২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী-এ তিন দলেরই সমাবেশ ছিল। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ‘লগি-বইঠা’ নিয়ে সেই সমাবেশে উপস্থিত থাকার বলা হয়েছিল। সকাল থেকেই আওয়ামী লীগ পল্টন ময়দানে, বিএনপি নয়া পল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে এবং জামায়াতে ইসলামী বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে অবস্থান নিয়েছিল। সেদিন দুপুর থেকে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষের সময় ‘লগি-বইঠা’ সদৃশ লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মানুষ মারার দৃশ্য পরবর্তীতে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। সেদিনের সেই সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হন। এর মধ্যে চারজন জামায়াতের এবং একজন ছিলেন ওয়ার্কার্স পার্টির কর্মী। এ ঘটনার পর থেকে অনেকেই ২৮ অক্টোবরকে ‘লগি-বইঠার আন্দোলন’ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, ২০০৬ সালে ‘লগি-বইঠা’র সেই আন্দোলনের পর দেশে কিন্তু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়নি। বরং রাজনৈতিক দলগুলোর সংঘাত-সংঘর্ষের সূত্র ধরে এক-এগারোর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ‘সেনা-সমর্থিত’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসেছিল। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, সমসাময়িক রাজনীতিতে ‘লগি-বইঠা’র যে ভূমিকা তা সেই সংঘর্ষ ও সহিংসতাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। একজন সক্রিয় রাজনীতিক হিসেবে মেয়র তাপসের সেটা না বোঝার কোন কারণ নেই। তারপরও তিনি কেন ‘লগি-বইঠা’র প্রসঙ্গ টেনে আনলেন? এটা কি তাঁর ব্যক্তিগত মতামত? বিষয়টা সম্ভবত সেরকম নয় এবং গত কয়েক দিন ধরেই ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বক্তব্য থেকে সেটা স্পষ্ট।
বিএনপি মহাসমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণার পর থেকে সরকারি দলের কোনো কোনো নেতা বলেছেন, ‘২৮ অক্টোবর রাজপথ থাকবে আওয়ামী লীগের দখলে’। (যুগান্তর অনলাইন, ২২ অক্টোবর)। দিন যত গড়িয়েছে ২৮ অক্টোবর নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ‘আক্রমণাত্মক’ কথা-বার্তা ও প্রস্তুতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
মেয়র তাপস যে সভায় ‘লগি-বইঠা’ হাতে গণতন্ত্র রক্ষা করার কথা বলেছেন একই সভায় ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান নেতা-কর্মীদের ব্যানার-ফেস্টুনের সঙ্গে মোটা লাঠি নিয়ে সমাবেশে আসার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, ‘২৮ তারিখে নৌকার পেছনে মোটা মোটা লাঠি নিয়ে যেতে হবে। ফেস্টুনে মোটা মোটা লাঠি থাকবে। আমাদের সব কর্মী জানে-বিএনপির লোকজন কোথায় থাকে, কোন মেসে থাকে, কোন হোটেলে থাকে। আমাদের সব জানা আছে।’ (সমকাল অনলাইন, ২৫ অক্টোবর)
শুধু এক-দু’জন নেতা নয়, দল হিসেবে আওয়ামী লীগও ২৮ অক্টোবর নিয়ে ‘আক্রমণাত্মক’ অবস্থান নিয়েছে। মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের বৈঠকের খবর থেকে তেমনটাই প্রতীয়মান হয়।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সভা শেষে ওবায়দুল কাদেরসহ দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা আবার বৈঠক করেন। দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সপ্তম তলায় অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে উপস্থিত থাকা একাধিক সূত্র জানায়, ২৮ অক্টোবরের সমাবেশে ১০-১২ লাখ লোক জমায়েতের বিষয়ে আলোচনা হয়। এ ছাড়া সমাবেশে আসা নেতা-কর্মীদের খালি হাতে না আসারও নির্দেশনা দেওয়া হয়। সবাই যেন আড়াই থেকে তিন হাত লম্বা লাঠি হাতে আসেন, সেই পরামর্শ দেন কোনো কোনো কেন্দ্রীয় নেতা। …’ (প্রথম আলো, ২৫ অক্টোবর)
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নেতারা যেভাবে দলীয় কর্মীদের ‘লগি-বইঠা’ বা লাঠি হাতে সমাবেশে আসার কথা বলেছেন, সেটা কোনো অবস্থাতেই আইনসম্মত বা যুক্তিসংগত নয়। এসব কথাবার্তা বরং সহিংসতাকে উসকে দিচ্ছে। যে বিষয়টা মনে রাখার দরকার, বিএনপির সমাবেশ বা আন্দোলনের ফলে যদি কোনো বিশৃঙ্খলা বা নিরাপত্তাজনিত শঙ্কা সৃষ্টি হয়, সেটা নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।
আওয়ামী লীগ সরকারি দল বলেই দলটির নেতা-কর্মীরা নিজেদের হাতে আইন-শৃঙ্খলা ‘রক্ষা’র দায়িত্ব তুলে নিতে পারে না। দলটির এমন ভূমিকায় বিরোধী দলের কর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যেও ভীতি ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়তে পারে। প্রশ্ন উঠেছে, ভীতি বা আতঙ্ক ছড়ানোই এরকম ‘আক্রমণাত্মক’ কথা-বার্তার উদ্দেশ্য কি-না। উদ্দেশ্য যাই হোক, ‘লগি-বইঠা’ বা লাঠি নিয়ে রাজপথ দখলে রাখা যেতে পারে, ভীতি বা আতঙ্ক তৈরি করা যেতে পারে; কিন্তু এভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না।
২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ‘লগি-বইঠা’ দিয়ে পিটিয়ে মানুষ মারার যে নির্মম ও অমানবিক ঘটনা ঘটেছিল, আমরা কোন অজুহাতেই তার পুনরাবৃত্তি চাই না। বিরোধী দলের সমাবেশ বা আন্দোলন থেকে কোনো সহিংসতা বা সংঘর্ষ ঘটুক, সেটাও আমাদের কাম্য নয়। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দেশে একটি রাজনৈতিক সংকট চলছে। সেই সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে। বলপ্রয়োগ বা সহিংসতার মাধ্যমে কখনো কোনো রাজনৈতিক সংকটের স্থায়ী বা টেকসই সমাধান হয়নি, এ ক্ষেত্রেও সেটা হবেও না।