উগান্ডায় ন্যাম সম্মেলন সেরে মঙ্গলবার দুপুরের কিছু আগেই ঢাকায় ফেরেন নয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। বাসায় গিয়ে কোনো রকম গোসল ও দুপুরের খাবার খেয়ে চলে আসেন সেগুনবাগিচার নিজ দপ্তরে। সেখানে আগে থেকে তার প্রোগ্রাম ঠিক করা ছিলো। বেলা ৩ টায় বিশ্ব ব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টরের সঙ্গে সৌজন্য বৈঠক করেন। এর পরেই আসেন পূর্ব নির্ধারিত সংবাদ সম্মেলনে।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি উগান্ডায় তার কর্মযজ্ঞের ফিরিস্তি তুলে ধরার পাশাপাশি সেখানকার মানুষেরও ভূয়সী প্রশংসা করেন। বলেন- তারা খুব মিশুক, হাসিখুশি। সেখানে চট্টগ্রামের দু’জন লোকের সঙ্গেও নাকি তার কথা হয়েছে। কথা হয়েছে দু’জন নারী কর্মকর্তার সঙ্গেও। যারা তাকে জানিয়েছেন উগান্ডা দেশটিতে তারা খুব সুখে আছেন, নিরাপদে আছেন। রাত ২ টা আড়াইটায়ও তারা উবার নিয়ে নির্বিঘ্নে যে কোনো যায়গায় যেতে পারেন। মন্ত্রীর মুখে উগান্ডার এমন চমকপ্রদ তথ্যে আমরাও চমকিত হই। মনে মনে ভাবি, তাহলে উগান্ডা নিয়ে এতোদিন মনের মধ্যে যে নেতিবাচক ধারণা পুষে রেখেছি তার কী হবে?
মন্ত্রী দুই দিনে সেখানে ১৭ টি দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছেন। প্রথম দিনে ১২ টি আর শেষ দিন ৫ বৈঠকে যাদের সঙ্গেই বৈঠক করেছেন তারাই নাকি সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বিশ্বব্যাপী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের এমন প্রশংসার খবর টের পেয়ে বিএনপির মাথা খারাপ হয়ে গেছে সে কথাও বলতে ছাড়েননি তথ্য ও তত্ত্বের যাদুকর এ মন্ত্রী।
তবে তিনি সবচেয়ে পুলকিত হয়ে যে প্রসঙ্গটি টেনেছেন সেটি হলো ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়। তিনি বলেন, ‘ভারতের ‘মহামান্য’ পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে তার বৈঠক হয়েছে। এর আগেও তিনি চিঠি লিখে প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এবার বৈঠকেও মহামান্য পররাষ্ট্র মন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।’ এমন আরো অনেক স্তুতি বাক্য।
এতোদিন ‘মহামান্য’ শব্দটির ব্যবহার কেবল রাষ্ট্রপতির বেলায় শুনেছি। কখনো প্রধানমন্ত্রীর বেলায়ও শুনিনি। তাই প্রথমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রীর মুখে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর নামের আগে ‘মহামান্য’ শব্দটি শুনে একটু খটকা লাগে। মনে মনে ভাবি হয়তো স্লিপ অব টাং। কিন্তু না তিনি এভাবে বেশ কয়েক বার জয়শঙ্করের নামের পূর্বে মহামান্য বললেন।
সাংবাদিকতার সুবাদে দীর্ঘদিন ধরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কেন্দ্রিক সংবাদ সংগ্রহ ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাওয়া হয়। এমন অনেক দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর গমনাগমনের খবর সংগ্রহ করেছি। সংবাদ সম্মেলনে আমাদের দেশের অন্তত তিনজন পররাষ্ট্র মন্ত্রীর কাছ থেকে এ ধরণের তথ্য পেয়েছি। কিন্তু কাউকে কখনো কোনো দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর নামের পূর্বে ‘মহামান্য’ বলতে শুনিনি।
সংবাদ সম্মেলনের শেষ দিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয় সীমান্তে বিজিবি হত্যার বিষয়ে। যশোরের বেনাপোল সীমান্তে বিএসএফ গুলি করে একজন বিজিবি সদস্য মেরে ফেলেছে এ ঘটনায় ভারতের তরফে কোন বক্তব্য এসেছে কি-না? জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ‘এ নিয়ে এখনই কথা বলতে চান না’ বলে প্রশ্নটি এড়িয়ে যান।
সেখানে বিজিবি জোয়ান নিহত হওয়ার ঘটনা বিষয়ক প্রশ্নে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “দেখুন… আমি আজ দুপুরে ফিরেছি (উগান্ডা থেকে)। আমি ডোমেস্টিক (অভ্যন্তরীণ) কোনো বিষয়ে এখনো মনোযোগ দিতে পারিনি। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যদি কোন বক্তব্য থাকে, সেটি অবশ্য আপনাদের বলা হবে। এ বিষয়ে আমরা এখন কথা বলতে চাই না। ‘
সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা নতুন কোনো ইস্যু নয়। যুগের পর যুগ এটি চলছে। বিশেষ করে গত দেড় দশকে অসংখ্য বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফ। এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও জার্মান ভিত্তিক বাংলা সংবাদ মাধ্যম ডয়েচেভেলের এক প্রতিবেদনে দেখা যায় ২০১৫ সাল থেকে এ পর্ন্ত বিএসএফের হাতে ২৫৬ বাংলাদেশি নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে অন্তত ৩০০ জন। এসব হত্যাকান্ডের প্রতিশোধতো দূরের কথা কথনো ঢাকার পক্ষ থেকে শক্ত কোনো প্রতিবাদও জানানো হয়নি।
৭ জানুয়ারির দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ মোট ৩টি নির্বাচনেই ভারত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছে। তাদের কারণেই আওয়ামী লীগ এদেশের জনগণের ভোট ছাড়াই ক্ষমতার মসনদ আঁকড়ে রেখেছে। হয়তো সে কারনেই একজন পররাষ্ট্র মন্ত্রীর নাম নিতে গেলেও আমাদের মুখ থেকে শ্রদ্ধা আর ভক্তিতে ‘মহামান্য’ শব্দ বের হয়ে আসে। হয়তো এই অতিরিক্ত শ্রদ্ধা ও রেওয়াজ বিবর্জিত ভক্তর কারণেই কমছে না সীমান্ত হত্যা। ফেলানী থেকে বিজিবি সদস্য রইস উদ্দিন সবার জীবনই এই ‘মহামান্য’দের কাছে মূল্যহীন।
বাংলা আউটলুক