সুপ্রিম কোর্ট বার নির্বাচনে পুলিশ-গুণ্ডাদের ফ্যাসিস্ট হামলা

১৫ মার্চ ২০২৩

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির (২০২৩-২৪) নির্বাচনে ভোট ডাকাতির প্রতিবাদ করলে পুলিশ ও আওয়ামী গুণ্ডারা যৌথভাবে ফ্যাসিস্ট হামলা চালিয়েছে

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির (২০২৩-২৪) নির্বাচনে ভোট ডাকাতির প্রতিবাদ করলে পুলিশ ও আওয়ামী গুণ্ডারা যৌথভাবে ফ্যাসিস্ট হামলা চালিয়েছে

নিজস্ব প্রতিনিধি

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির (২০২৩-২৪) নির্বাচনে ভোট ডাকাতির প্রতিবাদ করলে পুলিশ ও আওয়ামী গুণ্ডারা যৌথভাবে ফ্যাসিস্ট হামলা চালিয়েছে। এতে পুলিশের বেপরোয়া লাঠিচার্জের মুখে পড়েন সাধারণ আইনজীবীরা। আওয়ামী গুণ্ডা ও পুলিশের হামলায় বেশ কয়েকজন আইনজীবী এবং সাংবাদিক আহত হয়েছেন।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির মিলনায়তনের (ভোটকেন্দ্র) ভেতরে বুধবার (১৫ই মার্চ) সকাল ১০টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। শেখ হাসিনার অধীনে আগামী নির্বাচন কেমন হবে এর একটি নমুনা এবার দেখা গেছে সুপ্রিমকোর্ট বার-এর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে।

ঘোষিত তফসিল অনুসারে, সমিতির দুই দিনব্যাপী এ নির্বাচন বুধবার (১৫ই মার্চ) ও বৃহস্পতিবার (১৬ই মার্চ) হওয়ার কথা।

বুধবার সকাল ১০টায় ভোট গ্রহণ শুরুর কথা ছিল। সমিতির ভোট পরিচালনার জন্য গঠিত নির্বাচন কমিশনের প্রধান মনসুরুল হক হঠাৎ করেই নিজেকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেন সোমবার। সমিতির ব্যালট নির্বাচনের জন্য ব্যালট পেপার ছাপা নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও দখলদার সেক্রেটারি আবদুন নূর দুলালের সাথে বিরোধ হয় নির্বাচন কমিশনের প্রধানের। এই বিরোধকে কেন্দ্র করেই তিনি পদত্যাগ করেন। কারণ, কমিশন প্রধানকে না জানিয়ে সমিতির দখলদার সেক্রেটারি ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুন নূর দুলাল নিজেই ব্যালট পেপার ছাপিয়ে নেন। এতে নির্বাচন কমিশনের প্রধান মনসুরুল হক আপত্তি জানালে তাঁকে আবদুন নূর দুলালসহ বেশ কয়েকজন আওয়ামী আইনজীবী হুমকি দেয় বলে জানা গেছে। হুমকির পরই তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিলেন।

মনসুরুল হকের পদত্যাগরে পর নির্বাচন পরিচালনা কমিটি নিয়ে বিরোধী দল সমর্থক আইনজীবীদের নীল প্যানেল ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের সাদা প্যানেলে মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়। মঙ্গলবার এনিয়ে এক দফা হামলা চালায় আওয়ামী আইনজীবী গুণ্ডারা। ভোটের আগের দিন মঙ্গলবার বিকালে আবদুন নূর দুলালের নেতৃত্বে আওয়ামী সন্ত্রাসী আইনজীবী, সশস্ত্র পুলিশ ও ছাত্রলীগের বহিরাগত গুণ্ডারা ব্যালট পেপার ও ব্যালট বাক্স সংরক্ষণ করার কক্ষে গিয়ে সীল মারার উদ্যোগ নেয়।

এই খবর পেয়ে নীল প্যানেলের সভাপতি প্রার্থী মাহবুব উদ্দিন খোকন এবং সেক্রেটারি প্রার্থী রুহুল কুদ্দুস কাজলসহ আইনজীবীরা সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলে আওয়ামী গুণ্ডা এবং পুলিশ মিলে তাদের উপর হামলা চালায়। এতে আগের রাতেই আওয়ামী গুণ্ডাবাহিনী ও পুলিশ সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণ তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়।

বুধবার সকালে ভোট শুরুর আগে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-সমর্থিত আইনজীবীদের মধ্যে কথা-কাটাকাটি হয়। ‘আগে চাই কমিশন, তারপরে নির্বাচন’ বলে এ সময় বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের মিলনায়তনের ভেতরে স্লোগান দিতে দেখা যায়।

সকাল পৌনে ১০টার দিকে মিলনায়তনে গিয়ে দেখা যায়, বিএনপি-সমর্থিত প্যানেল থেকে মনোনীত সম্পাদক প্রার্থী মো. রুহুল কুদ্দুসের সঙ্গে নির্বাচন পরিচালনা-সংক্রান্ত উপকমিটির একজন সদস্যের কথা-কাটাকাটি চলছে। অন্যদিকে উপ-কমিটির পক্ষ থেকে বারবার প্রার্থীদের নির্ধারিত জায়গায় যেতে বলা হচ্ছিল। এ সময় আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা ‘ইয়েস, ইয়েস’ বলে রব তোলেন।

একপর্যায়ে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত এক আইনজীবীর সঙ্গে বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের ধাক্কাধাক্কি হয়। পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করেন সমিতির সভাপতি মোমতাজ উদ্দিন ফকির। তিনি আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্যানেল থেকে এবারের নির্বাচনে সভাপতি প্রার্থী।

কিছুক্ষণ পর বিএনপি-সমর্থিত প্যানেল থেকে সভাপতি প্রার্থী মাহবুব উদ্দিন বলেন, ‘কমিশন বিষয়ে সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত নির্বাচন হবে না।’

এ সময় বিএনপি-সমর্থিত আইনজীবীরা ‘ইয়েস, ইয়েস’ বলে রব তোলেন। এর পক্ষে-বিপক্ষে হইচই ও হট্টগোল শুরু হয়। বেশ কিছুক্ষণ তা চলে।

দুই পক্ষের এমন উত্তপ্ত পরিস্থিতির মুখে বেলা ১১টার ৪০ মিনিটের দিকে সমিতির মিলনায়তনে পুলিশ প্রবেশ করে। আওয়ামী পুলিশ ঢুকেই বিএনপিপন্থী আইনজীবী ও সাংবাদিকদের ওপর বেপরোয়া লাঠিচার্জ শুরু করে। পুলিশের কিল, ঘুষি ও লাথিতে আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন আইনজীবী ও সাংবাদিক।।

পুলিশের লাঠিচার্জে আহত সাংবাদিকদের মধ্যে রয়েছেন- জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ফজলুল হক মৃধা, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার জান্নাতুল ফেরদৌস তানভি, এটিএন নিউজের রিপোর্টার জাবেদ আক্তার, বৈশাখী টিভির ক্যামেরাপারসন ইব্রাহিম হোসেন, মানবজমিনের মাল্টিমিডিয়া রিপোর্টার আব্দুল্লাহ আল মারুফ, এটিএন বাংলার ক্যামেরাপারসন হুমায়ুন কবির, সময় টিভির ক্যামেরাপারসন সোলাইমান স্বপন, ডিবিসি নিউজের ক্যামেরাপারসন মেহেদী হাসান মিম ও আজকের পত্রিকার নিজস্ব প্রতিবেদক এস এম নূর মোহাম্মদসহ আরও কয়েকজন।

পুলিশের মারধরের শিকার সাংবাদিক ফজলুল হক মৃধা জানিয়েছেন, ভোটগ্রহণ বন্ধ হওয়ার পর সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ দুপক্ষের পাল্টাপাল্টি অবস্থানে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এসময় পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুলিশের অতর্কিত হামলার শিকার হন সাংবাদিকরা। পুলিশ আমাদের ওপর বেপরোয়া লাঠিচার্জ চালায় এবং কিল-ঘুষি মারে।

বিএনপিপন্থী আইনজীবী ও সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও মারধর করে বের করে দেয়ার পর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরু হয়।

এ হামলার ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে এর প্রতিকার চেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করেছেন ল’ রিপোর্টার্স ফোরাম (এলআরএফ) নেতারা।

উল্লেখ্য, সভাপতি ১টি, সহসভাপতি ২টি, সম্পাদক ১টি, কোষাধ্যক্ষ ১টি, সহসম্পাদক ২টি, সদস্যের ৭টিসহ মোট ১৪টি পদে এক বছর মেয়াদের জন্য এ নির্বাচন হয়ে থাকে।

সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির ১৪টি পদের মধ্যে বর্তমান সভাপতি, সম্পাদকসহ ৭টি পদে আছেন আওয়ামী লীগ–সমর্থিত আইনজীবীরা। সহসম্পাদক, কোষাধ্যক্ষসহ অন্য ৭টি পদে আছেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা।

এবারের নির্বাচন পরিচালনার জন্য আগে সমিতির বর্তমান সম্পাদক মো. আবদুন নূর (আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্যানেল থেকে নির্বাচিত) আইনজীবী শাহ খসরুজ্জামানকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের উপকমিটি ঘোষণা করেছিলেন।

অন্যদিকে কার্যনির্বাহী কমিটির সিনিয়র সহসম্পাদক মাহফুজ বিন ইউসুফ (বিএনপি সমর্থিত প্যানেল থেকে নির্বাচিত) আইনজীবী এ জেড এম ফরিদুজ্জামানকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের উপকমিটি ঘোষণা করেছিলেন।

তবে ২রা মার্চ উভয় পক্ষের সম্মতিতে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির এবারের (২০২৩-২০২৪) নির্বাচন পরিচালনার জন্য সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. মনসুরুল হক চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যবিশিষ্ট উপ-কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছিল। গত সোমবার মনসুরুল হক চৌধুরী পদত্যাগপত্র দেন।

এবারের নির্বাচনে সাদা প্যানেল থেকে সভাপতি পদে এডভোকেট মোমতাজ উদ্দিন ফকির এবং সম্পাদক পদে আবদুন নূর দুলাল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। দু’জনই সুপ্রিম কোর্ট বারের বর্তমান কার্যনির্বাহী কমিটির সভাপতি ও সম্পাদক। অন্যদিকে নীল প্যানেল থেকে সভাপতি পদে ব্যারিস্টার এম মাহবুব উদ্দিন খোকনকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। এর আগে তিনি সমিতির বেশ কয়েকবারের সম্পাদক ছিলেন। এ প্যানেল থেকে সম্পাদক পদে সাবেক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল নির্বাচনে লড়ছেন।