সাংবাদিকতা বাঁচাতে মাহফুজ আনাম সেদিন গুলোতে কোথায় ছিলেন?

 আমার দেশ
৮ এপ্রিল ২০২৩

অলিউল্লাহ নোমান

অলিউল্লাহ নোমান

অলিউল্লাহ নোমান

গত ৭ এপ্রিল প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারের বাংলা অনলাইন সংস্করণে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের একটি লেখা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা চলছে। তাঁর লেখাটির শিরোনাম-“সাংবাদিকরাই কেবল সাংবাদিকতাকে বাঁচাতে পারে”। তাঁর এই শিরোনামের যথার্থতা প্রমাণের জন্য দীর্ঘ বয়ান তৈরি করেছেন। অনেক নসিহত করেছেন সাংবাদিকতাকে বাঁচিয়ে রাখতে।

তাঁর শিরোনামের সাথে আমি একমত। সাংবাদিকরাই কেবল সাংবাদিকতাকে বাঁচাতে পারে। কিন্তু তাঁর দীর্ঘ বয়ানের সাথে আমি একমত হতে পারছি না। তাঁর দীর্ঘ বয়ান পাঠ করলে যে কারো মনে হবে, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট শুধুমাত্র প্রথম আলোর উপর প্রয়োগ করেছে সরকার। একজন ইন্ডিয়াপন্থি সিনিয়র সাংবাদিক মাহফুজ আনামকে বিনয়ের সাথে দু’টি কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।

২০১০ সালের ১ জুন আমার দেশ কার্যালয়ে শেখ হাসিনার পুলিশ হানা দিয়ে সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করেছিল। বানোয়াট কিছু পুরাতন মামলায় তাঁকে গ্রেফতার দেখিয়ে দিনের পর দিন রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছিল তখন। টানা ১৩ দিন তিনি ২০১০ সালের জুন মাসে রিমান্ডে ছিলেন। যেদিন তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, সেদিনই সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ থেকে আদালত অবমাননার একটি রুল জারি করা হয়। যদিও ‘চেম্বার মানেই সরকার পক্ষে স্টে’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছিল এপ্রিল মাসের শুরুর দিকে। এই প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করেই ২ মাস পর রুল জারি করা হয়েছিল মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের দিনে। গ্রেফতারের দিনে এই রুল জারির মাধ্যমেই প্রমাণিত হয় যে পরিকল্পিতভাবেই এই রুল জারি করা হয়েছিল। পূর্ব পরিকল্পিত এই রুলের জবাব দিতে কারাগার থেকে আমার দেশ সম্পাদককে হাজির করার নির্দেশ জারি করে শেখ হাসিনার অনুগত আপিল বিভাগ। কোন সম্পাদককে আদালত অবমাননার রুল জারি করে কারাগার থেকে আপিল বিভাগে হাজির করার ঘটনা বাংলাদেশে এটাই প্রথম। দুনিয়ার কোন সভ্য দেশে এরকম ঘটনার নজির আছে বলে আমার জানা নেই। প্রতিবেদনটি ছিল আমার (অলিউল্লাহ নোমান) লেখা। সঙ্গত কারণেই আদালত অবমাননার রুলে প্রতিবেদনের লেখককেও হাজির হওয়ার নির্দেশনা ছিল। লম্বা ফিরিস্তিতে না গিয়ে মূল কথায় চলে আসি। রুলের জবাবে শুনানী করেছিলেন আমার দেশ সম্পাদক নিজে। আমার দেশ-এর প্রতিবেদনের স্বপক্ষে প্রমান হিসাবে কিছু ডকুমন্টেস আপিল বিভাগের সামনে তিনি হাজির করেছিলেন। সেদিন ফজলুল করিমের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ৬ জন বিচারকের আসনে উপস্থিত ছিলেন। ফজলুল করিমসহ যারা বিচারকের আসনে উপস্থিত ছিলেন, তাদেরকে আমি বিচারপতি হিসাবে সম্বোধন করতে পারছি না। আমার দেশ সম্পাদক ডকুমেন্টস গুলো তাদের হাতে পৌঁছে দেয়ার পরই বিচারকের আসনে বসা আবদুল মতিন বললেন-‘এখানে ট্রুথ ইজ নো ডিফেন্স’। সঙ্গে সঙ্গে প্রধান বিচারপতির আসনে বসা ফজলুল করিম বলেছিলেন-‘আমরা এখানে সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে বসিনি’।

অনেক সাংবাদিক সেদিন আদালতে উপস্থিত ছিলেন। মাহফুজ আনাম-মতিউর রহমানের সম্পাদিত পত্রিকার রিপোর্টাররাও সেদিন উপস্থিত ছিলেন আপিল বিভাগে। আপিল বিভাগের এই মূল্যবান বাক্য গুলো তাদের পত্রিকায় প্রকাশ পায়নি। কারণ, ঘোষণা দিয়ে সত্য-মিথ্যা যাচাই ছাড়াই একজন সম্পাদক প্রতিবেদককে শাস্তি দেওয়ার ঘটনা লিখলে তাদের পাঠকরা জেনে যাবে আমার দেশ সত্য লিখেছিল। যে সত্য তারা চাপা দিয়ে রাখতে চায়। সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে সেদিন আমার দেশ সম্পাদককে তাদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্ধারিত ৬ মাসের কারাদণ্ড এবং ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছিল। প্রতিবেদক হিসাবে আমাকে এক মাসের কারাদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। উভয় জরিমানাই ছিল আইনের উর্ধ্বে। আইনে বলা আছে জরিমানা অনূর্ধ্ব ২০০০ টাকা। অথচ, আইনের গণ্ডি পার হয়ে তারা ১ লাখ এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে সম্পাদককে এক মাস এবং প্রতিবেদকে ৭ দিনের অতিরিক্ত কারাভোগ করতে বলা হয় রায়ে। আমরা তাদের পূর্ব পরিকল্পিত রায় প্রত্যাখ্যান করে অতিরিক্ত কারাভোগ করেছি।

একটি পত্রিকার সম্পাদককে ধরে নিয়ে নির্যাতন, পত্রিকাটি জোর করে বন্ধ করে দেওয়া এবং সত্য-মিথ্যা যাচাই না করার ঘোষণা দিয়ে আপিল বিভাগ কারাদণ্ড ঘোষণা কোনটাই কিন্তু সেদিন মাহফুজ আনামদের নজরে আসেনি। কারণ, আমার দেশ বন্ধের পেছনে তাদের ইন্ধন ছিল। তারা ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশকে ভারতের করদরাজ্যে পরিণত করার পথের কাটা মনে করেছিল আমার দেশ ও পত্রিকাটির সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে।

দ্বিতীয় দফায় স্কাইপ স্ক্যাণ্ডাল প্রকাশের পর ২০১২ সালের ১৩ ডিসেম্বর আমার দেশ সম্পাদকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা হয়েছিল। খুব সম্ভবত ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে প্রথম কোন সম্পাদকের বিরুদ্ধে ছিল এই মামলাটি। স্কাইপ স্ক্যাণ্ডাল দিবালোকের মত সত্য একটি ঘটনা প্রকাশ করেছিল আমার দেশ। এই মামলার ইস্যু ধরেই ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে দ্বিতীয়বারের মত পত্রিকা অফিস থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সেদিন আবারো পত্রিকাটির ছাপাখানা দখলে নেয় আওয়ামী তাবেদার পুলিশ। দ্বিতীয়বার গ্রেফতারের পর একজন সম্পাদকের বিরুদ্ধে গাড়ি ভাংচুরের পুরাতন মামলায় শ্যোন এরেস্ট দেখিয়ে দিনের পর দিন রিমান্ডে রাখা হয়। সেদিন মাহফুজ আনাম-মতিউর রহমানরা সাংবাদিকতা বাঁচানোর প্রয়োজন মনে করেননি। বরং তারা মনে করেছিলেন ভিন্নমতকে পদদলিত করেই দমন করতে হবে। ওই যে উপরে উল্লেখ করলাম, ১/১১-এর ধারাবাহিকতায় ক্ষমতায় বসা শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করার সহযোগী শক্তি এই কথিত সুশীল সম্পাদকরা। তারা আমার দেশ-এর সত্য প্রকাশের কারণে বিব্রত ছিলেন। আমার দেশ সম্পাদকের যুক্তিপূর্ণ তথ্যভিত্তিক সম্পাদকীয় মন্তব্য কলামের জবাব দেয়ার মত ভাষা তাদের ছিল না। ভাষা হারিয়ে তারা আমার দেশ বন্ধ করে দেওয়ার পেছনে ইন্ধন যুগিয়েছেন।

আমার দেশই শুধু নয়, সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ সম্পাদক হলেন আবুল আসাদ। দৈনিক সংগ্রাম একটি প্রাচীন পত্রিকা। এই পত্রিকার সম্পাদককে আওয়ামী গুণ্ডারা অফিস থেকে টেনে নামিয়ে আনে। আইনের কোন ব্যত্যয় ঘটে থাকলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা রয়েছে। কিন্তু বয়োজ্যেষ্ঠ সম্পাদক আবুল আসাদকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে আনেন আওয়ামী গুণ্ডারা। সংগ্রাম অফিস ভাংচুর করা হয় সেদিন। পরবর্তীতে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয় দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদককে।

মাহফুজ আনামের কাছে বিনয়ের সাথে প্রশ্ন রাখতে চাই। সংগ্রাম সম্পাদকের সাথে যেদিন এরকম একটি জঘন্য ঘৃণ্যতম ঘটনা ঘটেছিল তখন মাহফুজ আনাম-মতিউর রহমানদের সাংবাদিকতা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা ছিল না। তখন কি সম্পাদক ও সাংবাদিকতার উপর আঘাত আসেনি? নাকি ভিন্নমতের কোন মূল্য নেই?

এসব ঘটনা গুলোর বাইরেও চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত টেলিভিশন, ইসলামিক টেলিভিশনসহ এবং সর্বশেষ দৈনিক দিনকাল সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। হাজারো সাংবাদিক বেকার হয়েছেন। মাহফুজ আনামরা কি তখন তাদের সাংবাদিকতা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন!

তারাই তো সাংবাদিকতাকে বিভাজিত করেছেন। কতিপয় কথিত বনেদি সুশীল সম্পাদকের সমন্বয়ে তারা সম্পাদক পরিষদ গঠন করে বাকীদের আলাদা করেছেন। তারা মনে করেন, তারা যা করেন সেটাই সাংবাদিকতা! কথিত এডিটরস গিল্ড তো তাদেরই সহযোগীদের সংগঠন।

লেখা দীর্ঘ না করে পরিশেষে বলতে চাই, মুক্ত গণমাধ্যম চর্চার কোন বিকল্প নাই। মাহফুজ আনামরা মুক্ত গণমাধ্যম চর্চার কথা মুখে বলেন। তাদের পত্রিকায় লিখেন। কিন্তু তারা মনে করেন, তারা যতটুকু করতে পারেন সেটাই মুক্ত গণমাধ্যম চর্চা। বাকী ভিন্নমতের কারো কোন রকমের মুক্ত চিন্তার অধিকার থাকতে নেই। সুতরাং মাহফুজ আনামকে চিন্তা করার অনুরোধ, আমার দেশ, দৈনিক সংগ্রাম, দিগন্ত টেলিভিশন, ইসলামিক টেলিভিশন, চ্যানেল ওয়ান, দিনকালসহ আরো যেসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, সম্পাদকদের ধরে নিয়ে নিপীড়ন করা হয়েছিল, তখন আপনি কি সাংবাদিকতা রক্ষায় কখনো নিজের দায়িত্ব পালন করেছিলেন?

লেখকঃ যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত সাংবাদিক