপান্তরকে। সে রাজনীতি ক্ষমতার, জনতার নয়। সে রাজনীতি ঘৃণার, ভালোবাসার নয়। আবার সে রাজনীতি নগরেরও। সন্ত্রাস সহিংসতা নগর সভ্যতার। সুতরাং গ্রামবাংলার প্রার্থনা : ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর, লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর/ হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী, দাও সে তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি।’ ফিরিয়ে নাও এই রাজনীতি।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]