স্টাফ রিপোর্টার, সিলেট থেকে
৫ জুলাই ২০২৩, বুধবার
জিন্দাবাজার। সিলেট নগরের প্রাণকেন্দ্র। এক পাশে রয়েছে রাধা গোবিন্দ জিউর আখড়া। এক নামেই এ আখড়া পরিচিত। জিন্দাবাজারে আখড়ার অনেক সম্পত্তি। এই সম্পত্তি দেবোত্তর সম্পত্তি। বিক্রি নিষিদ্ধ। সেবায়েত কিংবা ভক্তরা ভোগদখল করতে পারবেন। কিন্তু এই সম্পত্তি বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। যে কমিটি এই সম্পত্তি বিক্রি করেছে সেটিরও আইনগত কোনো ভিত্তি নেই।
নিয়ে এখন আখড়ার ভক্তবৃন্দ ও বর্তমান পরিচালনা কমিটি মুখোমুখি অবস্থায় রয়েছেন। এদিকে ভক্তদের আবেদনের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটি কমিটির বৈধতার ব্যাপারে কোনো সত্যতা পায়নি। এ কারণে ভক্তদের দাবি; অবৈধ কমিটি যা করেছে সবই অবৈধ। এ ব্যাপারে তারা আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানান।
২০২২ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর রাধা গোবিন্দ জিউর আখড়ার ভক্তবৃন্দের পক্ষে নগরীর মিরের ময়দান এলাকার অনন্ত মোহন পাল নামে এক ব্যক্তি জেলা প্রশাসকের কাছে কমিটির বৈধতা চেয়ে একটি আবেদন করেন। এতে উল্লেখ করেন, রাধা গোবিন্দ জিউর আখড়ার অবৈধ কমিটি সুলেনামার মাধ্যমে ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি বা অনুমোদন ছাড়াই নামমাত্র মূল্যে আখড়ার ১১ ডেসিমিল ৪৪ পয়েন্ট ভূমি বেআইনিভাবে হস্তান্তর করেছে। কোটি কোটি টাকার এই ভূমি নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে স্বত্ব মামলা চলছিল। মামলাটি আদালতের বাইরে নিষ্পত্তির জন্য সুলেনামা তৈরি করেন মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সেক্রেটারি অসিত ভট্টাচার্য। মাত্র ১ লাখ ২০ হাজার টাকা মন্দিরের একাউন্টে জমা দেখিয়ে তিনি নিজে বা তার অবৈধ কমিটির সঙ্গে থাকা অন্যদের নিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন বলেও অভিযোগে উল্লেখ করেন অনন্ত মোহন পাল।
বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিকার ও দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান তিনি। তবে, অন্তত মোহন পাল জানিয়েছেন, বিক্রি হওয়া দেবোত্তর সম্পত্তি বর্তমান বাজারমূল্য হবে প্রায় ৮ কোটি টাকা। এখন এই সম্পত্তিতে দোকান কোটা বিদ্যমান রয়েছে। তার আবেদনের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক বিষয়টির তদন্ত করতে সিলেট মহানগর রাজস্ব সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. সম্রাট হোসেনকে দায়িত্ব দেন। দায়িত্ব পেয়ে স¤্রাট হোসেন চলতি বছরের ১৬ই ফেব্রুয়ারি শুনানির তারিখ নির্ধারণ করে অসিত ভট্টাচার্যসহ মোট ২১ জনকে নোটিশ দেন। তাদের সবাইকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে উপস্থিত থাকতে বলা হয়। সেদিন শুনানি হলেও এক পক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে আবারও শুনানি হয় গত ২রা মার্চ। সেদিন উভয়পক্ষ শুনানীতে উপস্থিত হন এবং প্রতিপক্ষ জবাব দাখিল করেন।
পরে ৯ই মার্চ সহকারী কমিশনার (ভূমি) সম্রাট হোসেন সিলেট সদরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর পাঠানো প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন- ‘রাধা গোবিন্দ জিউর আখড়ার মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির পক্ষে অসিত ভট্টাচার্য খসড়া কমিটি অনুমোদনের জন্য জেলা প্রশাসক বরারবর ২০০৪ সালের ৯ই জুন আবেদন করেছিলেন। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ২০০৬ সালের ২৮শে ডিসেম্বর সিলেট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর আবেদনটি পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু পরে আর এই কমিটি অনুমোদনের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।’ জিন্দাবাজারের পাঁচপীরের মাজার সংলগ্ন রাধা গোবিন্দ জিউর আখড়া সংলগ্ন সিলেট মিউনিসিপ্যালিটি মৌজার ৯১ জেএল নম্বরের ২৯২১ এসএ খতিয়ানের ৫৭১২, ৫৭১৭/৫৭৬৫নং দাগের মোট ১১ ডেসিমিল ৪৪ পয়েন্ট ভূমিতে বর্তমান ক্যাফে নূরজাহান রেস্টুরেন্ট, শাহী বেবি গ্যালারি ও মেসার্স সালাম এন্টারপ্রাইজের অবস্থান।
অসিত ভট্টাচার্যের কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে অনন্ত মোহন পাল গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করলে ২৯শে অক্টোবর জানতে পারেন ওই কমিটি ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ। পরে অভিযোগের প্রেক্ষিতে একাধিকবার তদন্তেও যা সত্য বলে প্রমাণিত হয়। এদিকে সিলেট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে ভূমি কমিশনারের প্রতিবেদনটি জেলা প্রশাসকের দপ্তরে পাঠানো হয়েছে গত মার্চ মাসের মাঝামাঝি। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় এখন রাধা গোবিন্দ জিউ আখড়ার ভক্তবৃন্দ। জেলা প্রশাসক তদন্ত রিপোর্টের আলোকে সিদ্বান্ত দেবেন। সিলেট সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) সম্রাট হোসেন গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে।
এখন ঊর্ধ্বতনরা পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। তবে আখড়ার বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক দিবাকর ধর রাম মানবজমিনকে জানিয়েছেন- ‘আখড়ার কমিটির কোনো বৈধতা জেলা প্রশাসক থেকে নিতে হয় না। সবাই মিলে যে কমিটি গঠন করেন সেটিই বৈধ। তাদের বর্তমান কমিটি বৈধ বলে দাবি করেন তিনি। তিনি জানান, সম্পত্তি বিক্রির ব্যাপারে তিনি অবগত নন। তবে তার দায়িত্বকালে যে সম্পত্তি ছিল সেটির কোনো বেদখল নেই। বর্তমানে সম্পত্তির ভাড়া তারা তুলছেন এবং দেখভাল করছেন।’ ভক্তবৃন্দের পক্ষে রাহুল দেবনাথ জানিয়েছেন- ‘প্রায় ৬ মাস আগে হিন্দু কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে ২৫ লাখ টাকার উন্নয়ন কাজ এসেছিল। আমাদের আপত্তির কারণে ওই টাকা বর্তমান অবৈধ কমিটিকে না দিয়ে ট্রাস্টের উদ্যোগে উন্নয়ন কাজ করা হচ্ছে।’ তিনি প্রশ্ন তুলেন- ‘যদি জেলা প্রশাসক থেকে কমিটির অনুমোদনের প্রয়োজন না হয় তাহলে ২০০৫ সালে কেন তারা জেলা প্রশাসকের কাছে কমিটি অনুমোদনের আবেদন করেছিল। সব অপকর্ম ধামাচাপা দিতে এখন এসব কথা বলা হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।’