এদের বিষয়ে পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করা, দেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা, যুদ্ধাপরাধী অপশক্তি এবং জঙ্গিবাদের পক্ষে জনসর্থন আদায় করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। এদের কেউ কেউ আইএস এবং হিযবুত তাহরীরের সঙ্গেও সম্পৃক্ত বলে তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। জামায়াতে ইসলামী ও পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট বলেও এদের কাউকে কাউকে সন্দেহ করা হয়।
সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার পাঠলী ইউনিয়নের পাটলী গ্রামের বাসিন্দা রেজা আহমেদ ফয়সল চৌধুরী ওরফে সুয়েব। তিনি একসময় চ্যানেল আইয়ের লন্ডনে অবস্থিত ইউরোপ অফিসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। দুর্নীতির অভিযোগে চ্যানেল আই থেকে বাদ পড়েন বলে অভিযোগ আছে।
এ বিষয়ে চ্যানেল আইয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘মূলত আয়-ব্যয়ের হিসাব না দেওয়া, অর্থ আত্মসাৎ এবং প্রকাশ্যে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় চ্যালেন আইয়ের দায়িত্ব থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
‘স্ট্রেইট ডায়ালগ’ নামে একটি অনলাইন অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সুয়েব। তিনি কানাডার ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেজ নাগরিক টিভিতে বিশ্লেষক হিসেবেও উপস্থিত হন। সরকার, প্রধানমন্ত্রী, শিল্পপতি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে বিষোদগার ও গুজব ছড়ানোই তার কাজ। তিনি যাদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করেছেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ, এস আলম গ্রুপ, এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান প্রমুখ।
সুয়েব কনজারভেটিভ পার্টির হয়ে লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র পদে নির্বাচন করে বিপুল ভোটে পরাজিত হন। এর আগে তার প্রথম স্ত্রী ডা. আনোয়ারা আলী মেয়র পদে নির্বাচন করেন। সুয়েবের ‘স্ট্রেইট ডায়ালগ’ নামক অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশ নেন বিতর্কিত আইনজীবী ব্যারিস্টার সরোয়ার হোসেন, এম রহমান মাসুম, টিটো রহমান, নাজমুস সাকিবসহ চিহ্নিত সাইবার অপরাধীরা।
সুয়েব সম্পর্কে জানতে চাইলে সুনামগঞ্জের একজন সিনিয়র সাংবাদিক বলেন, ‘সুয়েবের কাছে কেউ ভালো নন। তার কাছে শেখ হাসিনা, সজীব ওয়াজেদ জয়, খালেদা জিয়া, তারেক রহমান কেউ ভালো নন। সুয়েব কখন কী বলেন আর কী করেন তা নিজেও জানেন না। ফেসবুক-ইউটিউবে সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে প্রতিনিয়ত কথা বলে যান। চ্যানেল আইয়ের ইউরোপ অফিসে সুয়েব কাজ করতেন ছোট্ট একটি কক্ষে। সেখানে টক শোর নামে বিভিন্নজনকে ডেকে নিয়ে অর্থ আদায় ও নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিতেন সুয়েব।’
পিনাকী ভট্টাচার্য
বগুড়া জিলা স্কুলের প্রয়াত শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শ্যামল ভট্টাচার্যের বড় ছেলে ডা. পিনাকী ভট্টাচার্য। মায়ের নাম সুপ্রীতি ভট্টাচার্য। তার ভাই অপূর্ব ভট্টাচার্য ঢাকায় থাকেন এবং বোন বুলবুল ভট্টাচার্য থাকেন বগুড়ায়। পিনাকী সনাতন ধর্ম, দেশের প্রচলিত রাজনীতি, ধর্মীয় সম্প্রীতির বিপক্ষে কথা বলায় বাবা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। ফ্রান্সে রাজনৈতিক আশ্রয় নেওয়া এই ব্যক্তি ২০২০ সালে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যান। যাওয়ার আগে তিনি নিজেই গুম হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে বিভিন্ন প্রপাগান্ডা ছড়ান।
পিনাকী ভট্টাচার্য ধর্মীয় উসকানি ছড়াতে ইউটিউবে তার নিজ চ্যানেলে সনাতন ধর্মের বিভিন্ন বিধান নিয়ে কট্টর সমালোচনা করেন। গো-হত্যার পক্ষে অবস্থান নিয়ে সনাতন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়ানোর চেষ্টা করছেন তিনি। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বিদ্রুপ করেছেন। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের বিপক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি আইনের সমালোচনার পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় নিয়ে বিদ্রুপ করে আদালত অবমাননা করে চলেছেন। পিনাকী ভট্টাচার্য মঙ্গল শোভাযাত্রা ও বাংলা নববর্ষ পয়লা বৈশাখ উদযাপন বর্জনের ডাক দিয়েছেন।
মুক্তমনা ব্লগে পিনাকী ভট্টাচার্যকে নিয়ে একজন ব্লগার লেখেন, ‘পিনাকী ভট্টাচার্য, আপনি যে কোনো বৈধ রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী হতেই পারেন। সেটি আপনার গণতান্ত্রিক অধিকার। সেটি নিয়ে আমার কোনো ধরনের বক্তব্য নেই। আপনি দ্বিমুখী চরিত্র এ কারণে, আপনি জন্মসূত্রে হিন্দু, নিজেই বলেন আপনি একজন অজ্ঞেয়বাদী (অজ্ঞেয়বাদ হচ্ছে একটি মতবাদ অথবা কতিপয় যুক্তির সমন্বয়ে গঠিত একটি ধারণা, এটি কোনো ধর্ম নয়, যদিও এটি ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করে না আবার স্বীকারও করে না)। আপনি ইসলাম ধর্মও গ্রহণ করেননি, কিন্তু দাড়ি রাখেন, টুপি ও পাঞ্জাবি পরেন, মাদরাসা শিক্ষা যে খুবই উঁচু মানের শিক্ষা তা প্রমাণ করতে রাজা রামমোহন রায়ের উদাহরণ টানেন। কিন্তু নিজের ছেলে-মেয়ে, আত্মীয় কাউকে মাদরাসায় পড়ান না, ইসলামিক শিক্ষা এত ভালো হওয়া সত্ত্বেও আপনি নিজে ও আপনার পরিবারের কেউ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেননি। এই দিকে বিবাহ নামক ধর্মীয় আচার না মেনে ওপেন রিলেশনশিপে আছেন, যেটা অবশ্য একজন অজ্ঞেয়বাদী হিসেবে আপনি করতেই পারেন, কিন্তু সেই আপনি ইসলামিক রীতির প্রশংসা করেন অথচ নিজের জীবনে তার কোনো প্রয়োগ নেই!’
উইমেন চ্যাপ্টার নামে একটি ওয়েবসাইটে লেখক শেখ তাসলিমা মুন লিখেছেন, ‘পিনাকী বুঝতে পেরেছেন এ অঞ্চলে মৌলবাদই একটি উদীয়মান শক্তি। পিনাকী অ্যানালাইসিস করে দেখেছেন, এদের ক্ষমতা ও শক্তি বাংলাদেশের যে কোনো সরকারের চেয়ে শক্তিশালী। সরকার যাবে, সরকার বদলাবে, কিন্তু এদের ক্ষমতা কেবল বাড়তেই থাকবে এবং এটাই তার সব সাহসের মূল উৎস। পিনাকী আমাদের কাছে অসৎ, অসাধু এবং একটি ভয়ংকর সন্ত্রাসের নাম। তিনি এমন একটি গ্রুপকে উপজীব্য করে বলয় গড়ে তুলেছেন, যা দেশের মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। আর পিনাকী, আপনাকে বলব, সব খেলার শেষ আছে। গেম ওভার আছে। আমরাও আপনাদের দেখছি আগ্রহ নিয়ে। মনে রাখবেন, কেউই দিন শেষে বিবেক ও বিচারের ঊর্ধ্বে নয়।’
বিশ্লেষকদের মতে, পিনাকী ভট্টাচার্য হিন্দু নাম ব্যবহার করে হিযবুত তাহরীর, আল-কায়েদা ও আইএসআইএসের মতো উগ্রবাদের পক্ষে সমর্থন আদায়ের অপচেষ্টা করছেন। এটি উগ্রবাদীদের একটি অপকৌশল মাত্র। তিনি যেসব বক্তব্য প্রচার করেন, বাস্তব জীবনে এর কোনো প্রতিফলন নেই।
তাজ হাশমী
তাজ হাশমী ২৬ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতাকে ‘বেহুদা বক্তব্য’ বলে মন্তব্য করে বিষোদগার ছড়ান। ৪ জুলাই নিজ ফেসবুক পেজে তিনি ‘তথাকথিত যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনাল নিয়ে কিছু পুরনো কথা’ শিরোনামে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিষোদগার ছড়ান। ১ জুলাই গণজাগরণ মঞ্চের সমালোচনা করে তিনি লেখেন, ‘মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও কাদের মোল্লার মতো নিরীহ মানুষকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে।’ ৭ মে তার ফেসবুক পেজে লেখেন, ‘দেশের নামাজি ও রোজাদারদের ৯০% পাকা চোর।’ ৪ মে লেখেন, ‘২০১৩-এর ৫/৬ মে রাতের আঁধারে হেফাজতের ৩০০ কর্মীকে (সরকার) গায়েব করেছিল। তেঁতুল হুজুর (আল্লামা আহমদ শফীকে কটাক্ষ করে) টাকা খেয়ে, আর জাতি কিছু না খেয়েই ভুলে গেল!’ ১৭ এপ্রিল তিনি সাধারণ মানুষকে উসকানি দিতে লেখেন, ‘নারীবিদ্বেষ, সৌদি রাজবংশ, হাসিনা সরকার ও ভারতবন্ধু ভালো মানুষ হতে পারে না।’
এগুলো তাজ হাশমীর ধর্মীয় উসকানি ও রাজনৈতিক বিদ্বেষ ছড়ানোর নমুনা মাত্র। তিনি খোলা চিঠি লেখার নামে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বিতর্কিত ও দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অপচেষ্টা করেছেন। তাজ হাশমী কানাডায় অবস্থানকারী টিটো রহমান ও নাজমুস সাকিবের সঙ্গে ইউটিউব চ্যানেল নাগরিক টিভিতে বিশ্লেষণে অংশ নেন। সেখানে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধু পরিবার, দেশের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, শিল্পগ্রুপসহ বিভিন্নজনের নামে অশালীন, মিথ্যা ও আজগুবি মন্তব্য করেন। বাংলাদেশ থেকে স্বেচ্ছায় পালিয়ে যাওয়া কয়েকজন ব্যক্তি ও ইউটিউবার ফেসবুকে তার সঙ্গে নিয়মিত টকশোতে অংশ নেন।
তাজ হাশমীর বিষয়ে জানতে চাইলে গোয়েন্দা সংস্থার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, মূলত ধর্মীয় উসকানি ছড়ানো এবং উগ্রবাদের পক্ষে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছেন তাজ হাশমী।