সিন্ডিকেট–ছাত্রলীগ আছে, সরকার কোথায়?
ইংরেজি syndicate শব্দটি এসেছে ফরাসি syndicat থেকে। এটি ১৬২৪ সালে প্রথম ব্যবহৃত হয় কোনো কাউন্সিল বা প্রতিনিধিদের গোষ্ঠী বোঝাতে। তবে এখন নেতিবাচক অর্থেই সিন্ডিকেট শব্দটি বেশি ব্যবহার করা হয়। যেমন ক্রাইম সিন্ডিকেট, বিজনেস সিন্ডিকেট, মিডিয়া সিন্ডিকেট ইত্যাদি। বাংলাদেশে কোনো পণ্যের দাম বাড়লে বলা হয় সিন্ডিকেটের কারসাজি। কিন্তু এবার কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে যে সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে, তাঁরা দাম এতটাই কমিয়ে দিয়েছেন যে রাগে-ক্ষোভে-দুঃখে অনেক কোরবানিদাতা চামড়া বিক্রি না করে রাস্তায় বা নদীতে ফেলে দিয়েছেন, মাটি-বালুতে পুঁতে রেখেছেন। কোরবানির চামড়ার দাম পেলে লাভবান হয় মূলত লিল্লাহ মাদ্রাসার ছাত্র ও এতিমখানার এতিমেরা। ওসব প্রতিষ্ঠানের আয়ের অন্যতম উৎস কোরবানির চামড়া।
প্রতিবারের মতো এবারও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কোরবানির চামড়ার দাম ঠিক করে দিয়েছিল ঢাকায় প্রতি বর্গফুট ৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩৫ টাকা থেকে ৪০ টাকা। কিন্তু কোরবানির পর আড়তদারেরা বর্গফুটপ্রতি ১০ টাকাও দিতে রাজি হননি। ১ লাখ টাকা দামের গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ৩০০ টাকা কিংবা আরও কমে। কোরবানির চামড়ার দামে ধস নামার জন্য আড়তদার ও ট্যানারির মালিক একে অপরকে দুষলেও লাভবান হবে দুপক্ষই। আড়তদার পানির দামে যে চামড়া কিনেছেন, ট্যানারির মালিক নিশ্চয়ই তা দুধের দামে কিনবেন না। তাঁরাও কম দাম দেবেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এবারের কোরবানিতে চামড়া সিন্ডিকেট কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
কিন্তু বাজার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তথা সরকার কী করেছে? আমরা তাদের কোনো ভূমিকাই দেখলাম না। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, এর পেছনে ব্যবসায়ীদের কারসাজি ছিল। কথা বলা নয়, কারসাজি ধরাটাই তাঁর দায়িত্ব। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সিন্ডিকেট হয়ে থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এত বড় ঘটনার পরও সিন্ডিকেট হওয়া নিয়ে তাঁর প্রশ্ন! অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, চামড়ার দামও সরকারকে দেখতে হবে?
সরকার দায়িত্বশীল হলে সবকিছুই তার দেখার কথা। অর্থমন্ত্রীর যুক্তি মেনে নিলে বেসরকারি ব্যাংকের সুদের হারও সরকারের বেঁধে দেওয়ার কথা নয়। দাতা-গ্রহীতাই ঠিক করবেন তাঁরা কত সুদে ঋণ দেবেন বা নেবেন। কিন্তু সে রকম আদর্শ অবস্থা বাংলাদেশে কখনো আসেনি। ব্যাংকিং খাতের কুশীলবেরা সিন্ডিকেট করে সুদের হার ইচ্ছামতো বাড়িয়েছেন এবং যুক্তি দেখিয়েছেন, খেলাপি ঋণের কারণে এটি করতে হয়েছে।
এখন চামড়ার আড়তদারেরা অজুহাত তুলেছেন, ট্যানারির মালিকেরা গত বছরের বকেয়া টাকা না দেওয়ায় তাঁরা চামড়া কিনতে পারেননি। আর ট্যানারির মালিকেরা বলছেন, কাঁচা চামড়া রপ্তানি করলে শিল্পের সর্বনাশ হয়ে যাবে। দুই পক্ষ মিলেই গরিবের হক মারল এবং সরকার নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকল।
শুধু কোরবানির চামড়া নয়, এখন সবখানেই সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজি চলছে। গতকাল প্রথম আলো খবর দিয়েছে, ‘মহাসড়কে বছরে ৮৭ কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়।’ এটি কোনো গবেষণা সংস্থার খবর নয়। ২০১৮ সালের হাইওয়ে পুলিশের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য। মালিক-শ্রমিকের কল্যাণের নামে ২১৫টি সংস্থা ও সংগঠন বাস-ট্রাক থেকে চাঁদা তোলে। বেসরকারি হিসাবে দৈনিক মহাসড়কে সাড়ে ১০ কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয় (ইত্তেফাক, ৪ জানুয়ারি ২০১৮)। সড়ক ও সেতু দপ্তরের মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। কিন্তু সড়কে তাঁর নিয়ন্ত্রণ নেই। এটি নিয়ন্ত্রণ করে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। কোনো সরকারই এই সিন্ডিকেট ভাঙতে পারেনি। তাদের কারণেই ২০১৮ সালে সড়ক পরিবহন আইন করেও বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
কয়েক মাস ধরে আমরা সিটি করপোরেশনে আরেক ধরনের সিন্ডিকেট দেখেছি। মশক সিন্ডিকেট। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মশা মারতে যে ওষুধ এনেছে, বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাতে মশা মরে না। ঈদের আগে এ নিয়ে বেশ হইচই হলেও কার্যকর ওষুধ আনা হয়েছে, এমন খবর দিতে পারেনি তারা। তবে সংসদে স্বীকৃত যে বিরোধী দল আছে, সেই জাতীয় পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান বলেছেন, মশা মারার নামে দুই সিটি করপোরেশন ৫০ কোটি টাকা লুটপাট করেছে।
কিছুদিন ধরে দুই প্রধান দলের রাজনীতি প্রেস ব্রিফিং ও ঘরোয়া বৈঠকের মধ্যেই সীমিত। আওয়ামী লীগ ধানমন্ডিতে দলীয় সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে নিয়মিত ব্রিফিং করে থাকে। আর বিএনপি নয়াপল্টনে দলের প্রধান কার্যালয়ে। এসব প্রেস ব্রিফিংকে অনেকে ফটোসেশন বলেও আখ্যায়িত করেন। কোনো ইস্যু না থাকলেও তাঁরা কথা বলেন। আবার প্রকৃত ইস্যুকে এড়িয়ে যান।
ডেঙ্গু ও সড়কের বাইরে তিনটি ঘটনা কিছুটা উত্তাপ ছড়িয়েছে। এক. ফরিদপুরের নগরকান্দায় আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে দুজনের নিহত হওয়া। সেখানে আওয়ামী লীগের এক গ্রুপ দীর্ঘদিন এলাকাছাড়া ছিল। ঈদের আগে এলাকায় এলে দুই পক্ষর মধ্যে গোলাগুলিতে দুজন নিহত ও ১০ জন আহত হন।
দুই. পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলায় নিজের বাড়িতে ঈদ করতে গিয়ে ডাকসুর ভিপি নুরুল হক ও তাঁর ২০–২৫ জন সমর্থক আহত হন। তাঁর অভিযোগ, স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও শ্রমিক লীগ এই হামলা চালায়। হামলাকারীরা রড ও লাঠিসোঁটা দিয়ে এলোপাতাড়ি পিটিয়ে তাঁদের আহত করে। হামলাকারীরা এ সময় ১০টি মোটরসাইকেল ভাঙচুর এবং ৪টি মুঠোফোন, ২টি ডিএসএলআর ক্যামেরা এবং ৮৯ হাজার টাকা লুটে নেয়। স্থানীয় সাংসদ এস এম শাহজাদার নির্দেশে এই হামলা চালানো হয় বলে অভিযোগ করেন ভিপি নুরুল হক। এস এম শাহজাদা প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার ভাতিজা। দুজনই নির্বাচিত প্রতিনিধি। একজন ডাকসুর। আরেকজন জাতীয় সংসদের।
ডাকসু নির্বাচনের পর নুরুল হক গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর মধ্যে মায়ের প্রতিচ্ছবি দেখতে পান বলে মন্তব্য করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীও তাঁকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতা-কর্মীরা নুরুল হককে যেখানে পাচ্ছেন, সেখানেই পেটাচ্ছেন। রোজার সময় বগুড়ায় ইফতার অনুষ্ঠানে গেলে সেখানকার ছাত্রলীগের কর্মীরা তাঁকে বেদম প্রহার করেন। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও একাধিকবার তাঁর ওপর হামলা হয়েছে। নুরুল হকের ওপর এই আক্রোশ কেন? সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভোটে তিনি ছাত্রলীগ প্রার্থীকে হারিয়ে ভিপি হয়েছেন, এটাই কি তাঁর অপরাধ?
তিন. তবে মোহাম্মদপুরে ঈদের আগে স্থানীয় ছাত্রলীগ যে কাণ্ড ঘটিয়েছে, তা গিনেস বুকে নাম লেখানোর মতো। যশোর থেকে পাঁচ ব্যবসায়ী ট্রাকযোগে ২১২টি ছাগল নিয়ে এসেছিলেন কোরবানির হাটে বিক্রি করবেন এই আশায়। কিন্তু ৮-১০ জন ওয়াকিটকিধারী যুবক নিজেদের পুলিশ পরিচয় দিয়ে ট্রাকটি আটক করে মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে জহুরী মহল্লায় নিয়ে গিয়ে জিম্মি করেন এবং তাঁদের কাছ থেকে ছাগলপ্রতি ৫০ টাকা চাঁদা দাবি করেন। ১৩ ঘণ্টা জিম্মি থাকার পর এক ব্যবসায়ী কৌশলে তাঁর ভাইকে টেলিফোন করেন। এরপর ভদ্রলোক র্যাবকে খবর দিলে র্যাব ২–এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহর নেতৃত্বে একটি দল ২১২টি ছাগলসহ ট্রাকটি জব্দ করে এবং সেখান থেকে ইয়াসির আরাফাত (২৮), জাহিদুল ইসলাম (২৯) ও মো. রায়হান (২৭) নামে তিনজনকে পাঁচটি ওয়াকিটকিসহ গ্রেপ্তার করে। অন্যরা পালিয়ে যান। তাঁদের মধ্যে থানা ছাত্রলীগের সভাপতিও আছেন। এ ব্যাপারে দুটি মামলা হয়েছে। একটি ছিনতাই ও অন্যটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সরঞ্জাম ব্যবহারের। ছাত্রলীগের কর্মীদের দাবি, ডেঙ্গু সম্পর্কে এলাকাবাসীকে সচেতন করতে তাঁরা ওয়াকিটকিগুলো ভাড়া করেছিলেন। ডেঙ্গু–সচেতনতা কর্মসূচি কীভাবে ছাগল ছিনতাইয়ের চেষ্টায় রূপ নিল, সেই প্রশ্নের জবাব নেই।
মঙ্গলবার রাতে ইসলামবাগ এলাকার পোস্তার ঢালের ওপর একটি প্লাস্টিক কারখানায় আগুন লাগে। ঘণ্টা দুই চেষ্টায় আগুন নিভিয়েছে ফায়ার ব্রিগেড। চারদিকে দেয়ালের মধ্যে একটি বড় প্লটে গড়ে ওঠা একাধিক প্লাস্টিকের কারখানা ও গুদামও ছিল। এই দুর্ঘটনায় কত টাকার ক্ষতি হয়েছে, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হলো সেখানে নতুন করে প্লাস্টিকের কারখানা ও গুদাম স্থাপিত হলো কীভাবে? কে তাদের অনুমতি দিয়েছে?
২০১০ সালে নিমতলীতে রাসায়নিক কারখানায় আগুন লেগে ১২৪ জন মারা যান। এরপর মন্ত্রী-আমলারা ঘোষণা দিয়েছিলেন, পুরান ঢাকায় আর কোনো গুদাম-কারখানা থাকবে না। গত ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় প্লাস্টিকের গুদামে আগুন লেগে ৭১ জন মারা যাওয়ার পরও মন্ত্রী-মেয়ররা একই ঘোষণা দিলেন। তাঁরা কেরানীগঞ্জে আধুনিক রাসায়নিক শিল্প শহর গড়ার কথাও বললেন। ওই ঘোষণা পর্যন্তই। আরেকটি বড় দুর্ঘটনা না ঘটা পর্যন্ত সরকারের হুঁশ ফিরবে বলে মনে হয় না।
ডেঙ্গুতে মানুষ মরছে। সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মরছে। চামড়া সিন্ডিকেট গরিবের হক আত্মসাৎ করছে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ডাকসুর ভিপিকে যেখানে পাচ্ছেন পেটাচ্ছেন, ছাত্রলীগ ছাগলবাহী ট্রাক জব্দ ও ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে নিজেদের শক্তির জানান দিচ্ছে।
তাহলে সরকার কোথায়?
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি