এক দশকে বৈদেশিক ঋণ শঙ্কার জায়গায় পৌঁছেছে

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : বৈদেশিক ঋণ ১০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানো একটি বড় দায় হিসেবে হাজির হয়েছে। এ ঋণ পরিশোধ করা যে খুব সহজ হবে—এমন নয়। এখন রিজার্ভ যে পর্যায়ে রয়েছে এবং ভবিষ্যতে রিজার্ভ যদি না বাড়ে, প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ বা এফডিআই, রেমিট্যান্স যদি না বাড়ে তাহলে আমাদের জন্য সে ঋণ পরিশোধ করা কঠিন হয়ে যাবে। বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে আমরা কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ঋণ ডিফল্ট (খেলাপি) করিনি। পাশের দেশ পাকিস্তান যেমন কয়েকবার ডিফল্ট করেছে, আইএমএফ উদ্ধার করেছে। গত বছর শ্রীলংকা ঘোষণা করেছে তারা ডিফল্ট, অর্থ ফেরত দিতে পারবে না। সে হিসেবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। ঋণদাতাদের কাছে এখনো বাংলাদেশ আস্থাজনক জায়গায় রয়েছে। তবে ঋণের পরিমাণ আগে যে হারে বেড়েছে সেভাবে বাড়লে হয়তো আমাদের এত চিন্তা করতে হতো না। কিন্তু গত ১০ বছরে ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি বেড়ে গেছে। সেটা একটা শঙ্কার বিষয়। আগে যেভাবে বেড়েছে সেভাবে বাড়তে থাকলে এভাবে এতটা চিন্তা করতে হতো না। ১০ বছরে এটা বহু গুণ বেড়ে গেছে। সে হিসাবে তা পরিশোধ কঠিন হবে। আরেকটা বিষয় লক্ষ করা উচিত, ঋণের প্রিন্সিপাল (মূল) ও সুদ দুই-ই পরিমাণে বেড়েছে। আমাদের ঋণের উল্লেখযোগ্য অংশই দ্বিপক্ষীয় (বাইলেটারেল) ও হার্ড লোন, সফট লোন নয়। যেমন এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি), বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের দেয়া লোন কিন্তু সফট লোন, যাদের সুদের হার অনেক কম। সফট লোনে সুদহার ১ শতাংশ থেকে ১ দশমিক ২৫ শতাংশের মতো থাকে। সফট লোনের গ্রেস পিরিয়ড এবং রিপেমেন্ট পিরিয়ড বেশি (কখনো কখনো তা ২০-২৫ বছর)। কিন্তু আমরা বিভিন্ন দেশ ও বাণিজ্যিক উৎস থেকে অনেক ঋণ নিয়েছি, যা বাইলেটারেল বা দ্বিপক্ষীয় ঋণ। বিভিন্ন উৎস থেকে নেয়া সরকারি ও বেসরকারি ঋণের সুদও কিন্তু বেশি। এগুলোর বেশির ভাগই কিন্তু স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি। এখন আমাদের কাছে ইমিডিয়েট চ্যালেঞ্জটি হলো স্বল্পমেয়াদি ঋণগুলো ম্যাচিউর (পরিশোধ) করতে হবে। ২০২৬ থেকে অনেক ঋণ পরিশোধ শুরু করতে হবে। রূপপুর, পদ্মা সেতুসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে গৃহীত ঋণ পরিশোধ করতে হবে। সেটা আমাদের বিশাল একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে হাজির হবে।

বিশাল অংকের এ বৈদেশিক ঋণ কতটুকু যৌক্তিক ছিল সে প্রশ্ন উঠতে পারে। ২০২১ সালের আগস্টে আমাদের প্রায় ৪৮ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ ছিল। এ অবস্থায় আইএমএফ থেকে আমাদের ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়া হলো।

প্রথমত বলি, আমরা যে ঋণ ‍নিয়েছি তা যৌক্তিক কিনা। দেশী বা বিদেশী যেকোনো ঋণগ্রহণের ক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে তার  ইফেকটিভনেস বা কার্যকারিতা ও প্রয়োজন আছে কিনা। এটা অতিপ্রয়োজনীয় কিংবা প্রাধিকারভুক্ত হলেই আপনি বৈদেশিক ঋণ নেবেন। তা না হলে দেশীয় মুদ্রায় কাজ চালাবেন। বেশি প্রয়োজন ছাড়া বিদেশী ঋণ গ্রহণ উচিত নয়।  দ্বিতীয়ত, ইফেকটিভনেস; এটিকে ঠিকভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে কিনা। ঋণ যদি ঠিকমতো কাজে না লাগানো হয় তাহলে এর কার্যকারিতা থাকে না। বেসরকারি খাতে নেয়া অনেক ঋণ ঠিকমতো কাজে লাগছে না, ঋণ নিয়ে পাচার করে ফেলছে অনেকে। শোধ না করার কারণে ব্যাংকে ঋণখেলাপি হচ্ছে। বিদেশী ঋণের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। আমরা দেখতে পাই, বিদেশী ঋণ অনেকাংশেই সরকারের ঋণ। সরকার প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে। সে অর্থের অপচয় হচ্ছে। আর সবচেয়ে বড় কথা, প্রকল্পগুলো সময়মতো শেষ হয় না। পাঁচ বছরের প্রকল্প শেষ হতে সময় লাগে ১০ বছর। এতে ব্যয় বহু গুণ বেড়ে যায়। পদ্মা সেতু জরুরি ছিল, কিন্তু তা শেষ হতে কত সময় লাগল এবং ব্যয় কতগুণ বাড়ল? যেখানে ব্যয় হওয়ার কথা ছিল ১০ টাকা, সেখানে ব্যয় হলো ৩০ টাকা। কাজের সময় বেশি দীর্ঘায়িত হওয়ায় আমাদের সুদব্যয়ও কিন্তু বাড়ছে। আর এ ধরনের বৃহৎ প্রকল্পে অনেক অপচয় হচ্ছে, দুর্নীতি হচ্ছে। এজন্য যথার্থ ব্যবহারকে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রথমত, অগ্রাধিকার ঠিক করে নেয়া। ঋণ পেলেই নিতে হবে এ ধরনের চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মাল্টিলেটারেল ও বাইলেটারেল উৎসগুলো ঋণ দিতেই চাইবে, কিন্তু আমার প্রয়োজনটা তো দেখতে হবে। ঋণের প্রয়োজন অনুভব করলেই গ্রহণ করতে হবে। আমাদের এখানে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের ব্যাপারে এ ধরনের ভাবনা-চিন্তা দেখা যায় না।

আমাদের গৃহীত বৈদেশিক ঋণের আরেকটি শঙ্কার জায়গা হচ্ছে উচ্চ সুদহার। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাদের দ্বিপক্ষীয় ঋণ, হার্ড ঋণ মোটেও নেয়া উচিত নয়। কোনো দেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করলে ওই দেশের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের শর্তে পড়তে হয়। আইএমএফের ঋণের বিষয়টি হচ্ছে ব্যালান্স অব পেমেন্ট ঘাটতিতে সহায়তা করছে। আমাদের চলতি হিসাবে ঘাটতি রয়েছে, রফতানির চেয়ে আমদানি বেশি, রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে বলে আইএমএফ থেকে ঋণ গ্রহণ ঠিক আছে। এটা বড় অংকের লোনও নয়, ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার (৪৭০ কোটি ডলার)। কিন্তু মাল্টিলেটারেল (বহুপক্ষীয় গ্রুপ) এজেন্সি যখন ঋণ দেয়, তখন তা ইতিবাচক সংকেত দেয়। অন্য ঋণদাতারা মনে করে, আইএমএফ যেহেতু ঋণ দিচ্ছে, তার মানে ওই দেশের আর্থিক ভিত্তি মোটামুটি ঠিকঠাক আছে। আইএমএফ যেহেতু নানা শর্তে ঋণ দেয় তাহলে অন্যরা ভাবে সেখানে ঋণ প্রদান নিরাপদ। আইএমএফের ঋণ প্রদানের কারণে হয়তো জাইকা, এডিবি, বিশ্বব্যাংক তাদের ঋণ নিয়ে এগিয়ে আসবে। ইউরোপের কোনো দেশ হয়তো মনে করবে যেহেতু আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক ঋণ দিয়েছে তাহলে সেখানে বিনিয়োগ করা যায়। পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে তারা ঋণ দেয় এজন্য অন্যরা এ আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। আইএমএফ থেকে ঋণপ্রাপ্তি তাই আমাদের জন্য ইতিবাচক। কারণ অন্যরা আইএমএফ-বিশ্বব্যাংককে অনুসরণ করে। বেসরকারি খাত থেকে ঋণ ও বিনিয়োগ আকর্ষণেও কিন্তু তা ভূমিকা রাখতে পারে।

সম্প্রতি এসঅ্যান্ডপি, মুডি’স ও ফিচ ঋণমান কমিয়েছে। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের কাছে আমাদের আস্থার জায়গা ক্ষুণ্ণ হতে পারে। এটা অনেকটা আস্থায় ফাটল ধরেছে সার্বভৌম ক্রেডিট রেটিংয়ে। তিনটা রেটিংয়েই আমাদের অবস্থান নিম্নমুখী এবং পূর্বাভাসও (আউটলুক) ইতিবাচক জায়গায় নেই। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা কিন্তু এ ক্রেডিট রেটিং অনুসরণ করে। এ ক্রেডিট রেটিংটাও একেবারে স্বতঃসিদ্ধ, ধর্মীয় গ্রন্থের মতো আপ্তবাক্য নয়। তাদেরও ভুল থাকে, এটা একটি ইন্ডিকেটর বা সূচক। এর ওপর সম্পূর্ণ ভরসা করলে চলবে না। ঋণমান একটু অবনমন হলে খুব যে খারাপ হবে—এমন নয়। এ তিনটি সূচকের ওপর সবাই আস্থা রাখে। আমাদের দেশে এফডিআই এমনিতেই কম। সূচকের কথা বাদ দিলেও আমাদের কিন্তু বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নেই। রেগুলেটরি সংস্থা, প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, দুর্নীতি, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এসব জায়গায় ঘাটতি রয়েছে। ঋণমান কমার সঙ্গে সঙ্গে বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি না ঘটায় আমরা একটা ভঙ্গুর অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছি। আইএমএফের ঋণ শুধু আর্থিক দিক দেখছে তবে এর ব্যাপকতা আরো বেশি। এজন্য যে তারা গভর্ন্যান্স (সুশাসন), স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, অর্থ ঠিকভাবে ব্যয় হচ্ছে কিনা এসবের ওপর জোর দিচ্ছে। শুধু যে ব্যাংক, লেনদেন, ফরেন রিজার্ভ দেখে ঋণ দিচ্ছে তা নয়, এর পেছনে যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, সেগুলোর কী অবস্থা সেটা দেখে। ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে শুধু যে আর্থিক ও বাহ্যিক দিক দেখা হচ্ছে এমন নয়, ভেতরের ব্যবস্থাপনাও তারা দেখছে।

সম্প্রতি আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৯ বিলিয়নে নেমে এসেছে। অথচ ২০২১ সালে ছিল তা ৪৮ বিলিয়ন ডলার। আমাদের যে নিম্নমুখী ধারা, এতে অনেকের মনেই শঙ্কা, পরবর্তী কিস্তি পেতে অসুবিধা হতে পারে কি? তবে আমি মনে করি, দ্বিতীয় কিস্তি পেতে বড় কোনো সমস্যা হবে না। এরই মধ্যে আইএমএফ দেখে গেছে এবং বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে কথাবার্তা বলে গেছে। তারা কতগুলো শর্ত দিয়েছে, যেমন—আমাদের ব্যাংক খাত সংস্কার ও রাজস্ব আহরণে জোর দিতে বলেছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তিটা আসবে। আপনি প্রথম কিস্তিটা দিয়েছেন, দ্বিতীয়টা আটকে দেবেন—এমনটা হতে পারে না। তবে দ্বিতীয় কিস্তি পেয়ে বাংলাদেশ যদি মনে করে ‘‌আমরা তো পেয়েই গেলাম’ তাহলে ভয় আছে। এ আত্মতৃপ্তিতে ভুগলে চলবে না। এটি আমি আগেও বলেছি, এরা যদি শর্ত ছাড়া এভাবে ঋণ দিতেই থাকে তাহলে কিন্তু আমাদের বেশি লাভ হবে না। আমাদের নিজস্ব অনেক সংস্কারকাজ এগিয়ে নিতে হবে। শুধু আইএমএফ বলছে বিধায় করতে হবে—এমন নয়। যদি আর্থিক খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার না করি, তাহলে আইএমএফ ঋণ দিক বা না দিক—আমরা বিপদে পড়ব। দ্বিতীয় কিস্তি পেলে আমাদের কিছুটা উপকার হবে কিন্তু সব সমস্যার যে সমাধান হবে—এমন নয়।

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: বাংলাদেশ ব্যাংকের নবম গভর্নর

বনিক বার্তা