ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব
সেন্টামার্টিন দ্বীপ থেকে দেশের মূল ভূখন্ডে ফেরা, কিংবা মূল ভূখন্ড থেকে সেন্টমার্টিনে ফেরায় মিয়ানমার থেকে গুলির ঘটনা এক সপ্তাহ ধরে সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে। গুলির ঘটনায় দ্বীপটির সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন, এতে করে সেখানে খাদ্য সংকটও দেখা দিয়েছে।
এরই মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার (১৩ জুন) সেন্টমার্টিন থেকে ট্রলারে টেকনাফে ফেরার পথে মিয়ানমার থেকে ছোঁড়া গুলিতে আলী জোহার নামে এক যুবক আহত হয়েছেন। কিন্তু এসব ঘটনায় বাংলাদেশ বা মিয়ানমার কারও পক্ষ থেকে পরিষ্কার কোনো অবস্থান বা ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে না। বরং স্থানীয় সাংবাদিক, নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং নৌবাহিনীর অভ্যন্তরীণ অপারেশনস থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলোতে কিছু সামঞ্জস্যহীনতা দেখা গেছে। তবে কি কোনো কিছু আড়াল করা হচ্ছে? কোনো তথ্য বা কোনো সত্য?
স্থানীয় সাংবাদিকরা বলছেন, নাফ নদ থেকে সেন্টমার্টিন রুটের নৌযানে মিয়ানমার থেকে গুলি করা হচ্ছে বলে নিয়মিত যাতায়াত এবং মালামাল পরিবহণ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ আছে। সেন্টমার্টিনের অন্যতম প্রধান সমস্যা খাদ্য সংকট। সাতদিন ধরে নৌ-চলাচল বন্ধ থাকার কারণে সেখানকার বাজার ও দোকানগুলোতে পর্যাপ্ত খাদ্য নেই।
তারা আরও জানান, আজ (১৪ জুন) কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন গভীর সমুদ্র রুটে বড় জাহাজে করে দুই মাসের সম পরিমাণ চাল নিয়ে যাওয়ার কথা আছে। নাফ এবং সেন্টমার্টিন রুটের দুই পাশে যারা আটকে পড়েছিলেন তাদের কেউ কেউ ছোট ছোট ট্রলারে করে গুলির ভয় উপেক্ষা করে পার হয়েছেন।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটা সূত্র জানিয়েছে, সেন্টমার্টিন এলাকার নৌবাহিনীর পেট্রোল জাহাজ যেখানে টহল দেয়, আগামীকাল সেখান থেকে চলে আসতে পারে। অথবা পেট্রোল জাহাজটি সেখানে থাকবে কিনা- এই নিয়ে একটা ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। এই জাহাজের/নৌঘাঁটি কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী নিকটবর্তী একটি ঘাঁটিতে অবস্থান করছেন। কিন্তু তারা ফিরতে পারেননি কিংবা পারছেন না।
স্থানীয় সূত্র ও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, সেন্টমার্টিন থেকে মিয়ানমারের দিকে দুইটি বা তিনটি যুদ্ধজাহাজ দেখা যাচ্ছে। অতীতে এই অঞ্চলে মিয়ানমারের পেট্রোল জাহাজ দেখা যেত।
আর নৌবাহিনীর একটি সূত্র বলছে, গত কয়েকমাস থেকে টহলের পরিবর্তে দুটি জাহাজ স্থির দাঁড়িয়ে আছে যা আগে দেখা যায়নি।
অন্যদিকে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় এবং নৌবাহিনী অপারেশনসের একটা সূত্র বলছে, সবকিছু বরাবরের মতো স্বাভাবিকই আছে। শুধু বেসামরিক চলাচলে সমস্যা হচ্ছে। এটা নিয়ে বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে কাজ করছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংবাদমাধ্যমে এমন বক্তব্যও দিয়েছেন।
বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য বিচার বিশ্লেষণ করে কয়েকটি বিষয়ে পরস্পর বিরোধী অবস্থান দেখা গেছে। প্রথমত, যদি সবকিছু ঠিকঠাক এবং স্বাভাবিক থাকে তাহলে বাংলাদেশের নৌবাহিনীর টহল জাহাজের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিকটবর্তী ঘাঁটি থেকে সেন্টমার্টিনের ঘাঁটিতে ফিরতে পারছেন না কেন?
দ্বিতীয়ত, নৌবাহিনীর সেন্টমার্টিন ঘাঁটির টহল জাহাজ ফিরে আসবে কেন, সরকার কি এলাকাটিকে যুদ্ধাঞ্চল ঘোষণা করেছে? যুদ্ধজাহাজ না গেলে টহল জাহাজ ফেরানোর প্রশ্ন ওঠে কেন? আন্তর্জাতিক সীমান্ত অরক্ষিত রেখে বা সেখানে অন্য কোনো জাহাজ পুনর্স্থাপন না করে টহলকাজ প্রত্যাহারের তাৎপর্য কী?
তৃতীয়ত, যুদ্ধাঞ্চল ঘোষণা না হলে বেসামরিক পণ্য ও যাত্রী চলাচলের যানবাহনের ওপর গুলি চলবে কেন?
চতুর্থত, বিষয়টি জাতিসংঘকে জানানো হয়েছে কিনা? যেহেতু এর নিরাপত্তা এবং মানবিক দুটি দিকই স্পর্শকাতর।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে বাংলাদেশ বরাবরই চীনের স্বার্থ দেখেছে। আরাকান আর্মি প্রশ্নে বাংলাদেশ ভারত-চীনের যৌথ স্বার্থ দেখেছে। আন্তর্জাতিক পক্ষ, পশ্চিমা কিংবা জাতিসংঘকে সম্পৃক্তকরণের বাইরে গিয়ে ভারত-চীনের সঙ্গে ঘুটু করে বাংলাদেশ সীমান্ত পরিস্থিতি কিংবা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কোনো অগ্রগতি আনতে পারেনি।
উপরন্তু, পালিয়ে আসা মিয়ানমার সেনাদের ফিরিয়ে দিয়ে আরাকান আর্মির সঙ্গে সংঘাতের ক্ষেত্র তৈরি করছে। এমতাবস্থায় মিয়ানমার জান্তার যুদ্ধজাহাজের উপস্থিতি এবং বেসামরিক নৌযানে গুলি কীসের ইঙ্গিত? বাংলাদেশ কি এবারও জাতিসংঘকে এখানে সম্পৃক্ত না করে ভারত-চীনের স্বার্থরক্ষায় ভূমিকা রাখবে?
আমাদের জানতে হবে, আমরা কি মিয়ানমারের স্যাবোটাজে ভয় পাচ্ছি, নাকি সত্যি সত্যিই এখানে কোনো তথ্য বা সত্য লুকোচুরি হচ্ছে?
প্রসঙ্গত, গত নভেম্বরে জান্তা সরকার ও আরাকান আর্মির মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভেঙে যাওয়ার পর রাখাইনে নতুন করে সংঘাত শুরু হয়৷ আরাকান আর্মি কয়েকটি জায়গায় সফলতা অর্জন করে৷ এই অবস্থায় বিদ্রোহীদের রুখতে জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়। যদিও আরাকান আর্মি ইতোমধ্যে রাখাইনের ৯টি এবং চিন রাজ্যের একটি শহরতলি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে।
Bangla outlook