শ্রমিক-কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিলের ২৫ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে জামিন দিয়েছেন আদালত। গতকাল ঢাকার সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আস-সামছ জগলুল হোসেনের আদালতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করেন। শুনানি শেষে আদালত তার জামিন মঞ্জুর করেন। এর আগে সকালে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় ড. ইউনূসসহ ৪ আসামির জামিনের মেয়াদ বাড়ানো হয়। সেই মামলায় ১লা জানুয়ারি ড. ইউনূসসহ ৪ জনের ৬ মাসের কারাদণ্ড এবং ৩০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছিল।
দুদকের মামলায় ইউনূসের পাশাপাশি ৭ আসামির জামিন মঞ্জুর করেন বিচারক। তারা হলেন- গ্রামীণ টেলিকমের পরিচালক পারভীন মাহমুদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাজমুল ইসলাম, পরিচালক ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশরাফুল হাসান, নাজনীন সুলতানা, মো. শাহজাহান, নূরজাহান বেগম এবং পরিচালক এস.এম হাজ্জাতুল ইসলাম লতিফী। ড. ইউনূস ও অন্যদের পক্ষে জামিন শুনানি করেন ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন। অপরদিকে দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল। জামিন শুনানিতে ইউনূসের আইনজীবী বলেন, শ্রমিকদের সঙ্গে গ্রামীণ টেলিকমের সেটেলমেন্ট হয়েছে। এর অংশ হিসাবে ৪৩৭ কোট টাকা তারা শ্রমিকদের দিয়েছেন।
সারা দুনিয়ার মানুষ এ বিচার দেখছে: আদালত থেকে জামিন নেয়ার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস আদালতের বাইরে উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এই বিচারের ঘটনা দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় উল্লেখ করে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ বলেন, এটা এখানেই সীমাবদ্ধ নয়, দেশের মধ্যেও সীমাবদ্ধ নয়, সারা দুনিয়ার মানুষ লক্ষ্য করছে এই বিচারে কি হলো। আমরা যা যা করছি তা সবই তারা দেখছে। তিনি বলেন, এই যে ঘটনাগুলো ঘটছে তার পক্ষে লিখুন, বিপক্ষে লিখুন কোনো অসুবিধা নাই। কিন্তু এটা রেকর্ডেড। জাতির ইতিহাসের একটা অংশ হয়ে যাবে। এটার জন্য কি আমরা গর্ববোধ করবো, নাকি অপরাধবোধ করবো? এরকম একটা সন্তানকে এমন অপরাধে অপরাধী কেনো করলাম? এগুলোর জবাব থেকে মুক্তি নাই। তিনি বলেন, আপনারা আজকের এই ছবিটা তুলে রাখুন। দুর্নীতি দমন কমিশনের বটতলায় আমরা সবাই। এটা ঐতিহাসিক একটা ছবি। এটা আজকে-কালকে পত্রপত্রিকায় বের হবে। কিন্তু এটা যুগ যুগ ধরে নানা বইতে প্রকাশিত হবে। আপনারা সেই ইতিহাসের সাক্ষী। এটা একটা ঐতিহাসিক ঘটনা উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, একজন নোবেল বিজয়ীর বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ এনেছে, জালিয়াতির অভিযোগ এনেছে, মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ এনেছে। আমি একা নই। আমরা আরও ৭ জন, যারা সারাজীবন কঠোর পরিশ্রম করেছে গরিব মানুষের জন্য। এরা কোনো চাকরি করতে এখানে আসে নাই। তারাও অর্থ আত্মসাৎ, জালিয়াতির এবং মানি লন্ডারিংয়ের জন্য অভিযুক্ত।
সাংবাদিকদের তিনি আরও বলেন, আপনারা আজকে এখানে উপস্থিত আছেন। আপনারা জন্ম-জন্মান্তর ধরে বলতে পারবেন যে, আমরা উপস্থিত ছিলাম সেখানে। এবং কেন ছিলেন, কি হয়েছে সেগুলো আপনারা বর্ণনা করবেন। এটা আমার মুখ থেকে শোনার দরকার নেই। আপনারা যা নিজে মনে করবেন তা আপনার পরের প্রজন্মকে জানাবেন। যারা এখানে উপস্থিত হয়নি তাদের জানাবেন। আইন মানুষের শুভ কামনা করে রচনা করা হয়। আইন মানুষের মনে স্বস্তি আনে, শান্তি আনে। আইন মানুষের মনে আশঙ্কাও জাগায়। ভয়ঙ্কর শঙ্কা জাগায়। আইনকে আমরা কোনদিকে নিয়ে যাবো সেটা সমাজের ইচ্ছা। সমাজ কীভাবে করতে চায়। আপনারাও ঠিক করেন, দুর্নীতি দমন কমিশন আজ যে বিচারে বসলো সেটা সঠিক কারণে হয়েছে কিনা, সঠিকভাবে হয়েছে কিনা। এটা আমার মুখের দিকে তাকানোর কোনো দরকার নাই। এটা আপনার মনে যা জাগে তাই করবেন।
নোবেল জয়ী এই অর্থনীতিবিদ বলেন, আমাদের ছেলেমেয়েরা এগুলো স্কুলে পড়বে। তারা তো নোবেল পুরস্কারের কথা ভুলতে পারবে না। তখন তারা পড়বে তার নামে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ দেয়, মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ দেয়, জালিয়াতিতে দেয়, তখন তারা কনফিউশনে পড়ে যাবে। আসলটা কি! এটা কি মুখোশ নাকি আসল মানুষ। তারা একাই নাকি তাদের সাঙ্গপাঙ্গ আছে।
উল্লেখ্য, গত ২৯শে জানুয়ারি দুদকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত কমিশন বৈঠকে ড. ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট অনুমোদন দেয়া হয়। চার্জশিটভুক্ত ১৪ আসামি হলেন- গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল ইসলাম, পরিচালক ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশরাফুল হাসান, পরিচালক পারভীন মাহমুদ, নাজনীন সুলতানা, মো. শাহজাহান, নূরজাহান বেগম ও পরিচালক এসএম হাজ্জাতুল ইসলাম লতিফী, এডভোকেট ইউসুফ আলী, এডভোকেট জাফরুল হাসান শরীফ, গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি মো. কামরুজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ মাহমুদ হাসান, শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের দপ্তর সম্পাদক কামরুল হাসান ও প্রতিনিধি মো. মাইনুল ইসলাম।
গত ৩০শে মে গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিলের ২৫ কোটি ২২ লাখ ৬ হাজার ৭৮০ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দুদক। সংস্থার উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। লভ্যাংশের ভাগ বাবদ পাওনা টাকা চেয়ে গ্রামীণ টেলিকমের ১৭৬ কর্মী শতাধিক মামলা করেছিলেন। তারা হাইকোর্টেও আবেদন করেছিল। পরে তাদের সঙ্গে গ্রামীণ টেলিকমের সমঝোতা হয়। সমঝোতার মাধ্যমে পাওনা পেয়ে গ্রামীণ টেলিকমের কর্মীরা ২০২২ সালে মে মাসে মামলাগুলো প্রত্যাহার করেন। পরে পাওনা পরিশোধের বিষয়টিকেই অর্থ আত্মসাৎ ধরে দুদক মামলা করে।
manabzanib