সারা অঙ্গে ঘা, মলম দেবেন কোথা?
- ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী ০৫ অক্টোবর ২০১৯
ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। কোথায় ঘুষ নেই? সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে বিআরটিএ, শিক্ষা বিভাগ থেকে গণপূর্ত, ক্ষুদ্র থেকে মেগা প্রকল্প, শিক্ষক থেকে চিকিৎসক- সর্বত্র দুর্নীতি ঘুষ লুটপাট সংক্রমিত হয়ে পড়েছে। এদিকে,বিদ্যুৎ খাত থেকে সরকারি কর্মচারী- সব ক্ষেত্রে সংরক্ষণ নীতির মাধ্যমে সরকারি কর্মচারীদের ঘুষ দুর্নীতির বিষয়ে ইনডেমনিটি দেয়া হয়েছে। এক সেক্টরে যখন ঘুষ দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে, তখন খুব সঙ্গতভাবেই অন্যান্য সেক্টরেও ঘুষ দুর্নীতি জেঁকে বসছে। কুযুক্তিটা হলো, ঘুষ দুর্নীতির জন্য ওদের বিরুদ্ধে যদি ব্যবস্থা নেয়া না হয়, তাহলে আমার বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হবে? এদিকে ঘুষ দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করেছে সরকার। সেখানে হাত দিয়ে দেখা গেল, কেঁচো খুঁড়তে বড় বড় অ্যানাকোন্ডা সাপ বেরিয়ে আসছে। তারপর সরকার যেন খামোশ হয়ে গেছে। এখন সে অভিযান স্তিমিত। আটক করার জন্য সবুজ সঙ্কেত যে আর আসে না। আর সবুজ সঙ্কেত ছাড়া কাউকে ধরতেও পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদ অধিবেশনে গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে। যুবলীগের তিন-চারজন ক্যাসিনো ব্যবসায়ীকে আটকের পর ‘ক্যাসিনো সম্রাট’দের যখন আটকের প্রশ্ন এলো, তখনই মন্ত্রীরা এলোমেলো হয়ে গেলেন। কেউ বলেন, ওয়েট অ্যান্ড সি; কেউ বললেন, এত অস্থির হচ্ছেন কেন, দেখুন কী হয়। কেউ বললেন, ঊর্ধ্বতন মহলের সবুজ সঙ্কেতের অপেক্ষায় আছেন তারা। সে সঙ্কেত পাওয়া গেলেই ধরা হবে সম্রাটদের।’ সেই ঊর্ধ্বতন মহল যদি হয়ে থাকেন সরকারপ্রধান, তাহলে বলা যায়, দিল্লি যাওয়ার আগে সে রকম কোনো সবুজ সঙ্কেত তিনি দিয়ে যাননি।
২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সম্প্রচারের উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, মাদক ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান অভিযান অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেছেন, সরকার দেশের উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ উইপোকাদের হাত থেকে রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। শেখ হাসিনা বলেছেন, চলতি বাজেটে আমরা ১৭৩ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছি। ‘দুর্নীতিবাজ উইপোকারা’ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকালে অর্থ লুটে নিচ্ছে। দেশের উন্নয়নের জন্য জনগণের কষ্টার্জিত অর্থের প্রতিটি পয়সার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য ওইসব ‘উইপোকাকে’ আটক করতে হবে। আমরা জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ, মাদক ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান অভিযান অব্যাহত রাখব। এসব অপকর্মের সাথে জড়িত থাকলে দল, পরিবার নির্বিশেষে কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।’
এরপর প্রধানমন্ত্রী গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের কিছু উপদেশ দিয়েছেন। তিনি কোনো ধরনের অপপ্রচার না করার জন্য গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, অপপ্রচারগুলো সরকারের বিরোধিতার নামে মানুষের মধ্যে অনাস্থা সৃষ্টির পাশাপাশি দেশে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। আপনাদের কাছে আরেকটি আবেদন রাখতে চাই, আপনারা সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড তুলে ধরুন, যাতে দেশবাসীর মনে সরকারের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা সৃষ্টি হয় এবং তারাও উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখতে পারে। গণমাধ্যম ব্যক্তিদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা বিরুদ্ধে বলুন, বিরোধিতা করেন, আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু অপপ্রচার যাতে না হয়, সে ব্যাপারে দয়া করে একটু সতর্ক থাকবেন। মানুষের মনে অযথা সন্দেহ বা সঙ্ঘাত সৃষ্টি করে- এমন ধরনের সম্প্রচারের বিষয়ে আপনাদের একটু সতর্ক থাকতে হবে। তিনি আরো বলেন, কিছু না হোক, গোটা ১০ বছরে আমরা কিছু কাজ করেছি, সেটা তো আর অস্বীকার করা যাবে না।
সেটাও একটু প্রচার করুন, সেটাও আমরা চাই। কারণ আপনি কাজের মধ্য দিয়ে তখনই সফলতা অর্জন করতে পারবেন, যখন দেশের মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠবে। কাজেই এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যাতে মানুষ আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, দিশেহারা হয়ে যায়। যেটুকু ভালো কাজ করেছি, সেটুকুর প্রচার অন্তত আমি দাবি করি।’
মিডিয়ার স্বাধীনতার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সবসময় অসহিষ্ণু বলে অভিযোগ আছে। আগে যা ছিল, এখনো তাই আছে। এই মুহূর্তে দেশে সরকারবিরোধী কোনো মিডিয়া কার্যত নেই। দেশের সব টিভি চ্যানেল সরকার সমর্থক লোকদের দিয়ে, তাদের মালিকানায় পরিচালিত। যে দু-একটি টিভি চ্যানেল বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করত, সেগুলো নানা অজুহাতে অনেক আগেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। চ্যানেল ওয়ান, সিএসবি, দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভি সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখানেও সরকারের সমালোচনা সামান্যই থাকত। এই চ্যানেলগুলো কার্যত বস্তুনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেছিল। সেটাই কাল হলো। ঠুনকো অজুহাতে এই চ্যানেলগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। এই মুহূর্তে দেশের সব সংবাদপত্রের মালিক ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক বা সরকারের বড় বড় চাঁই। দু-একটি সংবাদপত্র বস্তুনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু সেলফ-সেন্সরশিপে তারাও বড় অসহায়। কার্যত বস্তুনিষ্ঠ সংবাদপত্রগুলো ইতোমধ্যেই মুখথুবড়ে পড়েছে সরকারের সহযোগিতার অভাবে। সরকার বন্ধ করে দিয়েছে ভিন্ন মতের পত্রিকা ‘আমার দেশ’। এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে জেল খাটানো হয়েছে। কিন্তু মিডিয়া যদি দিনরাত সরকারের কীর্তন গায়, তাহলে সে মিডিয়ার খবর কেউ পড়বে না, সে মিডিয়ায় কেউ চোখ রাখবে না। জেলখানার কয়েদিরা ছাড়া আর কেউ সম্ভবত বিটিভি দেখে না। বিটিভিতে দিনরাত সরকারের উন্নয়নের গীত গাওয়া হচ্ছে। কিন্তু জনগণ তা তেমন বিশ্বাস করে না। খবর বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য ভিন্ন মতেরও দরকার। আর তাই সরকার সমর্থক মিডিয়াও কখনো কখনো কিছুটা ভিন্ন মত প্রচার করে। এর মাধ্যমে তারা জনগণের কাছে পৌঁছতে সক্ষম হয়। সেটা যদি সরকার সহ্য করতে না চায়, তা হলে সমাজের ভেতরকার কিছুই দেখতে পাওয়া যাবে না, অন্ধ হয়ে যাবে কর্তৃপক্ষ। বুঝতে হবে, মিডিয়া সরকারের প্রতিপক্ষ নয়। বরং সরকারের চক্ষুর উন্মীলনের জন্য মিডিয়া সত্য প্রকাশ করে। তাতে সরকারের উপকারই হয়, অপকার নয়।
আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় মিডিয়া নয়, ‘উইপোকা’। প্রধানমন্ত্রী নিজেও সে কথা স্বীকার করেছেন। রূপপুর পরমাণু প্রকল্প নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় কাজ। কিন্তু সেখানে যখন ‘বালিশকাণ্ড’ ঘটে, সেটি অবশ্যই একটি খারাপ কাজ। উইপোকাকাণ্ড। তাই রূপপুর পরমাণু প্রকল্পের প্রসঙ্গ এলে তার সাথে তো বালিশকাণ্ড আসবেই। তাতে সরকারের উপকারই হবে। তখন তারা নজর দিতে পারবেন উইপোকাদের ওপর। মিডিয়া যদি বালিশকাণ্ডের খবর প্রকাশ না করত, তা হলে এতবড় দুর্নীতি সরকারের অগোচরেই থেকে যেত, মেগা দুর্নীতি হলেও ধরা পড়ত না।
সরকারের শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছিল ছাত্রলীগ দিয়ে। প্রকাশিত খবর মতে, ছাত্রলীগের সভাপতি সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক রাব্বানী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই কোটি টাকা দুর্নীতির পর ৮৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার বন্দোবস্তু করেছিলেন। সেজন্য তাদের ওই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নিজে। কিন্তু তাদের দুর্নীতির বিচারের কোনো আয়োজন আজও করা হয়নি। ফলে অন্যদের মধ্যে দুর্নীতির আকাক্সক্ষা কমেনি। ‘দুর্নীতি করো, বড় জোর বাদ যাবে। টাকা যা কামাবার কামিয়ে নাও।’ দুর্নীতি শুধু সোহাগ-রাব্বানী করেননি। পরে দেখা গেল, ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম বিরাট দুর্নীতি বা চাঁদাবাজি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছেন এবং ব্রিটেনে গিয়ে বিজনেস ভিসা লাভ করেছেন। কোম্পানি খুলেছেন তিনটি। সেখানে তার বিনিয়োগ ১০ কোটি টাকা। কিন্তু কোথায় পেলেন এত টাকা? সরকার তাকে ধরার চেষ্টা করেনি। তারা চলে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
ছাত্রলীগের পর আসে যুবলীগের প্রসঙ্গ। প্রধানমন্ত্রী যুবলীগের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেন। ‘ছাত্রলীগকে ধরেছি, যুবলীগকে ধরছি। কেউ ছাড়া পাবে না।’ যুবলীগ ধরতে গিয়ে দেখা গেল, এর ওপরের স্তরের প্রায় সব নেতা দুর্নীতির সাথে জড়িত। কেউ ক্যাসিনো সম্রাট, কেউ টেন্ডার ডন, কেউ দুর্ধর্ষ চাঁদাবাজ। যুবলীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে থানা পর্যায়ের নেতাদের কেউই এই দুর্নীতির বাইরে নেই। এই অভিযানের শুরুর দিকে আটক হলেন যুবলীগের ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। তারপর আটক হন যুবলীগের সমবায়বিষয়ক সম্পাদক টেন্ডার ডন জি কে শামীম। তারপর আটক হয়েছেন কৃষকলীগ নেতা ‘কালা ফিরোজ’। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে অবিশ্বাস্য সব তথ্য। ক্যাসিনো ব্যবসা করে যুবলীগ নেতারা শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। যারা হাতিয়ে নিয়েছেন, তারা জানান, এই টাকার ভাগ তারা দিয়েছেন যুবলীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের, দলের বড় কর্তাদের, পুলিশ ও প্রশাসনকে।
এই ক্যাসিনো কাণ্ডের শীর্ষ ব্যক্তি হিসেবে যার নাম উঠে আসে, তিনি হলেন, যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাট। পত্রিকা জানিয়েছে, ঢাকা নগরীর শতাধিক জুয়ার আসরের সবক’টি থেকেই ভাগ পেতেন সম্রাট। গ্রেফতার অভিযান শুরু হওয়ার পর তিন দিন শত শত ক্যাডারের পাহারায় তার কাকরাইলের অফিসেই তিনি ছিলেন। কেউ তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করেনি। ধরে নেয়া যায় তার পর থেকে তিনি অফিস ছেড়ে কোনো গোপন নিরাপদ আশ্রয়ে আছেন। কেউ বলছেন, তিনি পালিয়ে গেছেন দেশ ছেড়ে; কেউ বলছেন, তিনি আছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতেই। তার বিষয়ে প্রশ্নের কেউ জবাব দিতে চান না। না সড়ক সেতু মন্ত্রী, না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলেছে, তার গ্রেফতারের ব্যাপারে তারা ঊর্ধ্বতন মহলের সবুজ সঙ্কেতের অপেক্ষায় আছেন। জাদরেল মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেলে তাকে আটক করা হবে। কথাটা শুনে মনে হবে, যেন প্রমাণের এখনো বাকি আছে।
এই দুর্নীতি ঘুষ জোচ্চুরি এতটাই বিস্তৃত হয়েছে যে, মলম দেয়ার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। এই দুর্নীতিবাজদের বাসাবাড়ি থেকে পাওয়া গেছে নগদ কোটি কোটি টাকা, শত শত কোটি টাকার এফডিআর, কেজি কেজি সোনা। কিন্তু মাত্র তিন চারজন ছাড়া আর কাউকে ধরা যায়নি। দেখা গেছে, ক্যাসিনো পরিচালনাকারী নেপালিদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছে পুলিশ। তাদের সাসপেন্ড করা হয়েছে। এ পর্যন্ত কোনো নেপালি ধরা পড়েনি। অথচ তারা ছিল শতাধিক।
যুবলীগ দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক ক্যাসিনো ডন খালেদ মাহমুদ ধরা পড়ার পর তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী। তিনি র্যাব-পুলিশ ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণু মন্তব্য করে আলোচনায় আছেন। তিনি বলেন, এখন কেন গ্রেফতার করছেন? আগে কোথায় ছিলেন? এত দিন ধরে চলছে ক্যাসিনো, তখন কি আপনারা বসে বসে আঙুল চুষছিলেন? সংশ্লিষ্ট থানার র্যাব ও পুলিশদেরও গ্রেফতার করতে হবে। আপনারা গ্রেফতার করবেন। আমরাও বসে থাকব না।’ কিন্তু খালেদ মাহমুদকে রিমান্ডে নেয়ার পর তিনি অনেকটাই চুপষে গেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক ওমর ফারুক চৌধুরী ও তার পরিবারের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে।
জনাব চৌধুরীর রাজনৈতিক জীবন চমকপ্রদ। জানা গেছে, টেন্ডুপাতা থেকে শুরু করে পোশাকের ব্যবসা করেছেন। সে ব্যবসা করতে গিয়ে ঋণখেলাপি হয়েছেন। করেছেন বিড়ি শ্রমিক লীগ। এরপর এরশাদ আমলে ছিলেন তার যুবসংহতি অঙ্গ দলের সাথে। আওয়ামী লীগ করেও দীর্ঘ সময় ছিলেন পেছনের কাতারে। তবে যুবলীগ করে পৌঁছে গেছেন একেবারে শীর্ষে। ২০০৩ সালে ওমর ফারুক যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হন। তার আগের কমিটিতে যুবলীগের কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন তিনি। ২০০৯ সালে তিনি যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন। ২০১২ সালে হলেন যুবলীগের চেয়ারম্যান। এরপর থেকে যুবলীগে তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। চেয়ারম্যান হওয়ার পর তিনি তার সম্পত্তি নিলামে ওঠা রদ করেছেন। যাপন করছেন ধনাঢ্য জীবন। তার কোনো ব্যবসা বা দৃশ্যমান আয় নেই। কথিত আছে, তিনি ৬৪ বছর বয়সে যুবলীগের চেয়ারম্যান হয়েছেন। এখন তার বয়স ৭১। উল্লেখ করা যায় যে, তিনি শেখ ফজলুল করিম সেলিমের ভগ্নিপতি। ১৯৯৭ সালে ওমর ফারুক ও তার স্ত্রী শেখ সুলতানা কারখানা ও জমি বন্ধক দিয়ে সোনালী ব্যাংক থেকে ১১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন! সে জন্য ২০০৯ সালে তার সম্পত্তি নিলামে ওঠে। সম্পদ নিলামে ওঠার আগেই যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হয়ে যান ওমর ফারুক। আওয়ামী লীগও তখন ক্ষমতায় এসেছে। ফলে তাকে আর সোনালী ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করার উদ্যোগ নিতে হয়। ব্যাংক এখন তার কাছে পায় ৪৪ কোটি টাকা। এ বিপুল অর্থ আদায়ের উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
এত যে ‘উইপোকা দমন’ অভিযান, তার মধ্যেই এসেছে নতুন খবর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্পের একটি ‘চট্টগ্রাম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়’ (চমেবি)। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক অবকাঠামো নির্মাণ এবং এক হাজার শয্যার হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনাসহ এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে দুই হাজার ৮০০ কোটি টাকা। স্মর্তব্য দুর্নীতিগ্রস্ত রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের প্রতিটি বালিশ কেনা হয়েছিল ৬,৭১৭ টাকায়। আর প্রতিটি বালিশ ভবনের নিচ থেকে ওপরে উঠাতে খরচ হয় ৭৬০ টাকা। এদিকে, চমেবিতে প্রতিটি বালিশের দাম ধরা হয়েছে ২৭ হাজার ৭২০ টাকা। আর প্রতিটি বালিশের কভারের দাম ধরা হয়েছে ২৮ হাজার টাকা। একটি সার্জিক্যাল ক্যাপের দাম ধরা হয়েছে ৮৪ হাজার টাকা। অথচ এর বাজার মূল্য মাত্র ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। সর্বোচ্চ মাত্র ৫০ টাকা দামের টেস্ট-টিউবের দাম ধরা হয়েছে প্রতিটি ৫৬ হাজার টাকা।
২০-৩০ টাকা দামের একেকটি স্টেরাইল হ্যান্ড গ্লাভসের দাম ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া ডিসপোজেবল সার্জিক্যাল ক্যাপ ও মাস্ক প্রতিটির দাম ধরা হয়েছে ৮০ হাজার টাকা। আড়াই শ’ টাকার মাল্টিপ্লাগের মূল্য ধরা হয়েছে ৬,৩০০ টাকা। ২০ টাকার ডিসপোজেবল সু-কভারের দাম ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৫০০ টাকা। দুই হাজার টাকার একটি সাদা গাউনের দাম ধরা হয়েছে ৪৯ হাজার টাকা। ৫৪ ইঞ্চি আকারের ৩০০ থেকে ৫০০ টাকার একটি রেক্সিনের দাম ধরা হয়েছে ৬৪ হাজার টাকা। আড়াই শ’ টাকা মূল্যের ৩৬ ইঞ্চি একটি তোয়ালের দাম ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার ৮৮০ টাকা। পাঁচ-সাত শ’ টাকা দামের ৫৪ ইঞ্চি সাইজের একটি রাবার ক্লথের দাম ধরা হয়েছে ১০ হাজার টাকা। এ সম্পর্কে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা: জাহিদ মালেক বলেছেন, একটি বালিশের মূল্য ২৭ হাজার ৭২০ টাকা ধরা ‘ভুল হয়ে গেছে’। ভবিষ্যতে যাতে এরকম ভুল না হয়, সে জন্য ব্যবস্থা নেয়া হবে।”
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, উইপোকারা আপনার মেগা প্রকল্প এভাবে খেয়ে ভেতর থেকে ফোকলা করে দিচ্ছে। এসব উইপোকার বিনাশ না করলে বড় বিপদ!
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
[email protected]