সিইসি কড়া নেড়েছেন, তবে ভুল দরজায়

‘ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে না যাওয়া মানে গণতন্ত্রের অপমৃত্যু’—প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের কাছ থেকে আসা খুবই শক্তিশালী একটি বক্তব্য। তিনি আরও বলেছেন, ‘গণতন্ত্র বাঁচাতে হলে, গণতান্ত্রিক চেতনার চর্চা করতে ভোটারদের অবশ্যই ভোটকেন্দ্রে আসতে হবে। আর ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে না এলে বুঝতে হবে গণতন্ত্রে অসুস্থতা আছে বা গণতন্ত্রের অপমৃত্যু হচ্ছে।’ সিইসি এ ক্ষেত্রে সঠিক কথা বলেছেন, তবে কারণ নির্নয়ে যৌক্তিকতার প্রমাণ দিতে পারেননি। 

প্রধান নির্বাচন কমিশনার গণতন্ত্র রক্ষার দায়িত্ব শুধু ভোটারদের ওপরই চাপিয়ে দিয়েছেন এবং তার বক্তব্যের মূল কথা হলো— ভোটাররা যদি ভোট না দেয়, তাহলে আমাদের গণতন্ত্রের ‘অপমৃত্যু’ ঘটবে। কীসের ভিত্তিতে সিইসির এই সতর্কবার্তা? কেন তিনি আশঙ্কা করছেন, ভোটাররা আগামী নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করবেন? এটা কী ভোটারদের উদাসীনতা— যার প্রমাণ আমরা বেশ কিছু ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে দেখেছি, নাকি অন্য কিছু? এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কী কোনো ভূমিকা থাকবে?

বিভিন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি প্রমাণ করে আমাদের দেশের মানুষ তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। সামরিক শাসকের অধীনে আয়োজিত নির্বাচনগুলোকে হিসাবে না ধরেও (যেগুলোতে প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছিলেন) জেনারেল এরশাদের পতনের পর অর্থাৎ, ১৯৯১ সালের পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে ভোটারের সংখ্যা বেশ আশাব্যঞ্জক ছিল। ২০০১ সালের পর এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৫ শতাংশেরও বেশি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ও প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় আসেন। ওই নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি ছিল ৮৭ দশমিক ১৩ শতাংশ। যা একটি নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে।

তাহলে, ২০২৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি নিয়ে সিইসি কেন দুঃচিন্তায় আছেন; যেখানে আমাদের আগের সব রেকর্ড বলছে, ভোটাররা সব সময় ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার জন্য উদগ্রীব থাকেন? ২০১৪ ও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত সবশেষ দুই জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের প্রক্রিয়ার মধ্যে এই প্রশ্নের উত্তর রয়েছে— যেভাবে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপর থেকে জনগণের আস্থা উঠে গেছে।

২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে একটি  ভোট না পড়লেও সেখানকার প্রার্থীরা ‘নির্বাচিত’ হন। ওই আসনগুলোতে যেহেতু একজনের বেশি প্রার্থী ছিলেন না, সেক্ষেত্রে নির্বাচন আয়োজনেরও কোনো প্রয়োজন দেখা দেয়নি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে— সবাই বিশ্বাস করে নির্বাচনের আগের রাতে ভোট প্রদান  হয়েছিল।

এই দুটি ঘটনার পর্যালোচনা করা যাক। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে (পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হন বলে সংরক্ষিত নারী আসন বাদে) ১৫৩ জন সংসদ সদস্যকে নির্বাচন কমিশন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ ঘোষণা করে।

কোনো আসনে মাত্র একজন প্রার্থী থাকার বিষয়টি নজিরবিহীন এবং বাংলাদেশের নির্বাচনী ঐতিহ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। যেসব প্রার্থীদের নির্বাচনে জেতার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না, তারাও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর মাধ্যমে তারা সমাজে কিছুটা পরিচিতি ও গুরুত্ব পান।

পরিসংখ্যান এবং ঐতিহাসিকভাবে অসম্ভব এই সংখ্যাটি কেন নির্বাচন কমিশনের মনে কোনো প্রশ্ন জাগায়নি? তারা কী জানতে চেয়েছিল, প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য করা হয়েছিল কি না, অথবা এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বল প্রয়োগ করা হয়েছিল কি না? সামান্য অনুসন্ধানেই জানা যেত, শেষ মুহূর্তে প্রার্থীতা প্রত্যাহারের বন্যা বয়ে গিয়েছিল।

ইসি কী বুঝতে পারেনি যে, ‘নির্বাচিত’ ১৫৩ জন সংসদ সদস্য ৩০০ আসনের সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ হবেন এবং এই ১৫৩ জন, নির্বাচনে যাদের পক্ষে একটি ভোটও পড়েনি সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য হিসেবে সরকারে যাবেন?

এই বিষয়টিকে ছাড় দিয়ে ইসি কী ভবিষ্যতে নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী ব্যক্তিদের প্রার্থিতা একইভাবে জোর করে প্রত্যাহার করিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্যদের জয়লাভের প্রবণতাকে উৎসাহিত করলো? আমরা  উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনে এ বিষয়টির পক্ষে প্রমাণ দেখেছি। ইসি কি এই প্রক্রিয়াকে স্বীকৃতি দিয়ে একইভাবে জোরপূর্বক প্রার্থিতা প্রত্যাহারকে উত্সাহিত করেনি, যাতে ভবিষ্যতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয় নিশ্চিত হয়? তার প্রমাণ আমরা অনেক ইউপি  নির্বাচনেও দেখছি।

নির্বাচন কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। যেখানে ১৯৯১, ১৯৯৬ (জুন), ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে একজন প্রার্থীও ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত’ হননি। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একজন প্রার্থীও নির্বাচিত না হওয়া অবস্থা থেকে ১৫৩ জন ‘নির্বাচিত’ হওয়ার পরও নির্বাচন কমিশনের চোখে কোনো ভুল ধরা পড়েনি।

এরপর আসে ২০১৮ সালের নির্বাচনের বিষয়টি, যেখানে সমগ্র নির্বাচনী প্রক্রিয়া জবরদখল এবং নির্বাচন পদ্ধতির সম্পূর্ণ ধ্বংসের স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের যেসব সংসদ সদস্য ভালোভাবে কাজ করেছিলেন, দীর্ঘদিন ধরে জনগণের জন্য কাজ করেছিলেন, যারা নিজদের নির্বাচনী এলাকায় জয় লাভের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, তারা এই প্রক্রিয়ার ‘প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের’ বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। জয়ের ব্যাপারে সংসদ সদস্যদের আত্মবিশ্বাসের বিষয়ে জানতে চাইলে তাদের সাধারণ উত্তর ছিল, ‘আমরা কোনো কিছু ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিতে পারি না।’

এরপর বেশ কয়েকটি উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে নির্বাচন কমিশনকে প্রকাশ্যে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়গুলো উপেক্ষা করতে দেখা যায়। সম্প্রতি এ ধরনের কিছু উদাহরণও আমরা দেখেছি, যা বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তিকে ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন করেছে।

২০১৪ সালে শুরু হওয়ার পর থেকে কয়েক বছর ধরে, বিশেষ করে ২০১৮ সালের নির্বাচন ছাড়াও বেশ কয়েকটি উপনির্বাচনের পর জনগণের কাছে ইসির আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে।

আগামী (২০২৩ সালের শেষ দিকে বা ২০২৪ সালের প্রথম দিকে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া) নির্বাচনে ভোটারা যদি ভোটকেন্দ্রে না যায়, তার অর্থ এই নয় যে ভোটাধিকার প্রয়োগের বিষয়ে তাদের আগ্রহ, জ্ঞান ও বোঝাপড়ার অভাব রয়েছে। বরং এর মূল কারণ হবে নির্বাচন প্রক্রিয়াটি যারা পরিচালনা করে, সেই নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থার অভাব।

সিইসির প্রতি আমাদের স্পষ্ট বার্তা হলো, আপনি যে প্রতিষ্ঠানটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তার প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনুন, তাহলে ভোটাররা নিজেরাই দলবেঁধে নির্বাচনে অংশ নেবেন। ভোটারদের নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে বরং আপনার নিজের প্রতিষ্ঠান নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া উচিৎ। নির্বাচন কমিশনকে ঠিক করুন, তাহলেই আমরা সবচেয়ে ভালো নির্বাচন পাব।

তবে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো: আপনি যে প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সেটাকে কি ঠিক করতে পারবেন? দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আপনার পূর্বসূরিরা (যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে কাজ করেছেন তারা ছাড়া) আপনার জন্য কোনো মর্যাদা ও সম্মানজনক ইতিহাস রেখে যাননি। তাদের ইতিহাস হচ্ছে ক্ষমতাবানদের সামনে নতজানু হওয়ার ইতিহাস।

অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ প্রধান নির্বাচন কমিশনার তার কমিশনের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করছেন; কীভাবে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা যায়। এ ক্ষেত্রে মানুষ প্রথম যে প্রশ্নটি করছেন তা হলো, সংলাপ থেকে পাওয়া সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে ইসির কতটুকু ক্ষমতা ও সদিচ্ছা রয়েছে— এমনকি কয়েকটি বাছাই করা সুপারিশও কি তারা বাস্তবায়ন করতে পারবে? এ ক্ষেত্রে সাধারণ একটি ধারণা হলো পারবে না এবং এ কারণে পুরো সংলাপ প্রক্রিয়াটিকে প্রহসন হিসেবে দেখা হচ্ছে।

নির্বাচন কমিশন কতটা শক্তিশালী? কমিশন তার নিজের ম্যান্ডেটকে কীভাবে দেখে তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। সংবিধানে ‘জনগণকে’ ‘সকল ক্ষমতার উৎস’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে এবং জনগণের ‘ইচ্ছার’ প্রকাশকে সুশাসনের একমাত্র বৈধ প্রক্রিয়া হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে সেই ‘ইচ্ছা’ প্রকাশের সর্বোত্তম প্রক্রিয়া এবং তা নিশ্চিত করার জন্য ইসি সম্পূর্ণ ও মৌলিকভাবে দায়বদ্ধ। সুতরাং, ইসির ভূমিকা একটি গণতান্ত্রিক সত্তা হিসেবে আমাদের অস্তিত্বের মূল অংশটিকে স্পর্শ করে।

ইসির সাংবিধানিক, আইনগত ও নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা।

তা নিশ্চিত করতে ইসির ওপর আরোপিত ক্ষমতার প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন আপিল বিভাগ। এ বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ  বই মাহমুদুল ইসলামের লেখা ‘কনস্টিটিউশনাল ল অব বাংলাদেশ’ অনুযায়ী, ‘সংবিধান একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়া আর কিছু বিবেচনা করে না এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে কমিশনকে হস্তক্ষেপ করে এমন কোনো আইন সাংবিধানিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে না …অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে কমিশনকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রতিটি পদক্ষেপের তত্ত্বাবধান, নিয়ন্ত্রণ ও নির্দেশ দিতে হবে এবং অবশ্যই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে কমিশনের সব ধরনের ক্ষমতা ও বিচক্ষণতা আছে বলে মনে করতে হবে, কারণ কমিশনকে দেওয়া এটাই সংবিধানের সুস্পষ্ট অভিপ্রায়।’ (তৃতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৯৭০ থেকে ৯৭৪)। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে ইসির সাংবিধানিক ম্যান্ডেটের চেয়ে সুস্পষ্ট আর কিছুই নেই। এই বাধ্যবাধকতা পূরণের ক্ষেত্রে ইসির আর কী ক্ষমতার প্রয়োজন থাকতে পারে?

সবশেষ প্রশ্ন হচ্ছে: প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং তার নেতৃত্বাধীন কমিশনাররা কী জনগণের ইচ্ছা পূরণ করবেন, নাকি ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করবেন? প্রথমটি পূরণ হলে তা গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করার পথ দেখাবে। আর দ্বিতীয়টি হলে তা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য অনুযায়ী ‘গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ঘটবে।’

আরও স্পষ্ট করে বললে, নির্বাচন কমিশন কি শুধু ‘ইভেন্ট ম্যানেজার’ হিসেবে নির্বাচনের আয়োজন করবে, নাকি ‘গণতন্ত্রকে শক্তিশালী’ করতে কাজ করবে?

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান