এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) হিসাবে, দেশের ব্যস্ততম রেলপথ ঢাকা-চট্টগ্রামে প্রতি বছর ৪ দশমিক ৮ শতাংশ হারে বাড়ছে যাত্রীর চাহিদা। পণ্য পরিবহন চাহিদা বাড়ছে বছরে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ হারে। ক্রমবর্ধমান এ চাহিদা পূরণের জন্য ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে লাইনের (ট্র্যাক) সংখ্যা একটি থেকে দুটিতে উন্নীত করা হয়েছে। এজন্য তিন ধাপে খরচ হয়েছে ১০ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা। দুই ধাপে রেলপথটির টঙ্গী-ভৈরব এবং লাকসাম-চিনকি আস্তানা অংশ ডাবল লাইন চালু হয় ২০১৮ সালে। শেষ ধাপে আখাউড়া-লাকসাম অংশ চালু হয় চলতি বছরের জুনে।
বিপুল পরিমাণ ব্যয়ে রেলপথটি চালু করার পর এতে এখন পর্যন্ত নতুন করে শুধু একটি পণ্যবাহী কনটেইনার ট্রেন চালু করতে পেরেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। চালু হয়নি নতুন কোনো যাত্রীবাহী ট্রেন।
ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে কক্সবাজার এক্সপ্রেস নামে নতুন একটি ট্রেন চালু হলেও এর জন্য আলাদাভাবে বিনিয়োগ করতে হয়েছে আরো প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা। এ অর্থের পুরোটাই ব্যয় হয়েছে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন ট্র্যাক বসানোয়।
কভিড মহামারীর আগের অর্থবছরে (২০১৮-১৯) সারা দেশে ৯ কোটি ২৭ লাখ যাত্রী পরিবহন করেছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে। এডিবির হিসাবে, পরের অর্থবছরে (২০১৯-২০) শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে যাত্রীর চাহিদা ছিল প্রায় ৯৯ লাখ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বার্ষিক চাহিদা বেড়ে হওয়ার কথা ১ কোটি ৩১ লাখ। পর্যায়ক্রমে বেড়ে ২০৩৪-৩৫ অর্থবছর নাগাদ যাত্রীর চাহিদা হবে প্রায় দুই কোটি।
অন্যদিকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে বার্ষিক পণ্য পরিবহন চাহিদা ছিল ৩২ লাখ ৩৭ হাজার টন কিলোমিটার (রেলে পরিবাহিত পণ্য পরিমাপের একক), যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বেড়ে প্রায় ৮০ লাখ টন কিলোমিটার হওয়ার কথা। আর ২০৩৪-৩৫ অর্থবছর নাগাদ পণ্য পরিবহন চাহিদা হবে ১ কোটি ১৪ লাখ টন কিলোমিটার।
ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে যখন একটি লাইন ছিল তখন দৈনিক ৩৬টি ট্রেন চলার সক্ষমতা ছিল। দুটি লাইন হওয়ায় রেলপথটি এখন প্রতিদিন ৭২টি ট্রেন চালানোর সক্ষমতা অর্জন করেছে। পাশাপাশি আগের চেয়ে অপেক্ষাকৃত লম্বা ট্রেন (অধিকসংখ্যক কোচ বা কনটেইনার/লাগেজ ভ্যান সংবলিত ট্রেন) পরিচালনার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে যখন একটি লাইন ছিল, তখন সক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ ট্রেন চলাচল করত। ফলে যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনে লাগত বাড়তি সময়। দুই লাইনে ট্রেন চলাচল শুরু হওয়ার পর চলাচলরত ট্রেনের সংখ্যা আর লাইনটির সক্ষমতায় সামঞ্জস্য এসেছে। ফলে ঢাকা-চট্টগ্রামে যাতায়াত করা ট্রেনগুলোয় বর্তমানে আগের চেয়ে কম সময় লাগছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের সর্বশেষ টাইম টেবিলের (৫৩ নম্বর) তথ্য বলছে, বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ ব্যবহার করছে ৭২টি ট্রেন। এর মধ্যে আন্তঃনগর ট্রেন রয়েছে ৩৮টি। মেইল, এক্সপ্রেস ও কমিউটার ট্রেনের সংখ্যা ২৬। আর আটটি কনটেইনার ট্রেন। যেখানে ১৮টি যাত্রীবাহী ও আটটি পণ্যবাহী ট্রেন ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের পুরোটাই ব্যবহার করছে। বাকি ট্রেনগুলো আংশিকভাবে ব্যবহার করছে এ রুট।
রেলওয়ে এখন ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন—কোনোটারই চাহিদা পূরণ করতে পারছে না বলে মনে করছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘একটি যাত্রীবাহী ট্রেনে কোচের সংখ্যা বাড়িয়ে যাত্রী পরিবহন সক্ষমতা বাড়ানো যায়। পণ্যবাহী ট্রেনের ক্ষেত্রেও বিষয়টি একই রকম। কিন্তু এজন্য আনুষঙ্গিক অবকাঠামো এবং সঠিক ল্যান্ড ইউজ প্ল্যান দরকার হয়। যাত্রীদের চাহিদা অনুযায়ী রুট বিন্যাস করতে হয়, যা বাংলাদেশ রেলওয়েতে খুব একটা দেখা যায় না। আবার পণ্য পরিবহন বাড়ানোর জন্য শুধু লাইন হলেই চলে না, পণ্য ওঠানামার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা (ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো বা আইসিডি) লাগে। রেলওয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথটি ডাবল লাইনে উন্নীত করতে যতটা গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, পণ্য পরিবহন অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য এর সিকিভাগও দেয়া হয়নি। তাহলে পণ্য পরিবহন বাড়বে কীভাবে? সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে ট্রেন চলাচলের সক্ষমতা আরো বাড়ানো সম্ভব।’
ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথটি ডাবল লাইনে উন্নীত করা হয় তিনটি আলাদা প্রকল্পের মাধ্যমে। একটি প্রকল্পের মাধ্যমে টঙ্গী থেকে ভৈরব পর্যন্ত ডাবল লাইন করা হয়। ২০০৬ সালে শুরু হয়ে এ কাজ শেষ হয় ২০১৮ সালে। এতে খরচ হয় ২ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা।
১ হাজার ৮০৯ কোটি টাকায় লাকসাম থেকে চিনকি আস্তানা পর্যন্ত রেলপথটি ডাবল লাইন করা হয়। এ রেলপথের কাজও ২০১৮ সালে শেষ হয়। সর্বশেষ আরেকটি প্রকল্পের মাধ্যমে আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত রেলপথটি ডাবল লাইন করা হয়, যাতে খরচ হয় ৬ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা। চলতি বছরের জুনে এ অংশটি পুরোপুরি চালু হয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ডাবল লাইন হওয়ায় ট্রেন চলাচলের সক্ষমতা বেড়েছে। যাতায়াতে সময় কমে এসেছে। নতুন করে একটি পণ্যবাহী ও একটি যাত্রী ট্রেন চালু করা হয়েছে। আরো চারটি নতুন ট্রেন চালুর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এর দুটি চলবে ঢাকা-নোয়াখালী রুটে। ঢাকা-সিলেট রুটে চলবে আরো দুটি ট্রেন। এর বাইরে পর্যায়ক্রমে ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে চলাচল করা চারটি ট্রেন ও চট্টগ্রাম-চাঁদপুরের মধ্যে চলাচল করা দুটি ট্রেনের রুট কক্সবাজার পর্যন্ত বর্ধিত করা হবে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের সক্ষমতা কতটা কাজে লাগানো হচ্ছে সে সম্পর্কে জানতে চাইলে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ডাবল লাইন হওয়ায় ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। এখন যাতায়াতে কম সময় লাগছে। এ রুটে নতুন ট্রেন চালুর সুযোগ তৈরি হয়েছে। আমরা সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করার জন্য আরো নতুন ট্রেন চালুর পরিকল্পনা যেমন করছি, তেমনি পণ্য পরিবহন সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগও নিয়েছি। কমলাপুরে আমাদের যে আইসিডি আছে, তার সক্ষমতা কম। ঢাকা-চট্টগ্রামে যত কনটেইনার পরিবহন হয় তার মাত্র ৪-৫ শতাংশ আমরা পরিবহন করতে পারি। ঢাকাসংলগ্ন ধীরাশ্রমে নতুন একটি আইসিডি করার উদ্যোগ নিয়েছি, যার কাজ শেষ হলে রেলপথে কনটেইনার পরিবহনের হার ৩০ শতাংশে পৌঁছে যাবে বলে আমরা আশাবাদী।’
বনিক বার্তা