সরকারের সমালোচনামূলক কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ!

সালেহ্‌ উদ্দিন :  জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুককে নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ উঠেছে। ফেসবুকের দেশি-বিদেশি বাংলা ভাষাভাষী দর্শকদের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যবহারকারী জানিয়েছেন, তারা আগের মতো কনটেন্ট, বিশেষ করে সরকারের সমালোচনা সংক্রান্ত কোনো ভিডিও ক্লিপ দেখতে পাচ্ছেন না। এমনকি নিউজ ফিডে  চলমান রাজনৈতিক ইস্যুর কোনো পোস্টও দেখা যাচ্ছে না। তাদের নিউজ ফিডে এখন ২০২১  এবং ২০২২ সালের পুরনো কনটেন্টগুলো ঘুরেফিরে আসছে। একই সঙ্গে অশ্লীল ভিডিও ক্লিপেও ভরে গেছে। এগুলো রাজনৈতিক কারণে পরিকল্পিতভাবে করা হচ্ছে বলে তারা অভিযোগ করছেন। ফেসবুকের এই নিয়ন্ত্রণ সরকার নিজে নাকি ফেসবুক কর্তৃপক্ষ করছে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যদিও পদত্যাগী ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বিবিসিকে জানিয়েছিলেন, সেপ্টেম্বর থেকে ফেসবুক ও ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণে সরকার সক্ষম হবে। তিনি বলেছিলেন, রাষ্ট্র ইচ্ছা করলে যেকোনো ওয়েবসাইট নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখে।

কিন্তু ফেসবুক বা ইউটিউবের ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় না, যেহেতু সেটা মার্কিন প্রতিষ্ঠান। সেখানকার স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করে তারা পরিচালনা করে, তাই আমরা হস্তক্ষেপ করতে পারি না।

কিন্তু আশা করছি, আমরা এক্ষেত্রে সরাসরি হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা অর্জন করবো। ফলে কেউ ইচ্ছা করলেই ফেসবুক-ইউটিউবে যা খুশি প্রচার করতে পারবে না। সাবেক মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বিবিসিকে আরও বলেছিলেন, এখন পর্যন্ত পর্নো বা অন্য ক্ষতিকর ওয়েবসাইট বন্ধ করতে পারে সরকার। তবে ফেসবুক বা ইউটিউবের মতো সামাজিক মাধ্যমে কোনো ক্ষতিকর উপাদান বন্ধ করতে হলে সেই প্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ করতে হয়। অনেক সময় তারা ব্যবস্থা নিলেও তাতে সময় বেশি লাগে। আবার অনেক সময় তারা কোনো ব্যবস্থা নেয় না। এই সমস্যা সমাধানে সরকার এসব কনটেন্ট রোধ করার সক্ষমতা অর্জন করার ব্যবস্থা নিয়েছে। কীভাবে এটা করা হবে তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রযুক্তির মাধ্যমেই সেটা করা হবে।

মন্ত্রীর এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ধারণা করা হচ্ছে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকারের সমালোচনামূলক কনটেন্ট সরকার বন্ধ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে  নিয়ন্ত্রণ  করে থাকতে পারে।
এসংক্রান্ত বিষয়ে গত ২২শে অক্টোবর বিদেশি একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালেও একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) এবং ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) যৌথভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। উচ্চ পর্যায়ের এক যৌথসভায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কমপক্ষে ৪৮ ঘণ্টা আগে সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়া ব্লক করার সিদ্ধান্ত হয়। ওই সভায়, বাংলাদেশের ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সি (ডিএসএ) একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, যে তার সংস্থা সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রিন করার জন্য বিটিআরসি এবং এনটিএমসি’র সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় কাজ করছে।

ফেসবুকে নিয়ন্ত্রণের ফলে জনপ্রিয় কনটেন্ট নির্মাতা এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকার মোস্তফা ফিরোজ, কায়সার কামাল, পিনাকী ভট্টাচার্য্য, গোলাম মোর্তোজা, ড. জাহেদ-উর রহমান, মনির হায়দার, শাহেদ আলম, ড. কনক সরওয়ার প্রমুখদের ভিডিও নিউজ ফিডে দেখা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অগ্রহী দর্শকরা শুধুমাত্র তাদের ফেসবুক ওয়ালে গেলে তা দেখতে পারছেন। এ বিষয়ে সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার মনির হায়দার ও শাহেদ আলম জানান, তারা বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন দর্শকদের শত শত মেসেজ পাচ্ছেন। তারা অভিযোগ করছেন গত এক সপ্তাহ ধরে আমাদের কোনো ভিডিও ক্লিপ তারা পাচ্ছেন না। শাহেদ আলম বলেন, যেখানে আমার একটি ভিডিওতে কয়েক লাখ ভিউয়ার থাকতো সেখানে এটি হাজারে ঠেকেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জাহেদ-উর রহমানও একই ধরনের অভিযোগ করেছেন। তিনি এটিকে সংবিধানে প্রদত্ত মত প্রকাশের স্বাধীনতার লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, ফেসবুক কর্তৃপক্ষ যদি এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ না নেন তাহলে আমি হয়তো ফেসবুক বর্জন করবো। এভাবে নিয়ন্ত্রণ হলে বাংলাদেশে ফেসবুক তাদের জনপ্রিয়তা হারাবে এবং তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থও ক্ষুণ্ন হবে।

সিনিয়র সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকার মনির হায়দার বলেন, আমাদের মৌলিক অধিকার রক্ষার দায়িত্ব সাংবিধানিক আদালতের। সাংবিধানিক আদালত হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের নিষ্ক্রিয়তার কারণে সরকার জনগণের টুঁটি চেপে ধরেছে।

মানব জমিন