কোনো দিন ভাবিনি, বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী জীবদ্দশায় দেখব। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার পরম দয়া, সরাসরি না হলেও ঘরে বসে টিভির পর্দায় দুটিরই উদ্যাপন কিছুটা হলেও দেখেছি। অনুষ্ঠানগুলো বর্ণাঢ্য ও গর্ব করার মতো। দুটো কারণে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের এতে অংশগ্রহণের মতো অবস্থা বা সুযোগ ছিল না । প্রথমত, করোনার পুনঃ আক্রমণ এবং অত্যধিক মাত্রায় নিরাপত্তাব্যবস্থা। ১০ দিনের এই বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে যেহেতু উপমহাদেশের চারজন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান এসেছিলেন, তাই নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল কঠোর, ফলে আমার মতো সাধারণ মানুষের ঘর থেকে বের হওয়াও সম্ভব হয়নি। আলাদা কোনো একটা ব্যবস্থা করতে পারলে অনুষ্ঠানমালা হয়তো আরও সর্বজনীন হতো, হতো আরও উপভোগ্য।
তথাপি জাঁকালোভাবে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধন্যবাদ পেতে পারেন। বাংলাদেশের যে চিত্র বিশ্বের দরবারে হাজির হয়েছে, সে কারণে বাংলাদেশি হিসেবে আমি গর্ব বোধ করছি। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের অগ্রগতি-উন্নতির ছবি, উপমহাদেশ ছাড়াও, বিশেষ করে বিশ্বের ওই সব দেশে পৌঁছেছে, যারা ‘বাংলাদেশ আ বটমলেস বাস্কেট কেস’ ১৯৭৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জারের এই উক্তির সমর্থক ছিল। কিসিঞ্জার এখনো জীবিত। সরকার তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে এলে উত্তম হতো। আগামী ১৬ ডিসেম্বরেও অবশ্য তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো যায়।
এ অবস্থায় আসতে বাংলাদেশের বেশি দিন লাগেনি, কারণ, এ দেশের মানুষের আছে দেশ ও নিজেকে গড়ার অদম্য আকাঙ্ক্ষা আর ইচ্ছাশক্তি। আমরা যারা ১৯৭২-৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর কষ্টের দিনগুলো দেখেছি, তাদের অনেকেই আমার মতো ১৯৭৪-এর মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ভিক্ষের সময় ভাবতেও পারেনি, একদিন আজকের জায়গায় পৌঁছাবে দেশ। হতাশা মাঝেমধ্যে বঙ্গবন্ধুকেও গ্রাস করত। তিনি জনগণের কাছে লুকাতেন না, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ সামলাতে গিয়ে দিশেহারা হয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ভিক্ষা করে আনি আর চাটার দল খেয়ে ফেলে।’ তিনি জনগণের সামনে বলেছেন, ‘সবাই পায় সোনার খনি আর আমি পেলাম চোরের খনি।’ মানুষের কণ্ঠকে ধারণ করেছিলেন তিনি। কিন্তু যার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তার বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি, তার আগেই তাঁকে ঘাতকের হাতে সপরিবার প্রাণ দিতে হয়েছিল। ১৫ আগস্ট সিঁড়িতে পড়ে থাকা তাঁর নিথর দেহটি আমার মনে গেঁথে আছে, আজীবন থাকবে।
শেখ মুজিবুর রহমান উপমহাদেশ তথা এশিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্রীয় নেতার থেকে আলাদা। সব সময় তিনি মানুষের মধ্যেই থাকতেন। তিনিও রক্ত-মাংসের মানুষ, সফলতা-ব্যর্থতা থাকাটাই স্বাভাবিক, কিন্তু তিনি বাঙালি আর বাংলা ভাষার একমাত্র দেশ বাংলাদেশের স্থপতি। আজ কোথায় পাকিস্তান আর কোথায় বাংলাদেশ। দেশ আজ উন্নয়নশীল দেশের মডেল। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে আমরা তাই বিনম্র চিত্তে স্মরণ করব। শুধু কন্যা হিসেবেই নয়, নেতা হিসেবেও শেখ হাসিনা আর তাঁর সরকার জাতির পিতাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন। আমাদের এটা মনে রাখতে হবে যে জাতির পিতা শুধু আওয়ামী লীগ নয়, তিনি সর্বজনীন। এ বিষয়ে সংশয় রাখা বা থাকা উচিত নয়।
উদার গণতন্ত্রের জন্য জীবনের অর্ধেক সময় যিনি জেল-জুলুম সহ্য করেছেন, সেই বঙ্গবন্ধুই চারদিকের পরিস্থিতি দেখে গণতন্ত্রের পথ থেকে সরে এসেছিলেন। কেন তাঁকে এমনটা করতে হয়েছিল, ব্যাখ্যা দেওয়ার সময় তিনি পাননি। কারণ যা-ই হোক, বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র হোঁচট খেয়েছিল। পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দলের বিকাশ যেমন হয়নি, তেমনি রাজনৈতিক সংস্কৃতিও গড়ে ওঠেনি। দলগুলোর ভেতরে ও বাইরে কোন্দল আর ক্ষমতাকেন্দ্রিক হওয়ার কারণে প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারেনি। প্রয়োজন হয়েছিল অরাজনৈতিক ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’। তা-ও পরে টেকেনি। উদার গণতন্ত্র আর সমাজ গড়ে ওঠেনি। ক্রমেই সংকুচিত হয়েছে রাজনৈতিক ময়দান। বাংলাদেশের রাজনীতি আজ যে জায়গায় পৌঁছেছে, অবশ্যই তা রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিকদের ব্যর্থতা। এ ব্যর্থতার দায় বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের, বিশেষ করে বড় দুই দলের। সরকারে অধিষ্ঠিত দলের ওপর এখন ইচ্ছা-অনিচ্ছা নির্ভর করছে। দেশ এখন এক চাকার গাড়ির মতো। রাজনীতি ও গণতন্ত্র দেশের দ্রুত উন্নতির অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সেখানেই বড় বিপদ।
বাংলাদেশে বর্তমানে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারেন একজন, তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরি। ভালো অনেক কিছুর কৃতিত্বেরই তিনি দাবিদার, তাই জাতির ভবিষ্যতের স্বার্থে বঙ্গবন্ধুর উদার রাজনীতির স্বপ্ন ও সমগ্র জীবনের সংগ্রামের বাস্তবায়ন একমাত্র শেখ হাসিনার দ্বারাই সম্ভব। অন্যথায় অরাজনৈতিক শক্তি ভবিষ্যতে সব অর্জন নষ্ট করতে পারে। তেমনটা আমরা চাই না। পরবর্তী প্রজন্মকে উদার সমাজ ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য তৈরি করার দায়িত্ব প্রবীণদের। আমরা আমাদের দায়িত্ব আদৌ পালন করছি কি না, ভেবে দেখতে হবে।
উন্নয়নশীল বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির জনকের জন্মশতবর্ষ সাড়ম্বরে উদ্যাপিত হয়েছে, এমনটিই প্রত্যাশিত ছিল। তবে এমন উৎসবে কেন সাধারণ জনগণ যুক্ত হতে পারেননি, এটা উপলব্ধি করার দরকার আছে। তদুপরি সুবর্ণজয়ন্তীর উৎসবের সময় যে ১৬টি প্রাণ ঝরে গেল, সেটা এড়ানোর পথ নিশ্চয়ই ছিল। এ জন্য কে দায়ী, সে বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, এমন পরিস্থিতি কাম্য ছিল না।
● ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)