সাক্ষাৎকার: মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : নির্বাচনের নামে এখন তামাশা হচ্ছে

নির্বাচনের নামে এখন তামাশা হচ্ছেমুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

আগামী ৭ জানুয়ারি দেশে কোনো নির্বাচন হচ্ছে না। নির্বাচনের নামে তামাশা হচ্ছে। আমরা নির্বাচন চাই। কিন্তু নির্বাচনের নামে কোনো প্রহসন চাই না। এটা দেশের মানুষও চায় না। সমকালকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সমকালের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক অমরেশ রায়

সমকাল: মাসখানেক পরই জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আপনার প্রতিক্রিয়া–

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: সরকার ও নির্বাচন কমিশন দেশে কোনো নির্বাচন করছে না। তারা কতগুলো ভুয়া, ভেজাল ও প্রহসনমূলক ঘটনা ঘটাবে। যেটার নাম তারা দিয়েছে নির্বাচন। এমনটা আমরা আগেও অনেকবার দেখেছি। বিশেষ করে ২০১৪ সালে একবার একতরফা ও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং ২০১৮ সালে আরেকবার ‘রাত্রিকালীন ভোট’ দেখেছি। সবটাই ছিল একটা তামাশার ব্যাপার। সরকার আগে থেকে নির্ধারণ করে রেখেছে– তাকে ক্ষমতায় থাকতেই হবে। এ জন্য সরকারের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের দোহাই দিয়ে একদলীয় শাসন ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চাইছে। একই সঙ্গে মানুষের ভোট ও গণতান্ত্রিক অধিকারকে হরণ করছে।

সমকাল: তাহলে কি বলতে চাইছেন, দেশে প্রকৃত নির্বাচন হোক, সেটা সরকারও চায় না?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: যদি প্রকৃত নির্বাচনই চাইত, তাহলে তো সরকার নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিত। দেশের সব মানুষই মনে করে, দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ নির্বাচন হবে না। এখন মুশকিলটা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ বা বিএনপি যখন ক্ষমতায় থাকে না কিংবা বিরোধী দলে থাকে কিংবা সরকারি প্রশাসনকে ব্যবহার করে ভুয়া নির্বাচন করতে পারে না– তখনই তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে থাকে। সরকারে গেলে তারাই আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধিতা করে। এখন যেমন আওয়ামী লীগ করছে। এভাবে যারা জনগণের দাবিকে উপেক্ষা করে, তাদের কাছ থেকে প্রকৃত নির্বাচন কীভাবে আশা করা যায়?

সমকাল: সরকার তো বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানে নেই।

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: এটা সম্পূর্ণ একটি ভাঁওতাবাজির কথা। বাঙালকে হাইকোর্ট দেখালে হবে না। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান নেই, এটা যেমন ঠিক; তেমনি সংবিধান সংশোধনের বিধান রয়েছে– সেটাও তো ঠিক। আসলে মানুষ না চাইলেও পূর্বনির্ধারিত ক্ষমতার খেলার অংশ হিসেবেই আওয়ামী লীগ জোর করে হলেও গদি দখল করে রাখতে চাইছে।

সমকাল: অনেক দলই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। আপনারা গেলেন না কেন? 

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: যারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, তার কেন যাচ্ছে– সে বিষয়ে তাদের জিজ্ঞেস করেন। আমরা নির্বাচন হলে তো যেতামই। কিন্তু দেশে তো নির্বাচন হচ্ছে না। আমরা নির্বাচন চাই। কিন্তু নির্বাচনের নামে একটা ভুয়া, ভেজাল আর তামাশার নাটকের অংশীদার আমরা কখনোই হবো না।

সমকাল: এ নিয়ে আপনারা যে আন্দোলন করছেন, সেটাও তো জোরালো করতে পারছেন না।  

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: কে বলেছে আন্দোলন জোরালো হচ্ছে না। মানুষের মনের খোঁজ নিয়ে দেখেন। এই ভুয়া ও প্রহসনের নির্বাচনের প্রতি মানুষের আর কোনো আস্থাই নেই। এটাই হচ্ছে এই আন্দোলনের সবচেয়ে বড় সাফল্য।

সমকাল: বামপন্থিদের নিয়ে একটি যুগপৎ আন্দোলনও করছেন–

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আমরা রাজপথে আছি। আমাদের আন্দোলন এখানেই শেষ হবে না। কেননা, এটি হচ্ছে মানুষের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। এই আন্দোলনে ভোটের দাবি আর ভাতের দাবি– একটি আরেকটির সঙ্গে জড়িত। লুটেরা ধনিক শ্রেণিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে না পারলে সেটা সফল হবে না।

সমকাল: বিএনপি বলছে, নির্বাচনবিরোধী সব দলকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলবে। বিএনপির পক্ষ থেকে সেই আন্দোলনে শরিক হওয়ার আহ্বান এলে কি তাতে সাড়া দেবেন?   

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: বিএনপির ডাকের জন্য তো আর আমরা অপেক্ষা করে বসে নেই। এখানে তারা লুটপাটের ভাগবাটোয়ারা পায়নি বলেই সংগ্রাম করছে। তাদের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে লুটপাটের ভাগবাটোয়ারা বুঝে নেওয়া। এ জন্য তারা সরকারের গদির বিরোধিতা করলেও সরকারের বাজার অর্থনীতি ও লুটপাটতন্ত্রের নীতির বিরোধিতা করে না। আর আমরা সরকারের গদির যেমন বিরোধিতা করি, তেমনি তাদের লুটপাটতন্ত্রের নীতিরও বিরোধিতা করি। তাদের আন্দোলনের লক্ষ্য আর আমাদের আন্দোলনের লক্ষ্য এক নয়।

সমকাল: আপনাদের আগামী দিনে কি কর্মসূচি আসতে পারে?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: কর্মসূচির মধ্য দিয়েই তো চলছি। সিপিবি ও বাম গণতান্ত্রিক জোটের পক্ষ থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করা আছে। আমাদের কর্মীরা গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছেন। মানুষকে আমরা বলছি– ‘ভোটের নামে প্রহসন হচ্ছে। ভোটকেন্দ্রে যাবেন না, ভোট দেবেন না।’ সবারই ভোট দেওয়ার জন্য প্রচারের অধিকার যেমন আছে, তেমনি ভোট না দেওয়ার জন্য প্রচার করার অধিকারও রয়েছে। তবে কারোরই জোর খাটানো উচিত নয়। কিন্তু সরকার ইতোমধ্যে জোর খাটাতে শুরু করেছে।

সমকাল: বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের বেশ দৌড়ঝাঁপও দেখা যাচ্ছে! বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে ভিসা নীতি বা নিষেধাজ্ঞার কথা বলছে।

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আমেরিকার কথা যদি বলেন, মুখে যাই বলুক– এ দেশে অবাধ নির্বাচন তো তারা চায়-ই না। ইতিহাসও সেটাই প্রমাণ করে। তাদের গোপন এজেন্ডাই হচ্ছে গ্লোবাল মিলিটারি স্ট্র্যাটেজি এবং বহুজাতিক কোম্পানির শোষণকে অগ্রসর করতে চায়। আমেরিকার আগ্রহের জায়গাটাও এখানেই।

সমকাল: চলমান সংকট নিরসনে আপনার কোনো পরামর্শ থাকবে?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আমার পরামর্শ হচ্ছে, সরকার এখনই পদত্যাগ করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিক। সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করুক। জনগণ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের তপশিল চাইছে না। জনগণ চাইছে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকার কবে পদত্যাগ করবে এবং কীভাবে সে ব্যবস্থাটা সংবিধানে গৃহীত হবে। জনগণ আরও চাইছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কীভাবে হবে এবং সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে কীভাবে সেই নির্বাচনটা হবে। এটাই এখনকার জরুরি দাবি। কেউ যদি বলে, এটা কীভাবে হবে? আমি বলব– আমি নিজেই ২৪ ঘণ্টার ভেতরে এর একটা রূপরেখা তৈরি করে দেব। নির্বাচনের তপশিলও দিয়ে দেব।

সমকাল: এরই মধ্যে নির্বাচন প্রক্রিয়া অনেকটাই এগিয়ে গেছে। এই পর্যায়ে এসে আপনার পরামর্শ বাস্তবায়নের মতো সময় কি আসলে আছে?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: কেন নয়? সংবিধানেই এটা রয়েছে– দৈব কোনো ঘটনা সৃষ্টি হলে নির্বাচনের নির্ধারিত সময়সূচি বর্ধিত করা যায়।

সমকাল