মনজুরুল ইসলাম
সাবেক প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক পদে নিয়োগ দিয়েছে সরকার। ৯ জুন রাষ্ট্রপতির আদেশে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। সাবেক প্রধান বিচারপতির এই নিয়োগ নিয়ে কিছু প্রশ্ন ও অসংগতি সামনে এসেছে।
‘আইনি ও নৈতিক প্রশ্ন’
বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট আইন, ১৯৯৫–এর ১১(২) ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে । এই ধারা অনুযায়ী সরকার ‘যোগ্য’ কোনো ব্যক্তিকে বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিতে পারে। এই প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক হওয়ার যোগ্যতা সম্পর্কে আইনটির ১১(১ক) ধারায় বলা হয়েছে, ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারক বা বিচারক ছিলেন বা বিচারক হইবার যোগ্য কোন ব্যক্তি মহা–পরিচালক হইবেন।’
প্রশ্ন হচ্ছে, এই ধারা অনুযায়ী হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর মহাপরিচালক হতে কি কোনো বাধা আছে? এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক একজন বিচারক এবং একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞের মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিল। তাঁদের মতে, এটা শুধু আইনি নয়, নৈতিক প্রশ্নও।
সংবিধান অনুযায়ী, ‘বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি’ এবং ‘সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারক’ বলতে একই বিষয় বোঝায় না। এ দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন পদ। এ দুটি পদের পদমর্যাদা, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স এবং গুরুত্বও আলাদা।
লক্ষণীয় হলো, ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারক বা বিচারক ছিলেন বা বিচারক হইবার যোগ্য’—এ কথা উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট আইনে বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের যোগ্যতা সুনির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী সুপ্রিম কোর্টের বিচারক থেকে পরবর্তী সময়ে প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন। এ কারণেই তাঁকে ওই পদে নিয়োগ দেওয়া আইনসংগত হয়েছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মো. আবদুল মতিন প্রথম আলোকে বলেন, রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের একটি হলো বিচার বিভাগ। যিনি প্রধান বিচারপতি হন, তিনি এর শীর্ষ ব্যক্তি। তাঁকে ‘বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি’ বলা হয়। তাই সাবেক কোনো প্রধান বিচারপতিকে এমন কোন পদে নিয়োগ দেওয়া যাবে না, যা তাঁর জন্য যথাযথ নয়। একই ভাবে যিনি প্রধান বিচারপতি ছিলেন, তাঁকে তাঁর পদের সম্মান ও মর্যাদা বজায় রেখে চলা উচিত।
বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিউট আইন, ১৯৯৫ অনুযায়ী, এ প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় একটি পরিচালনা বোর্ড দ্বারা। আনুষ্ঠানিকভাবে চেয়ারম্যান এর শীর্ষ ব্যক্তি। কর্মরত প্রধান বিচারপতি পদাধিকারবলে এই বোর্ডের চেয়ারম্যান হন। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এখন এই বোর্ডের চেয়ারম্যান।
অপর দিকে মহাপরিচালক এই প্রতিষ্ঠানের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা। সাবেক প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে এ পদে নিয়োগের ফলে তাঁকে এখন তাঁর পরবর্তী প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের অধীন কাজ করতে হবে। অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্টে যিনি জ্যেষ্ঠ বিচারক ছিলেন, বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে তিনি হবেন তাঁর অধস্তন কর্মকর্তা।
এই অসংগতি সম্পর্কে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুপ্রিম কোর্টের একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সংবিধানবিশেষজ্ঞ প্রথম আলোকে বলেন, বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট আইন, ১৯৯৫-এর বিভিন্ন ধারা থেকে স্পষ্ট যে কোনো সাবেক প্রধান বিচারপতিকে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আইনটি প্রণয়নের সময় এ রকম কোন চিন্তা নীতিনির্ধারকদের ছিল না। সে রকম কোনো উদ্দেশ্য থাকলে আইনে সেটা স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হতো।
সাবেক প্রধান বিচারপতিদের অন্য কোনো পদে নিয়োগের দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে। ব্যতিক্রম হলো আইন কমিশন। আইন কমিশন গঠনের পর থেকে বেশ কয়েকজন সাবেক প্রধান বিচারপতিকে সেখানে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ সংস্থাটি কাগজে–কলমে স্বাধীন এবং সেখানে চেয়ারম্যানই শীর্ষ পদ।
বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের নতুন মহাপরিচালক নিয়োগ নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, সাবেক প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই পদের মর্যাদা ও গুরুত্ব বিবেচনায় রাখলে তাঁর জন্য বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক হওয়া সম্মানজনক হবে না। সরকারের এই অসংগতিপূর্ণ নিয়োগ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন তৈরি হওয়ার অবকাশ রয়েছে।
কী ছিল বাহাত্তরের সংবিধানে, কী আছে এখন
বাহাত্তরের সংবিধানের ৯৯ অনুচ্ছেদ বলা হয়েছিল, অতিরিক্ত (অস্থায়ী) বিচারক ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের বিচারকেরা অবসর বা অপসারণের পর আইন পেশায় নিয়োজিত হতে পারবেন না এবং বিচারিক বা আধা বিচারিক বা রাষ্ট্রীয় কোন পদে নিয়োগ পাবেন না।
জিয়াউর রহমানের শাসনামলে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এটা পরিবর্তন করা হয়। এর ফলে অবসরে যাওয়া সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের আইন পেশায় নিযুক্ত হওয়া এবং বিচারিক বা আধা বিচারিক পদে নিয়োগ পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।
২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট হাইকোর্ট সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে। ২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ কিছু পর্যবেক্ষণসহ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে। সর্বোচ্চ আদালত পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করায় সাবেক বিচারকদের বিচারিক ও আধা বিচারিক পদে দায়িত্ব পালন নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। পরে আদালত আরেকটি পৃথক রায়ের মাধ্যমে আরও কিছু অনুচ্ছেদের মতো শর্তসাপেক্ষে ৯৯ অনুচ্ছেদও মার্জনা করে।
এর ফলে অবসরে যাওয়া সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারকদের আইন পেশায় নিযুক্ত হওয়া এবং বিচারিক বা আধা বিচারিক পদে নিয়োগ পাওয়ার সুযোগ বহাল থাকে। ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারকদের আপিল বিভাগে আইন পেশা পরিচালনার সুযোগ দেওয়া হয়।
prothom alo