মুদ্রিত সংস্করণ

জাতীয় রাজনীতিতে গণভোটের ইস্যু নতুন নয়, তবে জুলাই ২০২৫-এর এই পর্যায়ে তা নতুন মাত্রা পেয়েছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন এবং জাতীয় নির্বাচনের সময় নির্ধারণের বিষয়ে সরকারের সাত দিনের সময়সীমা আজ শেষ আর দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল- বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি ও অন্যরা এখন পর্যন্ত আলোচনার টেবিলে বসেনি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পরিস্থিতি নির্দেশ করছে যে, দেশের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আরো গভীর হচ্ছে এবং সরকারকে বাধ্য করছে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচনের সময় নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিতে। সরকার সিদ্ধান্ত নিলে সেটি সবাই মানবে কি না এ বিষয়ে নিশ্চিত কোনো আভাস পাওয়া যায়নি। সব মিলিয়ে আগামী এক সপ্তাহ বাংলাদেশের জন্য বেশ সংবেদনশীল।
রাজনৈতিক দলের অবস্থান
বিএনপি : বিএনপির অবস্থান অনেকখানি পরিষ্কার- তারা গণভোট চায় ভোটের দিনেই। দলটি মনে করে, জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটের মধ্যে বিরোধ তৈরি হলে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাচনপ্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে।
এক বিবৃতিতে বিএনপি উল্লেখ করেছে, ঐকমত্য কমিশনের দীর্ঘ আলোচনায় যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছে তা সব রাজনৈতিক দলের সম্মিলিত অংশগ্রহণে বাস্তবায়িত হওয়া উচিত। তারা কোনো নতুন প্রশ্ন তুলে সঙ্কট সৃষ্টি করতে চায় না। বিএনপি নেতা ইসমাঈল জবিউল্লাহ বলেন, ‘সরকার যদি জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন আমাদের প্রতিক্রিয়া নির্ভর করবে সিদ্ধান্তের প্রয়োগ ও জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা হয়েছে কি না সেটির ওপর। সরকারকে সচেতনভাবে, জন-আকাক্সক্ষাকে সম্মান জানিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
বিএনপির এই অবস্থান দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত দেয়। দলটি সরকারের নীতি ও আইনানুগ প্রক্রিয়ার প্রতি সহমত প্রকাশ করছে। গণভোটের সময় নির্ধারণে তারা রক্ষণশীল হলেও সরাসরি সঙ্ঘাত এড়িয়ে যাচ্ছে।
জামায়াতে ইসলামী ও সমমনা দলগুলো : অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, জাগপা এবং সমমনা আটটি রাজনৈতিক দল গণভোটের বিষয়ে অধিক তৎপর। তারা মনে করে, গণভোট অবশ্যই জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত, এবং সরকারের জন্য সময়সীমা দেয়ার পাশাপাশি কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন তারা। গত শনিবার ঢাকার জাগপার কার্যালয়ে আন্দোলনরত আট দলের লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠকের পর এই হুঁশিয়ারি প্রদান করা হয়।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও প্রচার বিভাগের প্রধান এহসানুল মাহবুব জোবায়ের নয়া দিগন্তকে বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ইস্যুতে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো বৈঠক জামায়াতের সাথে বিএনপি বা এনসিপির হয়নি। তিনি উল্লেখ করেন- জামায়াত আলোচনার বিষয়ে উন্মুক্ত। জামায়াতের আহ্বানে সাড়া না দেয়ার পর দলের পক্ষ থেকে আলোচনার জন্য বিএনপি ডাকলেও জামায়াত সাড়া দেবে বলে দলের নেতা হামিদুর রহমান আযাদ জানিয়েছিলেন। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো সাড়া মিলেনি।
অনানুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির সাথে কোনো যোগাযোগ রয়েছে কি না জানতে চাইলে জনাব জোবায়ের জানান, ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে সে রকম যোগাযোগ তো আছেই। এই যোগাযোগে দূরত্ব কমতে পারে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন সে রকম সম্ভাবনা তো থাকতেই পারে।
তিনি জানান- গণভোট ইস্যুতে আজ সমমনা দলগুলো বসে তাদের পরবর্তী কর্মসূচি সম্পর্কে ব্রিফিং করবেন।
জামায়াতের অপর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম জানান, জামায়াত সবসময় দেশের স্বার্থে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। তবে বিএনপির সাড়া না পাওয়ায় তারা সরকারের কাছ থেকে ন্যায্য ও জনসাধারণের চাহিদা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত আশা করছেন।
সরকারের ভূমিকা ও দায়িত্ব : রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারকেই মধ্যস্থতা ও সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব নিতে হবে। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাঈল জবিউল্লাহ উল্লেখ করেছেন, ‘রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা চালানোর জন্য একটি মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা প্রয়োজন। যেহেতু সরকার ড্রাইভিং সিটে আছেন, তাই মধ্যস্থতা ও সমঝোতার দায়িত্ব সরকারের।’
এটি নির্দেশ করে যে, রাজনৈতিক দলগুলো যখন ঐকমত্যে পৌঁছায় না, তখন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অগ্রগতির জন্য সরকারের নীতিনির্ধারণ অপরিহার্য। তবে সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রভাবও বিবেচনায় রাখতে হবে।
সরকারের একটি সূত্র জানিয়েছে- রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেনি সেহেতু সিদ্ধান্ত সরকারকেই নিতে হবে। তবে সব পক্ষের সাথে কথা না বলে তিনি সে সিদ্ধান্ত নিতে চান না। এ কারণে প্রধান উপদেষ্টা তার সিদ্ধান্ত ঘোষণার আগে প্রধান পক্ষগুলোর সাথে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিকভাবে কথা বলবেন।
রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব : গণভোটের সময় নির্ধারণের ইস্যু কেবল একটি প্রশাসনিক বিষয় নয়; এটি দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, জনমত এবং নির্বাচনী পরিবেশের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।
গণভোটের আগে জনগণের প্রত্যাশা ও চাহিদা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্লেষকরা মনে করেন, জনগণ চায় যে ভোট ও গণভোট আলাদা হলেও তা কার্যকর ও স্বচ্ছ হতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি জনগণের চাওয়াকে উপেক্ষা করে, তা রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং জনসমর্থনের ক্ষতি করতে পারে।
জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটের সমন্বয় নিশ্চিত করতে প্রশাসনিক প্রস্তুতিও অপরিহার্য। ভোটের দিন গণভোটের কারণে প্রশাসনিক চাপ বাড়তে পারে এবং নির্বাচনী পরিবেশে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
রাজনৈতিক সংঘাত ও আন্দোলন : জামায়াত ও সমমনা দলগুলো কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দিয়েছে। বিএনপি কোনো কর্মসূচি না দিলেও পাল্টা হুমকি নেতাদের বক্তব্যে রয়েছে। যদি সরকারের সিদ্ধান্ত জনগণের প্রত্যাশার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়, তাহলে ১১ নভেম্বরের জনসভা থেকে ৮ দলের বড় আন্দোলনের সম্ভাবনা রয়েছে। আবার পাল্টা কর্মসূচির সম্ভাবনাও রয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন- এই পরিস্থিতি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়। মধ্যস্থতা অপরিহার্য- সরকারের মধ্যস্থতা ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলো কখনো ঐকমত্যে পৌঁছাবে না। তাই সিদ্ধান্ত নেয়া সরকারের জন্য একটি জটিল, কিন্তু অপরিহার্য দায়িত্ব।
বিএনপি দেশের বৃহত্তম দল হিসেবে জনগণের চাহিদা ও রাজনৈতিক প্রভাবের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সমর্থন ছাড়া গণভোট ও নির্বাচন কার্যকরভাবে আয়োজন করা সম্ভব নয়। বিপরীত শক্তিকেও উপেক্ষা করা যাবে না।
গণভোট ও জাতীয় নির্বাচনের সমন্বয় করতে হলে সরকারকে জনগণের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, জনমতের প্রতি অবহেলা রাজনৈতিক উত্তেজনা ও স্থিতিশীলতার ক্ষতি করবে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন-রাজনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলায় সরকারকে রাজনৈতিক দল ও জনগণের প্রতিনিধিত্বকে সম্মান দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। গণভোট ও জাতীয় নির্বাচনের জন্য স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও সময়মতো প্রশাসনিক প্রস্তুতি জরুরি। রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে বসতে সরকারের জন্য উচিত হবে স্থির ও কার্যকর মধ্যস্থতা।
এটি ঠিক যে গণভোটের সময় নির্ধারণ ও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলো এখনো ঐকমত্যে পৌঁছায়নি। সরকারের কাছে এখন একটি জটিল, কিন্তু অপরিহার্য দায়িত্ব রয়েছে।
বিএনপি ভোটের দিন গণভোট চায়, তবে সঙ্ঘাত এড়িয়ে চলছে। জামায়াত ও সমমনা দল জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট চাইছে এবং কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দিলেও ঠাণ্ডা মাথায় এগুচ্ছে। সরকারকে জনমত, রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং আইনানুগ বাধ্যবাধকতা মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, সরকার যদি সচেতনভাবে এবং জনগণের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে সিদ্ধান্ত নেন, তবে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন সফলভাবে আয়োজন সম্ভব। অন্যথায়, রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং জনমত বিরোধের কারণে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
এই মুহূর্তে স্পষ্ট যে, গণভোট ও জাতীয় নির্বাচনের সময় নির্ধারণ দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার একমাত্র নির্ভরযোগ্য সূচক, এবং সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার সরকারের কাঁধে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ভারী।









