তুরস্ক ও সিরিয়ায় কিয়ামতের ছোট আলামত

  • মাসুম মুরাদাবাদী
  •  ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ২০:৫৬, আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৬:৫৭
তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পের ধ্বংসযজ্ঞের দৃশ্য বর্ণনার মতো নয়। – ছবি : সংগৃহীত

মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিবেশী দেশ তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পের ধ্বংসযজ্ঞের দৃশ্য বর্ণনার মতো নয়। এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত। তাদের বোধগম্য নয়, তারা নিজেদের প্রতিক্রিয়া কিভাবে প্রকাশ করবে। যখন মানুষের জনবসতিতে কিয়ামতের আগে এমন কিয়ামত নেমে আসে, তখন প্রতিটি দৃশ্য এমনই ভয়ানক ও কম্পন সৃষ্টিকারী হয়। এমন মুহূর্তে শব্দ হারিয়ে যায়। যেমনটি এ মুহূর্তে এই ভয়ঙ্কর মানবিক বিপর্যয়ের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে আমার শব্দ হারিয়ে গেছে। কেউ একজন সঠিকই বলেছেন, শব্দ মানবিক অনুভূতিগুলো বর্ণনা করার সবচেয়ে অসম্পূর্ণ মাধ্যম। কিন্তু এটিও তো বাস্তব সত্য যে, আমাদের কাছে এই ভাঙা ভাঙা শব্দ ছাড়া আর আছেই বা কী?

তুরস্ক ও সিরিয়ায় এ মুহূর্তে চতুর্দিকে ধ্বংসস্তূপ চোখে পড়ছে। সড়কগুলোতে লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। কবর ও কাফনবিহীন লাশ। যারা নিষ্প্রাণ লাশে পরিণত হয়েছে, তারা একটু আগে জীবিত ছিল। আগত কিয়ামত সম্পর্কে তাদের বিন্দুমাত্র অনুভূতি ছিল না। মুহূর্তে সব কিছু বদলে গেল। যেখানে আলিশান ভবন ছিল, সেটি এখন ধ্বংসস্তূপ। যেখানে জীবনের চঞ্চলতা ছিল, সেখানে এখন মৃত্যুর মিছিল। তুরস্ক থেকে প্রাপ্ত মর্মন্তুদ ছবিগুলো এ কথা বর্ণনার জন্য যথেষ্ট যে, ভূমিকম্পকে সবচেয়ে বেশি ভয়ানক প্রাকৃতিক বিপদ কেন বলা হয়- এমন প্রশ্নের উত্তর ভূমিকম্পের অন্তর্নিহিত কার্যকারিতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে। এটি মুহূর্তে বিশাল বড় এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে সক্ষম। ভূমিকম্পে ধ্বংসযজ্ঞকে প্রতিহত করার সুযোগই পাওয়া যায় না। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত তার সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি।

তুরস্ক ও সিরিয়ার বিভিন্ন শহরে উদ্ধারকর্মীরা এখনো ধ্বংসস্তূপ থেকে লাশ খোঁজার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ভূমিকম্পের পর সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে আবহওয়া। প্রতিকূল তাপমাত্রার মধ্যে উদ্ধারকর্মীরা ধ্বংসস্তূপে আটকে থাকা মানুষদের বের করে আনার কঠোর পরিশ্রম করছে। সারা বিশ্ব থেকে সাহায্যকারীরা তুরস্ক ও সিরিয়ার আক্রান্ত এলাকাগুলোতে পৌঁছেছে। হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে এবং হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছে। এক সীমিত অনুমান অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। আহতদের সংখ্যা তার চেয়েও বেশি হবে। এ ভূমিকম্পে চার বিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে।

দুঃখের কথা হচ্ছে, তুরস্ক ও সিরিয়ার কিছু ধ্বংসপ্রাপ্ত হাসপাতাল থেকে নবজাতক শিশু ও রোগীদের নিরাপদ স্থানে বের করে নিতে হয়েছে। যখন আহতদের চিকিৎসাদাতা হাসপাতালই ধ্বংস হয়ে যায়, তখন ভূমিকম্পের আঘাতে আহত ও ভুক্তভোগীদের নতুন জীবন কে দেবে? কয়েকটি পরিবার এমনও রয়েছে, যাদের অশ্রু মুছে দেয়ার কেউই বেঁচে নেই। কেউ তার পরিবারের সব প্রিয়জনকে হারিয়েছে এবং সে বিরান সড়কের কিনারে দাঁড়িয়ে এটি ভাবছে, এখন সে কেন বেঁচে আছে। এই মর্মান্তিক কাহিনীগুলোর মধ্যে একটি কাহিনী হচ্ছে আজমারিন এলাকা নিবাসী ফরহাদের। তিনি আমেরিকার নিউজ চ্যানেল সিএনএনের সাথে কথা বলতে গিয়ে বলেন, ভূমিকম্পের সময় তিনি যা কিছু দেখেছেন এবং শুনেছেন, সেই দৃশ্য সারা জীবনভর তার সামনে ঘুরে বেড়াবে।

ফরহাদ বলেন, আনুমানিক ভোর ৪টার সময় কাচ ভাঙার আওয়াজ এলে তিনি মনে করলেন, কেউ পাথর ছুড়েছে। কিন্তু যখন দেখার জন্য উঠে দাঁড়ালেন, তখন পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেছে। তিনি বলেন, তখন আমি বুঝে ফেললাম, ভূমিকম্প হচ্ছে। পরিবারের অন্য লোকদের জাগালাম। তাদের বাইরে বের করতে লাগলাম। বৃদ্ধ মা-বাবাও সাথে ছিলেন। আমরা ঠিকঠাক বাইরে বেরিয়ে আসি। কিন্তু বাবা-মাকে বের করতে দেরি হয়ে যায়। ততক্ষণে ঘরের একটি অংশ তাদের ওপর এসে পড়ে। কোনোরকম যখন তাদের বের করে আনা হলো, তখন তারা মৃত। ফরহাদের বেদনাদায়ক কাহিনী এখানেই শেষ হয়নি। যখন তিনি তারা মা-বাবার লাশ বাইরে বের করছিলেন, তখন তার স্ত্রী ও পুত্র রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। সেই সময় আরেকটি ঝাঁকুনি আসে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কাছের একটি ভবন তাদের ওপর এসে পড়ে। চোখের পলকে তার চোখের সামনে সব কিছু শেষ হয়ে গেল। প্রথমে মা-বাবা সঙ্গ ছেড়ে চলে গেলেন। এরপর স্ত্রী-পুত্রও মারা গেল। ফরহাদ বলেন, বুঝতে পারছি না, এখন কার জন্য বাঁচব। এমন কয়েকটি মর্মপীড়াদায়ক ভিডিও ও ছবি দেখে মন ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। চতুর্দিকে হাহাকার চলছে।

এমন নয় যে, এটিই প্রথম ভূমিকম্প। ভূমিকম্প হতেই আছে। বিশ্বের কয়েকটি দেশে এর চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এগুলোর মাধ্যমে আমরা কী শিখেছি? এই ভূমিকম্পগুলোকে শুধু আল্লাহর আজাব অভিহিত করে আমরা কি নিজেদের দায়িত্ব পালন না করে বসে থাকতে পারি? না, এমনটি কখনোই নয়। ভূমিকম্পের এ ধারা শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের সৃষ্টি নয়; বরং এটি প্রকৃতির পাশাপাশি আমাদের অব্যাহত খেলতামাশারও ফল। এটি নিছক কাকতালীয় নয় যে, তুরস্ক ও সিরিয়ায় আগত এই ধ্বংসযজ্ঞের ভবিষ্যদ্বাণী তিন দিন আগে করা হয়েছিল। আর এ কাজ কোনো জ্যোতির্বিদ করেননি; বরং ভূমিকম্প নিয়ে গবেষণায় নিয়োজিত অন্যতম বিজ্ঞানী ফ্রাঙ্ক হোগার বিটস ৩ ফেব্রুয়ারি বলেছিলেন, তুরস্ক ও সিরিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ভূমিকম্প হতে যাচ্ছে। রিখটার স্কেলে যার মাত্রা সাড়ে সাত বা তার চেয়ে বেশি হতে পারে। সোলার সিস্টেম জিওমেট্রিক সার্ভের গবেষক ফ্রাঙ্ক হোগার বিটস বেশ কিছু দিন ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে হওয়া ক্রমাগত ভূমিকম্পের সক্রিয়তার ওপর গবেষণা করছেন। এই গবেষণার ভিত্তিতে তিনি সতর্ক করেছিলেন, দক্ষিণ-মধ্য তুরস্ক, লেবানন, সিরিয়া ও জর্দানে সাড়ে সাত বা তার চেয়ে বেশি রিখটার স্কেলের ভূমিকম্প হতে পারে। তার এই ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। ধ্বংসযজ্ঞের দৃশ্য আমাদের সামনে। কিন্তু সবসময়ের মতো আমরা এটিকে ভুলে যাবো এবং জীবনের রঙ্গতামাশায় হারিয়ে যাবো।

১৯৯৯ সালেও তুরস্কে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হয়েছিল। ওই ভূমিকম্পে ১৭ সহস্রাধিক মানুষ নিহত হয়েছিল। তুরস্কের বেশ কিছু শহরে কয়েকটি এলাকা সম্পূর্ণরূপে ভূগর্ভে চলে গিয়েছিল। মানুষ ২৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৯ সালের ওই ভূমিকম্পকেও স্মরণ করে, যেটিতে প্রায় ৩৩ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। তুরস্ককে ভূকম্পনের অনুভূতির দিক দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দেশ হিসেবে গণ্য করা হয়। ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞানীরা বলেন, তুরস্কের ভূমি চারটি প্লেটের ওপর অবস্থিত। তন্মধ্যে একটি প্লেট নড়লেই ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে। এবার শুধু ভূকম্পনই নয়; বরং ভূমি দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত ধাক্কা খেয়েছে। চিন্তার বিষয় হচ্ছে, এক-দুই মিনিটের ভূমিকম্পেই বেশির ভাগ ভবন ধসে পড়ে যায়। কিন্তু যখন তিন মিনিটের বেশি ভূমি দুলতে থাকে, তখন দুর্বল ভবনগুলোকে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। এমন নয় যে, ভূমিকম্পে আক্রান্ত এলাকাগুলোতে সব ভবন মাটির সাথে মিশে গেছে। যে ভবনগুলো বহাল তবিয়তে টিকে আছে, সেগুলোর দৃঢ়তার খোঁজ নেয়া উচিত।

এর পাশাপাশি ভবিষ্যতের নির্মাণকাজেও সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। তুরস্ক ও সিরিয়ার মতো ভূকম্পনপ্রবণ দেশগুলোতে নির্মাণকাজের দৃঢ়তার প্রতি ধ্যান দেয়া ও সেগুলোকে ভূমিকম্পরোধক বানানোকে প্রাধান্য বিষয়াবলিতে শামিল করা উচিত। তুরস্কের লৌহমানব রজব তাইয়েব এরদোগান কঠিনতর পরিস্থিতিতেও সাহস জোগানো বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘যা কিছু হয়েছে, তা আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয়েছে। যারা চলে গেছেন, তাদের তো আমরা ফিরিয়ে আনতে পারব না। কিন্তু যাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে, আমরা তাদের একটি পয়সা খরচ ব্যতীত আগের চেয়ে উত্তম বাড়ি বানিয়ে দেবো। কারো একটি বৃক্ষ ক্ষতি হয়েছে, আমরা তাকে ১০টি বৃক্ষ লাগিয়ে দেবো। চিন্তা করবেন না। আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।’

এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না, বৈশ্বিক উষ্ণতা, অপ্রয়োজনীয় ভূমি খনন, ব্যাপকহারে বৃক্ষ ও পাহাড় কাটা, বরফ গলে যাওয়া, বন্যা, বনজঙ্গলে আগুন প্রভৃতির কারণে ভূপৃষ্ঠের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে। বিভিন্ন গবেষণামূলক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিগত তিন দশকে দুর্যোগগুলোর মাত্রা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। ভূমিকম্পও ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অঞ্চলও এর থেকে নিরাপদ নয়। কানপুরের আইআইটিতে ভূ-বিজ্ঞানের সিনিয়র বিজ্ঞানী প্রফেসর জাভেদ মালিক আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, ভবিষ্যতে ভারতের কিছু অংশেও এ ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে।

আশঙ্কা আছে, এর কেন্দ্র হবে হিমালয় অঞ্চল বা আন্দামান নিকোবার। ভূমির ওপর বাড়তি চাপের কারণে উত্তরাখণ্ডের জোশি মঠে যা কিছু হয়েছে, তা কারো কাছে গোপন নেই। এখানে কয়েকটি স্থান থেকে ফাটলের সংবাদ সামনে আসছে। ভারতের ভূমির নিচের পরিস্থিতি তুরস্কের মতো ভূমিকম্পপ্রবণ নয়। তবে ভারতের প্লেট সরে যাচ্ছে। আর হিমালয়ের উচ্চতা বাড়ছে। ভূমিকম্পের ছোট ছোট ধাক্কা ক্রমাগত অনুভব করা যাচ্ছে। বিশ্বকে একজোট হয়ে এর কোনো সমাধান বের করা উচিত।

মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুম্বাই উর্দু নিউজ ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩-এর উর্দু থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট