সিইসির ঘুম এবং ভোটের অবাস্তব হিসাব

সালেহ উদ্দিন :

বিগত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনটি বিতর্কিত কাণ্ড দেশে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে জনআস্থা ভেঙে যায়। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আলোচিত কাণ্ড ছিলো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নির্বাচন। ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত মহাজোটের প্রার্থীরা। ভোটের আগেই সরকার গঠনের আসন পেয়ে যায় মহাজোট।

২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আলোচিত অপকর্ম ছিলো ‘রাতের ভোট’! আগের রাতেই ব্যালট বাক্সে সিল মেরে রাখা হয়। ওই নির্বাচনে সরকারিভাবে ভোট প্রদানের হার দেখানো হয়েছিলো ৮০ শতাংশ। এবার ২০২৪ সালের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আলোচিত বিষয় হলো ‘সিইসির ঘুমের মধ্যেই ভোটের অঙ্ক অলৌকিকভাবে বেড়ে যায় ১৪ শতাংশ। সারা দিনই ভোটকেন্দ্রে ভোটারশূন্য নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত সরকারি হিসাবে ভোট পড়েছে ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের এ তথ্য বিশ্বাস করছে না বাংলাদেশের কোনো মানুষ। এমনকি আন্তর্জাতিক মহলেও  এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

ভোট নিয়ে বিবিসির বিশেষ প্রতিবেদনে দাবি- ভোটের এ হার নির্বাচন বিশ্লেষকদের  অবাক করেছে। ভারতের একজন বিশ্লেষক দাবি করেছেন, ভোট প্রদানের হার ১০ শতাংশের বেশি নয়।ভারতের জিন্দাল স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের অধ্যাপক এবং দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক প্রফেসর শ্রীরাধা দত্ত বলেছেন, বাংলাদেশ সরকার বলছে ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে, আন্তর্জাতিক সূত্র ও সাংবাদিকেরা বলছেন ২৭ শতাংশ। কিন্তু আওয়ামী লীগপন্থী আমাদের পরিচিত অনেকে বলেছেন, ভোট পড়েছে ২০ শতাংশের নিচে। নির্বাচনের দিন ফাঁকা রাস্তা দেখা গেছে, হরতালের মতো। আমার চেনাজানাদের মধ্যে খুব কম মানুষই ভোট দিয়েছেন, ১০ শতাংশের বেশি তো ভোটই দেয়নি।

সরকারি হিসাব যাই হোক নির্বাচনে ১০/ ১২ শতাংশ লোক ভোট দিয়েছেন। কিন্তু এ সংখ্যা অলৌকিকভাবে বেড়ে যায়। বেড়ে যাওয়ার কাহিনী হাজারো প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এর আগে দেখে নিন নির্বাচনের দিন রাত ৯ টা ৩মিনিটে ভোট প্রদানের হার কত ছিলো। ওই সময়ে কমিশনের ড্যাশবোর্ডে ভোট প্রদানের হার দেখানো হয় ঢাকা বিভাগে ২৬ শতাংশ, চট্টগ্রাম বিভাগে ২৮ শতাংশ,  খুলনা বিভাগে ৩২ শতাংশ,  সিলেট বিভাগে ২৩ শতাংশ, ময়মনসিংহ বিভাগে ৩০ শতাংশ এবং রাজশাহী বিভাগে ২৩ শতাংশ। টাইম স্ট্যাম্পসহ নির্বাচন কমিশনের লাইভ ভোট মনিটরের হিসাব অনুযায়ী সারা দেশে মোট  ভোট প্রদানের হার ছিল ২৮ শতাংশ।

৭ই জানুয়ারি বাংলাদেশ সময় বিকেল সাড়ে ৫টায় ভোটগ্রহণ বন্ধ হওয়ার দেড় ঘণ্টা পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে  ২৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। ভোট শেষ হওয়ার একঘণ্টা আগে বেলা ৩টায় ইসি সচিব জানান যে, ভোট পড়েছে ২৭ দশমিক ১৫ শতাংশ। এটা যুক্তিসঙ্গত যে, ভোটদানের শেষ এক ঘন্টায় ১ শতাংশ ভোট বৃদ্ধি পেতেই পারে । সে হিসাবে ২৮ শতাংশ ভোট প্রদানের তথ্য  যুক্তিসংগত ছিলো । কিন্তু সংবাদ সম্মেলন চলাকালে কমিশন সচিব সিইসিকে মৌখিকভাবে   জানালেন, স্যার সংখ্যাটা ৪০ শতাংশ হবে। কোনো কিছু যাচাই না করে এবং লিখিত কোনো হিসাব ছাড়াই সিইসি আউয়াল সঙ্গে সঙ্গে বললেন,  সংখ্যাটা ৪০ও হতে পারে, এর কমবেশিও  হতে পারে।  এর মানে গত এক ঘণ্টায় এক-তৃতীয়াংশ ভোট পড়েছে! কি অবিশ্বাস্য!

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের নির্বাচন বিশ্লেষক ড. আব্দুল আলীম বিবিসি বাংলাকে জানান, বিকাল ৩টার দিকে নির্বাচন কমিশন যে ভোটের হার দেখিয়েছে সেখানে ভোটের হার ছিলো ২৭ দশমিক ১৫ ভাগ। ৩টা থেকে ৪টা, এক ঘণ্টায় টার্ন আউট বেড়েছে ১৪ শতাংশের মতো। আমরা যদি অন্য বছরে নির্বাচনের সাথে তুলনা করি এটা অস্বাভাবিক মনে হয়।

৭ই জানুয়ারি ভোট চলাকালে তিন দফা ভোটের শতকরা হার ঘোষণা করেছিল ইসি। সেই হিসাব অনুযায়ী দুপুর ১২টা ১০ মিনিট পর্যন্ত গড়ে সাড়ে ১৮ শতাংশ ভোট পড়ে। এরপর বেলা ৩টা পর্যন্ত ২৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ ভোট পড়ার কথা জানিয়েছিল। অর্থাৎ প্রায় ৩ ঘণ্টায় ভোট বাড়ে ৮ শতাংশ। সে হিসাবে ঘণ্টায় ভোট প্রদানের হার ২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। সকাল ৮টায় শুরু হওয়া ভোটে দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে এসে কমিশন জানায়, ভোট পড়েছে ১৮ শতাংশ। সে হিসাবে ঘণ্টায় ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ ভোট পড়ে। বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে দেখা গেছে সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ভোট প্রদানের হার সবচেয়ে বেশি থাকে। তারপর এ হার কমতে থাকে। বিশেষ করে বিকেল ৩টার পর হাতেগোনা ভোটার ভোট দিতে আসেন । নির্বাচন কমিশনের দেয়া হিসাবেও দেখা গেছে দুপুর ১২টার পর থেকে ৩টা পর্যন্ত ঘণ্টায় ভোট প্রদানের হার ছিলো ২ দশমিক ৬৬ শতাংশ । কিন্তু শুধু শেষ এক ঘণ্টায় ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ ভোট পড়েছে। অর্থাৎ ১ কোটি ৭৬ লাখ ৫৯ হাজার ৮৮৮ জন ভোটার ভোট শেষ হওয়ার পূর্বের এক ঘণ্টায় তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনোই দেখা যায়নি। বৃদ্ধির হার নিয়ে অদ্ভুত, দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং অবাস্তব ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি ডয়চে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন দুপুর ২টায় তিনি ঘুমে ছিলেন । তাকে ডেকে ঘুম থেকে তোলা হয় । তারপর তিনি সংবাদ সম্মেলনে গিয়ে ২৮ শতাংশ ভোটের কথা বলেছেন । তারপর কেউ একজন তাকে সংশোধন করে দেয় । তারপর তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী তিনি ৪০ শতাংশের কথা বলেছেন । দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে (দুপুর ২ টায় ) তিনি ঘুমিয়েছিলেন !  এরকম একটা ঘুমিয়ে থাকা লোকের হাতে আমাদের জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্ব পড়েছে !  তিনি ঘুমিয়েছিলেন কিনা আমরা জানি না !  থাকলে কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলেন ? আমার ধারণা ডয়চে ভেলেকে সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় ২৮ শতাংশ কিভাবে ৪০ শতাংশ হয়ে গেল তার কোনো উপযুক্ত ব্যাখ্যা তার কাছে ছিলো না । সে জন্য তিনি ঘুমের ওপর দায় চাপিয়ে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করেছেন । সিইসি আউয়াল একজন বিচারক ছিলেন ।  তিনি জানেন, সাক্ষী সত্যি বলেছে -না মিথ্যা বলেছে তা বিচারক কিভাবে উদঘাটন  করেন। আইনজীবীরা যুক্তি উপস্থাপনকালে বলেন, আমাদের সামনে এমন কোনো যন্ত্র  নেই যে সাক্ষী সত্যি না মিথ্যা বলেছেন তা জানার। একমাত্র সাক্ষীর বক্তব্য, জেরা এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিশ্লেষণের মাধ্যমেই বিচারক সিদ্ধান্তে উপণিত হন। আমরা যদি সিইসির বক্তব্য বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাব তিনি কিছু লুকানোর অপচেষ্টা করেছেন । এটি করতে গিয়ে তিনি তালগোল পাকিয়েছেন এবং মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন !

তিনি দাবি করেছেন দুপুর ২ টায় ঘুমিয়েছিলেন এবং তাকে ডেকে তোলা হয়েছে। সিইসি সংবাদ সম্মেলনে হাজির হয়েছিলেন ভোট গ্রহণ শেষের দেড় ঘণ্টা পর বিকেল  সাড়ে ৫টায় । তিনি দুপুর ২টা থেকে কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলেন তা তিনি বলেননি । কিন্তু এটি ধরে নেয়া স্বাভাবিক ঘুম থেকে উঠে ভোট গ্রহণের যাবতীয় তথ্য নিয়েই তিনি সাংবাদিক সম্মেলনে হাজির হয়েছিলেন এবং ওই তথ্যের ভিত্তিতেই তিনি ২৮ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে দাবি করেন। এ দাবির সঙ্গে সঙ্গেই সচিব জানান, ভোট প্রদানের হার ৪০ শতাংশ । সচিবের মৌখিক কথার ভিত্তিতেই  তিনি সংশোধন করে বলেন, ভোট প্রদানের হার ৪০ শতাংশ । ঘটনাটি ঘটে সিইসির সংবাদ সম্মেলনে ঢোকার মিনিট পাঁচেকের মধ্যে । এই  পাঁচ মিনিটে কী এমন ঘটলো যে ভোট প্রদানের হার ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ অর্থাৎ  ১ কোটি ৭৬ লাখ ৫৯ হাজার ৮৮৮ জন ভোটার বেড়ে গেল!

যদিও  রাত ৯টা ৩মিনিট পর্যন্ত লাইভ মনিটরের ড্যাশবোর্ডে ভোট প্রদানের হার ২৮ শতাংশই ছিলো । ড্যাশবোর্ডের এ তথ্য সাজানো হয়েছিলো সারা দেশের রিটার্নিং অফিসারের তথ্যের ভিত্তিতেই । ভোট গ্রহণের শেষে বিকাল সাড়ে ৪টার মধ্যেই রিটার্নি অফিসাররা এ তথ্যে কমিশনে পাঠিয়েছিলেন  এবং এতে বিভাগ ওয়ারি তথ্য ছিলো ।

যদিও তিনি চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন কেউ এসে যেন তার বক্তব্য মিথ্যা প্রমাণ করে। একজন সাবেক বিচারক হিসাবে তার কাছে প্রশ্ন রইলো তার জবানবন্দি , ঘটনাপ্রবাহ এবং পারিপাশ্বিক অবস্থা থেকে কি এটি পরিস্কার নয় যে তিনি অসত্য বলেছেন ?  এতক্ষণ আলোচনা করেছি সরকারি হিসাব নিয়ে যা ২৮ শতাংশ হোক আর ৪০ শতাংশই হোক দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষকদের ধারণা ভোট প্রদানের হার ১০ শতাংশের বেশি নয় । এ তথ্য সিইসির বিশ্বাস না হলে  ফ্রি স্টাইলে ব্যালটে সিল মারার  যে হাজার ভিডিও সামাজিক  যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে তা দয়া করে একটু দেখুন আর দেশের যে ৯০ শতাংশ মানুষ ভোট দিতে যায়নি তাদের কথা কান পেতে শুনুন।

মানব জমিন