সারে ভর্তুকি ২০১৭-১৮ থেকে ২০২২-২৩: সাতান্ন হাজার কোটি টাকার সুবিধাভোগী শুধু কৃষক নয়, লুণ্ঠনও হয়েছে

 

শাহাদাত বিপ্লব ও আরফিন শরিয়ত

এভাবে আত্মসাৎ-দুর্নীতির মাধ্যমে সার খাতে দেয়া ভর্তুকির বড় একটি অংশ চলে যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে। গত ছয় বছরে ৫৭ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সার খাতে ভর্তুকি হিসেবে। বছর বছর ভর্তুকির পরিমাণ এ সুবিধার সবটা পৌঁছেনি কৃষকের কাছে। মাঝপথেই এর বড় একটি অংশ লুণ্ঠন করে নিয়েছে মধ্যস্বত্বভোগীরা।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ইউরিয়া এবং নন-ইউরিয়া উভয় মিলিয়ে ২০১৭-১৮ থেকে ২০২২-২৩ সাল পর্যন্ত ছয় অর্থবছরে সার খাতে মোট ভর্তুকি দেয়া হয়েছে ৫৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭ হাজার ৪৭৩ কোটি, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬ হাজার ৭১৬ কোটি, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭ হাজার ৪২১ কোটি ও ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৪ হাজার ৯৪২ কোটি টাকার ভর্তুকি দেয়া হয়। এছাড়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে ১৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির ঘোষণা দেয়া হয়েছিল।

আত্মসাৎ-দুর্নীতির কারণে এ ভর্তুকির বড় একটি অংশই কৃষকের পাশে পৌঁছায় না বলে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। সাবেক খাদ্য সচিব আব্দুল লতিফ মন্ডল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিভিন্ন সময় দেখেছি সার নিয়ে বড় বড় দুর্নীতি হয়। সিস্টেম লস দেখিয়ে অনেক সার হারিয়ে যায়। এতে সরকারেরও ক্ষতি, কৃষকেরও ক্ষতি। অথচ সরকার এ খাতে অনেক বেশি ভর্তুকি দিচ্ছে। এখন দুর্নীতি হয় বলে ভর্তুকি কমিয়ে দেয়া যাবে না। বরং দুর্নীতি কমিয়ে আনতে হবে। গত এক বছরে সারের দাম অনেক বেড়েছে। কৃষকের উৎপাদনে তা প্রভাব ফেলবে। উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। সারের দুর্নীতি নিয়ে সরকারকে আরো বেশি সোচ্চার হতে হবে।’

ভর্তুকির অর্থ সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয়া হয় ইউরিয়া সারের জন্য। ইউরিয়া সারের জন্য ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩ হাজার ২৯৯ কোটি, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ হাজার ৯৫৪ কোটি, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২ হাজার ৪৮৬ কোটি ও ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়।

সরকারি কারখানাগুলোয় সার খাতে দেয়া ভর্তুকির অর্থ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন সময়ে। শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের হিসাব নিরীক্ষা করতে গিয়ে দেখা গেছে, শাহজালাল ফার্টিলাইজার কর্তৃপক্ষ টিএসপি কমপ্লেক্স লিমিটেডের কাছে ২০১ টন রক সালফার বিক্রি করেছিল। রক সালফার কারখানায় পৌঁছলেও তার বিপরীতে মূল্য বাবদ ৬৯ লাখ ৬৭ হাজার ৯৬৭ টাকা পরিশোধ করা হয়নি। এ ক্ষতিও সরকারকে বহন করতে হয়েছে। বিষয়টিকে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম হিসেবে চিহ্নিত করেছে সিএজি।

বিভিন্ন সময়ে পরিবহন ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশে নানা আর্থিক অনিয়ম হওয়ার অভিযোগও উঠেছে। অডিটে দেখা গেছে, পরিবহন ঠিকাদাররা সার উত্তোলনের পর বিসিআইসির নিয়ন্ত্রণাধীন বাফার গুদামে পৌঁছে দেয়ার চুক্তি থাকলেও নির্ধারিত সময় পার হয়ে যাওয়ার দীর্ঘদিন পরও সে সার পৌঁছে দিচ্ছে না। এতে হাজার কোটি টাকারও বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে সরকার। খালাসের পর থেকে নির্ধারিত গুদামে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত এ সারকে চিহ্নিত করা হয় ট্রানজিট সার হিসেবে।

২০১৮-১৯ অর্থবছরেরই নিরীক্ষা কার্যক্রম চালাতে গিয়ে দেখা যায়, এক হাজার টন ইউরিয়া সার বগুড়ার বাফার গুদামে পৌঁছে দেয়ার জন্য মেসার্স পোটন ট্রেডার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দিয়েছিল বিসিআইসি। নির্ধারিত সময়ের সোয়া দুই বছর পরও সে সার গ্রহণের কোনো রশিদ (এমআরআর) দেখাতে পারেনি সংশ্লিষ্ট গুদাম কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে ২০১৯ সালের এপ্রিলে গুদামের তৎকালীন ইনচার্জ এক চিঠিতে জানান, ওই সার গুদামে গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু চিঠিতে সার গ্রহণের কোনো এমআরআর নম্বর উল্লেখ করা হয়নি। পরের বছর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে আরেক চিঠিতে গুদামের নতুন ইনচার্জ জানান, ওই সার গুদামে গ্রহণ করা হয়নি এবং এর বিপরীতে কোনো এমআরআরও প্রদান করা হয়নি।

২০১৭-১৮ অর্থবছরের আমদানীকৃত সারের অডিট করতে গিয়ে সিএজি দেখতে পেয়েছে, পরিবহন ঠিকাদাররা ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৬৫৭ টন সার নিজস্ব তত্ত্বাবধানে রেখে দিয়েছে। কিন্তু সে সময় বিসিআইসির ট্রেড গ্যাপ অ্যাকাউন্টসে ট্রানজিট সারের পরিমাণ দেখানো হয় ২ লাখ ৭০ হাজার ১৬৯ টন। অর্থাৎ এ অর্থবছরে ট্রানজিট সারের পরিমাণ কম দেখানো হয় ৬ লাখ ৭৬ হাজার ৪৮৮ টন, যার বাজারমূল্য ছিল ১ হাজার ৮৩৪ কোটি ৯৯ লাখ টাকা।

আট পরিবহন ঠিকাদার কোম্পানির কাছে এ সার সংরক্ষিত ছিল। এর মধ্যে সাউথ ডেল্টা শিপিং অ্যান্ড ট্রেডিং লিমিটেডের কাছে ২ লাখ ৩২ হাজার ৭৯২ টন, নবাব অ্যান্ড কোম্পানির কাছে ২ লাখ ৫ হাজার ৫৩০, পটন ট্রেডার্সের কাছে ১ লাখ ৯৯ হাজার ২৭৯, বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের কাছে ১ লাখ ৯৫ হাজার, রেক্স মোটরসের কাছে ৪১ হাজার, গ্রামসিকো লিমিটেডের কাছে ১৪ হাজার ১৬০, এম/এস রুহুল আমিন ভূঁইয়ার কাছে ৬ হাজার ৮৯৫ এবং দেশ ট্রেডিং করপোরেশনের কাছে ৫ হাজার ২০০ টন সার ট্রানজিটে ছিল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিসিআইসি জানায়, বাফার গুদামের জায়গা স্বল্পতার কারণে কম-বেশি ৩ লাখ থেকে ৩ লাখ ৫০ হাজার টন সার সব সময় পরিবহন ঠিকাদারদের কাছে গুদামের বাইরে ট্রানজিটে রয়ে যায়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সমাপনী ট্রানজিট সারের মোট পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৭৯ হাজার ৪২৭ টন। পরিবহন ঠিকাদারদের পত্র অনুযায়ী, বিল পরিশোধের জন্য প্রভিশনে রাখা সারের পরিমাণ ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৬৫৭ টন। বাকি সারের কোনো উল্লেখ ছিল না কোনো কাগজপত্রে।

২০১৯-২০ অর্থবছরে পরিবহন ঠিকাদার পোটন ট্রেডার্সের অনুকূলে ৯ হাজার ৮০০ টন সার নির্ধারিত বাফার গুদামে পৌঁছানোর কার্যাদেশ দেয়া হয়। নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও ৪ হাজার ৫১১ টন সার পৌঁছানো হয়নি। এতে সরকারের ১৩ কোটি ২ লাখ ৯৮ হাজার টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়।

একই অর্থবছরে নবাব অ্যান্ড কোম্পানি নামে আরেকটি ঠিকাদার কোম্পানিকে ৫ হাজার ৫০০ টন ইউরিয়া সার পৌঁছানোর কার্যাদেশ দেয়া হয়। নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পরও জেএফসিএল গুদামে ৪ হাজার ৩৯৪ টন সার না পৌঁছানোয় ১২ কোটি ৬৯ লাখ ১৯ হাজার টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয় সরকার।

সরকারি প্রতিষ্ঠানের সার বিক্রির অর্থ আদায় নিয়েও রয়েছে অনিয়মের অভিযোগ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে আখ চাষের জন্য রাজশাহী সুগার মিলস লিমিটেডকে ১ হাজার ৩৫০ টন এবং মোবারকগঞ্জ সুগার মিলস লিমিটেডকে এক হাজার টন সার বরাদ্দ দেয়া হয়। অগ্রিম মূল্যে সার বিক্রির কথা থাকলেও তা না করে বাকিতে সার বিক্রি করা হয়। পরে সে অর্থ পরিশোধ করেনি এ দুই কারখানা। এতে সরকার ৩ কোটি ২৯ লাখ টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এ বিষয়ে জানতে বিসিআইসির চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব জাকিয়া সুলতানা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা আগে ঘটেছে। এখন আর ঘটছে না। গত দুই বছরে এ ধরনের ঘটনা খুঁজে পাবেন না। আগের সময়গুলোয় ট্রানজিটে থাকা সার বাফার গোডাউনে না পৌঁছে দিয়ে ট্রেড গ্যাপ দেখিয়ে আত্মসাৎ করা হতো, যার কারণে সরকার বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতো। আমরা এ ধরনের ঘটনায় এখন কঠোর হচ্ছি, যারা এ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত তাদের শাস্তির মুখোমুখি করার জন্য আইনি প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। যারা এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে দুদকসহ বিভিন্নভাবে মামলা হয়েছে। এসব মামলা চলমান রয়েছে। আশা করি, তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে পারব।’

তিনি আরো বলেন, ‘ভবিষ্যতে আমরা সার উত্তোলন থেকে শুরু করে বাফার গোডাউনে যাওয়া পর্যন্ত পুরো সময়টা অটোমেশনে নিয়ে আসছি। এর জন্য কাজ হচ্ছে। অটোমেশন প্রক্রিয়া পুরোপুরি চালু হলে সার উত্তোলন থেকে শুরু করে পুরো সময় আমাদের নজরদারিতে থাকবে। কেউ সার আত্মসাৎ করতে পারবে না। এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আমরা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছি। অটোমেশনের কাজ এগিয়ে চলছে। আর এ ধরনের কোনো সমস্যা হবে না আশা করি।’