নয়াদিল্লি
মহাজ্ঞানী মহাজন যে পথে গমন করেছেন, সেই পথে হেঁটে বিপর্যয় থেকে উদ্ধার পেতে চাইছেন বিশ্বের সপ্তম ধনী ৬০ বছর বয়সী গুজরাটি ধনকুবের গৌতম শান্তিলাল আদানি। সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর পার থেকে হিনডেনবার্গ রিসার্চের ছোড়া বাণে এভাবে আচম্বিতে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়তে পারে, তা ছিল তাঁর কল্পনাতীত। অপ্রত্যাশিত সেই আক্রমণের মোকাবিলায় তিনি আঁকড়ে ধরেছেন এই প্রাচীন আপ্তবাক্য। সর্বার্থে যাঁকে তিনি গুরু বা ‘মেন্টর’ ভেবে আসছেন, সেই নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদিকে অন্ধের মতো অনুসরণ করে তিনি তরাতে চাইছেন। পারবেন কি না কিংবা পারলেও কিসের বিনিময়ে, এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন সেটাই।
কী সেই ঢাল? জাতীয়তাবাদ। হিনডেনবার্গ রিসার্চের তোলা কারচুপির যাবতীয় অভিযোগ, যা কিনা আদানিদের মতে নিছক অপবাদ, সেসব খণ্ডনের চেষ্টার পাশাপাশি তাঁরা জাপটে ধরেছেন জাতীয়তাবাদের নামাবলি। তিনি বলতে চেয়েছেন, নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন নতুন ভারতের উত্থানগাথার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে তাঁদেরও উত্তরণ। তাঁরা এই নতুন ভারতের প্রগতির নমুনা। হিনডেনবার্গ তাঁদের দিকে তির ছুড়লেও তার আসল লক্ষ্য মোদির নেতৃত্বাধীন এই উত্থিত ভারত। ভারতের বিকাশ, ভারতীয় গণতন্ত্র ও তার প্রতিষ্ঠান ওই আক্রমণের লক্ষ্য।
আদানিদের বক্তব্য ফুৎকারে উড়িয়ে হিনডেনবার্গ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, জাতীয়তাবাদের নামে জালিয়াতি করলেও সেটা জালিয়াতিই থাকবে। সেই জালিয়াতির মাধ্যমে বিশ্বের অন্যতম ধনী হলেও তা জালিয়াতি বলেই বিবেচিত হবে। আদানিদের যাবতীয় যুক্তি, জবাব ও আত্মপক্ষ সমর্থনে পেশ করা তথ্য নাকচ করে বিন্দুমাত্র রাখঢাক না রেখে তারা বলেছে, জাতীয় পতাকায় শরীর ঢেকে আদানি গোষ্ঠী দেশকে লুট করছে। ভারতের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
ঘটনাপ্রবাহকে জাতীয়তাবাদের মোড়কে ঢেকে সংকট থেকে পরিত্রাণের পথে নরেন্দ্র মোদি হাঁটছেন পুলওয়ামা–কাণ্ডের সময় থেকে। ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি লোকসভা ভোটের ঠিক আগে কাশ্মীরের পুলওয়ামায় ঘটে যাওয়া মর্মন্তুদ আত্মঘাতী হামলায় আধা সামরিক বাহিনী সিআরপিএফের ৪০ জওয়ান নিহত হয়েছিলেন। পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন জইশ–ই–মহম্মদ সেই হামলার দায় স্বীকার করেছিল। ১২ দিনের মাথায় ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানকে পাল্টা জবাব দেয় ভারতীয় বিমানবাহিনী। নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে ১২টি ‘মিরাজ ২০০০’ যুদ্ধবিমান পাকিস্তানের বালাকোটে জইশের ঘাঁটিতে হামলা চালায়। ভোটের প্রচারে সেই ঘটনাকে হাতিয়ার করে জাতীয়তাবাদের পালে হাওয়া লাগিয়ে নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপি দ্বিতীয়বার আরও বেশি আসনে বিজয়ী হয়েছিল। ধর্মীয় মেরুকরণের পাশাপাশি মুসলমান ও পাকিস্তান সমার্থক করে তুলে হিন্দু জাতীয়তাবাদী ঢেউ তারা আছড়ে দিয়েছিল আসমুদ্রহিমাচলে।
নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপির বিজয়রথ সেই থেকে প্রতিটি বাধা অতিক্রম করছে জাতীয়তাবাদী নামাবলি চাপিয়ে। রাফাল বিতর্ক স্মরণ করলে দেখা যাবে, সুপ্রিম কোর্টকেও সরকার স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, দেশের নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বার্থে কোনোভাবেই তারা ফ্রান্সের কাছ থেকে কেনা ওই যুদ্ধবিমানের দাম ও ক্ষেপণাস্ত্রের চরিত্র উদ্ঘাটন করতে পারবে না। জাতীয়তাবাদের দোহাই দিয়ে দুর্নীতির যাবতীয় অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে রাফালসংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের অনুকূল অভিমত সরকার আদায় করে নিয়েছিল।
একই অস্ত্রের প্রয়োগ করা হয় পেগাসাস–বিতর্ক চাপা দিতেও। সন্ত্রাসীদের মোকাবিলার পাশাপাশি ইসরায়েলি ওই স্পাইওয়্যারের সাহায্যে দেশের বিচারপতি, রাজনীতিক, সাংবাদিক, গণ–আন্দোলনকর্মীসহ সাধারণ নাগরিকদের ফোনে আড়ি পাতার অভিযোগ মোদি সরকার খারিজ করেছিল জাতীয়তাবাদকে হাতিয়ার করে। অভিযোগের তদন্তে সুপ্রিম কোর্ট যে বিশেষজ্ঞ কমিটি গড়ে দিয়েছিলেন, সরকার তার সঙ্গে সহযোগিতা করেনি। পেগাসাস–সংক্রান্ত কোনো তথ্যও সরকার জমা দেয়নি সুপ্রিম কোর্টে। দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে সেসব তথ্য জানাতে অস্বীকার করে সরকার বলেছিল, তারা এমন কিছু জানাবে না, যাতে শত্রুপক্ষ ও সন্ত্রাসবাদীরা সতর্ক হয়ে যায়। সবার আগে জাতীয় স্বার্থ।
সাম্প্রতিক এক নিদর্শনও আদানি গোষ্ঠীকে জাতীয়তাবাদী চেতনা ঢাল হিসেবে ব্যবহারে অনুপ্রাণিত করতে পারে। ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে বিবিসির তথ্যচিত্র সারা দেশে হুলুস্থুল কাণ্ড ঘটিয়েছে। নরেন্দ্র মোদিকে ওই দাঙ্গার পান্ডা হিসেবে বিবিসি শুধু চিহ্নিতই করেনি, এ কথাও বলেছে, ওই দাঙ্গা পরবর্তীকালে মোদিকে প্রধানমন্ত্রী হতে সাহায্য করেছে। বিবিসির ওই তথ্যচিত্রের প্রতিপাদ্য ‘অসত্য, দুরভিসন্ধিমূলক, অপপ্রচার’ বলে খণ্ডন করেছে ভারত। তারা এ কথাও বলেছে, ওই তথ্যচিত্রে ‘ঔপনিবেশিক মানসিকতার প্রতিফলন’ ঘটেছে। জাতীয়তাবাদী চেতনায় রাষ্ট্রের স্বার্থে সরকার ওই তথ্যচিত্র নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি বলতে শুরু করেছে, ভারতের সার্বিক অগ্রগতি ও বিকাশ রোধে ওই তথ্যচিত্র পশ্চিমা ষড়যন্ত্র। ব্রিটেনে ভারতীয় অভিবাসীদের বিক্ষোভ আন্দোলনেও এই মানসিকতারই প্রতিফলন দেখা গেছে। তাঁদের অভিযোগ, মোদি সরকারকে অপদস্থ করতেই ওই ‘ভিত্তিহীন’ তথ্যচিত্রের অবতারণা।