৪ ফেব্রুয়ারি শনিবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস–সংলগ্ন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) মসজিদের সামনে একটি ঘটনা ঘটে। সেখানে একটি কাভার্ড ভ্যান আটকিয়ে চালক ও তাঁর ভাইকে মারধর করে তাঁদের কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা ছিনতাই করেন তিন তরুণ। ভুক্তভোগীদের চিৎকার শুনে টহলরত পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে ওই তিনজনকে আটক করে। তাঁদের কাছ থেকে টাকাও উদ্ধার করা হয়। ছিনতাইকারী তিনজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, যাঁদের মধ্যে দুজন বিজয় একাত্তর হলের গণরুমে থাকেন। গ্রেপ্তার শিক্ষার্থীরা সবাই ছাত্রলীগের কর্মী।
একই দিন রাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় পরিবারের সদস্যসহ মারধর ও ছিনতাইয়ের শিকার হন বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক কর্মকর্তা। তাঁদের কাছ থেকে ২২ হাজার টাকা ও ব্যাংকের এটিএম কার্ড ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ছিনতাইকারীদের দুজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, একজন সূর্য সেন হল শাখা ছাত্রলীগের সদস্য।
গত ১৫ জানুয়ারি রাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক দম্পতিকে মারধর, শ্লীতহানি ও স্বর্ণালংকার ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষার্থী। তাঁদের একজন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক সদস্য রাহুল রায় এবং আরেকজন কবি জসীম উদ্দীন হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তানজির আরাফাত ওরফে তুষার। প্রথমজন আইন বিভাগের, দ্বিতীয়জন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী। ছিনতাইয়ের অভিযোগে করা মামলায় দুই দিন পর গ্রেপ্তার হন তানজির। তবে এক দিনের মধ্যেই ছাড়া পেয়ে আবার ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এমন ছিনতাইয়ের ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু মাত্রাটা কী রকম বেড়েছে, সেটি বোঝা যায় গত কয়েক সপ্তাহে আরও অনেকগুলো ঘটনার মধ্য দিয়ে। এখানে এই সত্যও বেরিয়ে এসেছে, ছিনতাইকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী নন। তাঁরা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের পদধারী নেতা-কর্মী। বোঝা যায়, তাঁদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও সংগঠনের পক্ষ থেকে কেন দৃষ্টান্তমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শাস্তি বলতে সাময়িক বহিষ্কার। এটি বরং সেসব শিক্ষার্থীদের জন্য একপ্রকার আশীর্বাদই। কারণ, সাময়িক বহিষ্কারের কারণে তাঁদের শিক্ষাজীবনের মেয়াদ বাড়তে থাকে, শাস্তি পেয়ে না শোধরালে বছরের পর বছর ক্যাম্পাসে পড়ে থেকে আরও নানা অপর্কমই করে যান। আর ছাত্রলীগ তো দায়ই নিতে চায় না। এমনও দেখা গেছে, নানা অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত থেকেও বিভিন্ন সময়ে পদ-পদবী পেয়ে পুরস্কৃত হয়েছেন অনেকে। থানা-পুলিশকেও খুব একটা তৎপর হতে দেখা যায় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা নীরব ভূমিকায় থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছিনতাইকারীদের সহযোগিতায় পুলিশ সদস্যদের যুক্ত থাকারও অভিযোগ আছে।
আসুন, এবার শাহবাগ থানারই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্য দেখি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের চিহ্নিত কিছু শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায় নিয়মিত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করেন। সব জানলেও পুলিশ দায়িত্ব নিয়ে কিছু করতে পারে না। কারণ, কোনো ছাত্রকে থানায় নিতে গেলে সহযোগীরা জোট বেঁধে বাধা দেন। থানায় নেওয়া হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে দল বেঁধে শিক্ষার্থীরা চলে আসেন। পাশাপাশি কিছু ছাত্রনেতা পুলিশকে ফোন করে অপরাধীদের ছেড়ে দিতে চাপ দেন। এসব কারণে পুলিশ সদস্যরা যেচে ঝামেলায় জড়াতে চায় না।’ তার মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের যে একটি চক্র গড়ে উঠেছে, সেটি সংগঠন, বিশ্ববিদ্যালয়, পুলিশ—কারও অজানা নয়।
অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় দফা ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ দেওয়ার দাবিতে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পুলিশের লাঠিপেটার ঘটনা আমরা দেখি। কয়েক দিন আগের সেই কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ায় দুই কলেজছাত্রকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে এসে পুরোনো মামলায় গ্রেপ্তার করে শাহবাগ থানা-পুলিশ। ভয়ংকর অপরাধীর মতো তাঁদের আদালতে তুলে রিমান্ডও চাওয়া হয়। অভিযোগ আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনই ওই দুই কলেজছাত্রকে গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশকে বলে। তার মানে পুলিশ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চাইলে অনেক কিছুই করতে পারে। কিন্তু যখন ছিনতাইকারী, পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একই ক্ষমতাবলয়ের সঙ্গে যুক্ত, তখন যেন কিছুই করার থাকে না তাদের। বলা যেতে পারে, নিজেদের ক্ষমতাচর্চা ও স্বার্থ হাসিল নির্বিঘ্ন রাখতে পরস্পরকে যার যার মতো কাজ করতে দেওয়া; কেউ কারও ‘কর্মকাণ্ডে’ বাধা দেবে না।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বক্তব্য হচ্ছে, বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত থাকার দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তি দিতে দেরি করে না তারা। তবে কী কারণে এগুলো হচ্ছে, তার কারণ অনুসন্ধানের জন্য অন্যদের কাছে পরামর্শও চায় তারা। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব শাস্তি নানা অপরাধমূলক ঘটনা বন্ধে তেমন প্রভাব ফেলতে পারছে না। চিন্তা করে দেখুন, সাময়িক বহিষ্কারাদেশ কাটিয়ে একজন ছিনতাইকারী শিক্ষার্থী ঠিকই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার করে ফেললেন এবং তিনি যদি হন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতা বা কর্মী, সেই সুবাদে একটি সরকারি চাকরিও জুটিয়ে নিলেন—এরপর সরকার বা রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পদে পদে কী সর্বনাশই না তিনি করে যাবেন!
একটি ছাত্রসংগঠন যখন ক্ষমতার লাঠিয়াল বাহিনী শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে, তখন ‘বাই প্রোডাক্ট’ হিসেবে তো এমনই হওয়ার কথা। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পাশাপাশি বিভিন্ন বিভাগ, শিক্ষক ও হল কর্তৃপক্ষও কি এসব ছিনতাইকারী তৈরির পেছনের দায় এড়াতে পারবে? একজন শিক্ষার্থী যখন এমন অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত হন, তাঁর কোনো শিক্ষক কিংবা হল প্রভোস্টকে বিষয়টি পীড়িত করে কি? তাঁদের মনোবেদনা তৈরি হয় কি? একজন শিক্ষার্থী যখন ছিনতাইকারী হয়ে ওঠে, সেটি কি এসব শিক্ষক ও প্রভোস্টের জন্য লজ্জা নয়? এসব শিক্ষার্থীকে সুন্দরের প্রতি, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রতি স্বপ্ন দেখানোতে যে তাঁরা অনেকাংশেই ব্যর্থ, তা নিশ্চয়ই অনেকেই স্বীকার করবেন। কী সব কারণে সেই ব্যর্থতা, তা অন্য আলাপ।
দেখা যাচ্ছে, ছিনতাইকারীদের মধ্যে এমন অনেকে আছেন, যাঁরা হলে গণরুমে থাকেন বা ছিলেন। হলে ছাত্রলীগের সিট-বাণিজ্য বা দখলদারি নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই, যার কারণে গণরুমের মতো অমানবিক পরিস্থিতিতে থাকতে বাধ্য হন শিক্ষার্থীরা। এমন পরিবেশে থেকে একজন শিক্ষার্থী কী করে সুস্থ চিন্তা করতে পারেন? এর ফলে সেখান থেকে একজন শিক্ষার্থী যদি ছিনতাইকারী হয়ে বের হন, সেটি নিশ্চয়ই খুব অস্বাভাবিক হবে না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিজেই তো হলগুলোতে নৈরাজ্য টিকিয়ে রাখে। একজন মেধাবী শিক্ষার্থী কেন ছিনতাইকারীর খাতায় নাম লেখান, সেটি তাদের চেয়ে আর কে ভালো বোঝে? মা-বাবারা তাঁদের বুকের মানিককে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান কত স্বপ্ন নিয়ে। তাঁদের সেই স্বপ্ন ধূলিসাৎ হওয়ার পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষ তাদের দায় যত দিন না–বোঝার ভান করে থাকবে, তত দিন এমন সব ঘটনা কি বন্ধ হবে আসলে?
- রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী।