স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক দখলের চেষ্টা আওয়ামীপন্থিদের

রোহান রাজিব
প্রকাশ : ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ০৮: ৩০

দীর্ঘ ২৫ বছর স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ আঁকড়ে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা গোপালগঞ্জের কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ। শেখ হাসিনা ভারতে পালানোর পর তিনি নিজ থেকে চেয়ারম্যান পদ ছাড়েন। যদিও তিনিসহ আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট কয়েকজন এখনো ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন। তারাই এখন আবার ব্যাংকটি দখলে নেওয়ার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এরই মধ্যে নিজেদের পছন্দের একজনকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে একটি চিঠি দিয়েছেন তারা। এ নিয়ে ব্যাংকটিতে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ১৬ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদের মধ্যে ৬ জন এক পক্ষ নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি চিঠি দিয়েছে। সেখানে বর্তমান ভাইস-চেয়ারম্যান একেএম আব্দুল আলিম নিজেকে চেয়ারম্যান দাবি করেন। একই সঙ্গে ব্যাংকের বর্তমান এমডি হাবিবুর রহমানকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর কথা উল্লেখ করেন। তবে বিষয়টি আইনসিদ্ধ না হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক গত ৬ নভেম্বর ব্যাংকটির চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে এমডির নিয়মিত দায়িত্ব পালন করে যেতে বলেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান কে হবেন পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে তা ঠিক হয়। আবার এমডিকে ছুটিতে পাঠানো বা অন্য কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যও সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। তা না করে কাউকে ছুটিতে পাঠানো বা নিয়ম অমান্য করে নিজ থেকে কেউ চেয়ারম্যান ঘোষণা করার সুযোগ নেই।

জানা গেছে, নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করা আব্দুল আলিম সাবেক চেয়ারম্যান কাজী আকরামের ছেলে কাজী খুররম আহমদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেখানে আরো স্বাক্ষর করেন ব্যাংকটির পরিচালক ও আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাহেদুল হক। জালিয়াতির মাধ্যমে সৎ ভাইদের জমির ওপর গড়ে ওঠা চট্টগ্রামের একটি ভবন ব্যাংকের কাছে উচ্চ মূল্যে ভাড়া দেওয়ার তথ্য পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই জালিয়াতির দায়ে তিনি ব্যাংকের পরিচালক পদ হারাতে পারেন বলে জানা গেছে। এছাড়া পরিচালক কামাল মোস্তফা চৌধুরী, অশোক কুমার সাহা ও অসিত কুমার সাহা এবং ব্যাংকটির স্বতন্ত্র পরিচালক গোলাম হাফিজ আহমেদ রয়েছেন এই তালিকায়। গোলাম হাফিজ পরিবার ছিল আওয়ামী লীগের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তার স্ত্রী সুরাইয়া বেগম ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কার্যালয়ের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি। সেই সুবাদে আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে তিনি ২০১৪ সালে তিন বছরের জন্য জোরপূর্বক এনসিসি ব্যাংকের এমডি হন। পরবর্তী সময়ে একই কায়দায় ২০১৮ সালে ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান। নানা অভিযোগের কারণে সেখানে তিনি মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি।

আওয়ামী লীগের সময়ে লুটপাট হয়েছে এরকম ১৪টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের পর্ষদে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হাত না দিলেও নিয়োগ জালিয়াতি, ঋণ অনিয়মসহ বিভিন্ন জালিয়াতির দায়ে কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ, তার ছেলে ও ব্যাংকটির সাবেক পরিচালক কাজী খুররম আহমদের দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয় আদালত। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনে গত ১৪ মে ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. জাকির হোসেন গালিব এ আদেশ দেন। দুদকের অনুসন্ধানে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসার ভয়ে আওয়ামীপন্থি কয়েকজন ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব নিয়ে ব্যাংকটিতে চরম অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।

নিয়মবহির্ভূতভাবে চেয়ারম্যান ঘোষণা ও এমডিকে ছুটিতে পাঠানোর বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ দেন বর্তমান চেয়ারম্যান আবদুল আজিজ। গত ৫ নভেম্বর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল আজিজ বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো চিঠিতে লেখেন, গত ৩০ অক্টোবর ব্যাংকের ৪১৯তম পর্ষদ সভায় মোট ৫৬টি এজেন্ডা ছিল। এজেন্ডায় চেয়ারম্যান নির্বাচন বা ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ৯০ দিনের ছুটিতে পাঠানোর বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল না। তবে সভা শেষে ভাইস চেয়ারম্যান এ কে এম আবদুল আলিমসহ ছয়জন পরিচালক নিজেদের মধ্যে দুটি নতুন এজেন্ডা (৫৯ ও ৬০) তৈরি করে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে একটি রেজুলেশন প্রস্তুত করেন। পরবর্তী সময়ে সেটি ব্যাংকের অফিসিয়াল নথি হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয়, যা সম্পূর্ণ বেআইনি ও ক্ষমতার অপব্যবহার। পর্ষদে অনুমোদনহীন কোনো বিষয় রেজুলেশনে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। এটি করপোরেট গভর্ন্যান্স বিধিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

চিঠিতে তিনি আরো উল্লেখ করেন, আমি ব্যাংকটিকে স্বচ্ছভাবে পুনর্গঠন করতে চাই। কিন্তু আমারই ছেলে আবদুল আলিম ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে অগণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করছে। এটা ব্যাংকের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। কয়েকজন পরিচালক পরিকল্পিতভাবে ব্যাংকের নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্তগুলো আটকে দিচ্ছেন—ফলে ব্যাংকের প্রশাসনিক কার্যক্রমে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে।

আবদুল আজিজ চিঠিতে আরো লিখেন, বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক একজন সৎ, মেধাবী ও পরিশ্রমী ব্যাংকার। তিনি কোনো দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত এরকম তার জানা নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট রিপোর্টেও তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। বরং তিনি অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার। এসব কারণে হয়তো কিছু পরিচালক বেআইনিভাবে তাকে টার্গেট করছে।

চিঠির সত্যতা জানতে আমার দেশ থেকে চেয়ারম্যান আবদুল আজিজের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, চিঠির বিষয়টি সত্য। ভুয়া এজেন্ডা তৈরি করে নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়েছে ও এমডিকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। মোট ১৬ জন পরিচালক থাকতে কীভাবে ছয়জন পরিচালককে সংখ্যাগরিষ্ঠ বলা যায় সেটা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।

সাবেক চেয়ারম্যান বা তার ছেলের কোনো ভূমিকা ছিল কি না—এ প্রশ্নের উত্তরে আবদুল আজিজ বলেন, তিনি নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেন না, কারণ অদেখা ব্যাপার শুধু আল্লাহই জানেন। তবে তার মনে হয়—এ ঘটনায় নিশ্চয়ই কোনো না কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র ছিল।

জানতে চাইলে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, গত ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত পরিচালনা পর্ষদের ৫৯ ও ৬০ নম্বর এজেন্ডার কথা উল্লেখ করে তাকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। অথচ ওই দিন সর্বশেষ এজেন্ডার নম্বর ছিল ৫৬। বাংলাদেশ ব্যাংকে যে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে তার কোনো ভিত্তি নেই।

এসব বিষয়ে জানতে ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আলিমকে (নিজেকে চেয়ারম্যান দাবি করা) ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। পরবর্তী সময়ে হোয়াটসঅ্যাপে বিস্তারিত ম্যাসেজ পাঠালেও কোনো উত্তর দেননি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here