যেসব ঘটনায় বর্তমান বাংলাদেশের সবচেয়ে বীভৎস দিকগুলো ভেসে ওঠে এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা চর্চার ক্ষেত্রে কি ধরনের ভয়ের পরিবেশ বিরাজ করছে তার বাস্তব দৃষ্টান্ত প্রকাশ পায়- এটি তেমনই একটি ঘটনা।
চট্টগ্রামে এক সাংবাদিক চারদিন নিখোঁজ থাকবার পর এক খালের পাড়ে বেহুঁশ অবস্থায় উদ্ধার হন। হুঁশ ফিরে আসলে তিনি কুঁকড়িয়ে বার বার বলতে থাকেন “আমি আর নিউজ করবোনা। ভাই, প্লিজ! প্লিজ! আমি আর নিউজ করবোনা।” তিনি মানসিকভাবে কতটা ক্ষতের শিকার হয়েছেন তা ছিলো স্পষ্ট।
উদ্ধারের কিছুদিন পর হাসপাতালে ‘দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড’ এর সাথে কথা বলেন ৩৬ বছর বয়সী এ সাংবাদিক গোলাম সরওয়ার। তিনি সাপ্তাহিক আজকের সূর্যোদয় পত্রিকার একজন নিজস্ব প্রতিবেদক এবং অনলাইন নিউজ পোর্টাল ctnewsbd এর নির্বাহী সম্পাদক। তিনি জানান:
“আমি বুধবার রাতে চট্টগ্রামের কাজীর দেউড়ি থেকে আমার গ্রামের বাড়ি চন্দনাইশ যাচ্ছিলাম। ভাড়া করা একটা মোটরসাইকেলে উঠতে যাওয়ার সময় পিছন থেকে একজন আমাকে ঝাপটে ধরে। মুহূর্তের মধ্যে আরো কয়েকজন এসে আমাকে ধাক্কা দিয়ে একটা অ্যাম্বুলেন্স এ তুলে নেয়। আমাকে সাথে সাথে অজ্ঞান করে ফেলে তারা।
“জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমি একটা অন্ধকার কক্ষে, হাত-পা বাঁধা। পাঁচজন মুখোশ পরা লোক দীর্ঘ চারদিন যাবত প্রতিদিন আমাকে মেরেছে।”
“খাবার শুধু রুটি আর পানি দিয়েছে। আমার কানে তুলা গুঁজে রাখতো যেন আশেপাশের শব্দ না শুনতে পাই। কিন্তু মাঝে মাঝে ট্রেনের শব্দ শুনতে পেতাম।
“আমাকে মারার সময় ওরা বিদ্রূপ করে বলতো আমি কোনো খ্যাতিমান সাংবাদিক না, তাই আমার জীবনের কোন নিরাপত্তা নাই। এমন রিপোর্ট কেন লিখেছি, একথা জিজ্ঞাসা করেছে তারা।
“মার সহ্য করতে না পেরে বার বার অজ্ঞান হয়ে যেতাম। জ্ঞান ফিরে আসলেই আবার মারতো।
“আমি বার বার অনুরোধ করেছি আমাকে ছেড়ে দিতে, আমি আর সাংবাদিকতা করবো না কথা দিয়েছি, কিন্তু ওরা সেকথা শোনেনি। খালি নির্দয়ভাবে মেরেছে।”
এ ধরনের গুমের ঘটনাগুলো সাধারণত পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স এর মত রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দ্বারা হয়ে থাকে। এই বাহিনীগুলো প্রধানত সরকারের নির্দেশে গুম করে। কিন্তু এর বাইরেও নিজ উদ্যোগে এ কাজে লিপ্ত হয় তারা। ক্ষমতাবান রাজনীতিবিদ বা ব্যবসায়ীদের ব্যক্তিগত বিরোধ মেটাতেও এদের ব্যবহার করা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিক ও তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদার অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল শহীদ খানের মধ্যে ব্যক্তিগত বিরোধের জের ধরে হওয়া গুমের ঘটনাগুলো।
গুম হয়ে যাওয়া কেউ কেউ ফিরেও আসেন। কিন্তু আতঙ্কে প্রায় কেউ কখনো জনসমক্ষে সরকারি বাহিনীর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে কথা বলেন না। সরওয়ার রাষ্ট্রীয় কোন সংস্থার কথা না বললেও তাতে নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই যে তারা এ অপহরণ করেনি। তবে এক্ষেত্রে সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপ নয়; বরং ব্যক্তিগত ক্ষোভ চরিতার্থ করতে এই অপহরণ ঘটেছে বলে মনে করার কারণ রয়েছে।
প্রথমত, সরওয়ারকে যেভাবে ছাড়া হয়েছে তা লক্ষণীয়। সরকারি সংস্থাগুলো সাধারণত গুম হওয়া কাউকে বেহুঁশ অবস্থায় ফেলে যায় না।
দ্বিতীয়ত, তাঁর গুম হওয়ার পেছনে কারণ রয়েছে। সাংবাদিক হিসেবে তিনি যেসব খবরগুলো করেছেন ঘটনাটি যে সেগুলোর সাথে সম্পৃক্ত তা মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো তাঁর লেখা দুটি প্রতিবেদনকে চিহ্নিত করেছে যেগুলো প্রকাশের কারণে সংক্ষুব্ধ কেউ তাঁকে অপহরণ করে থাকতে পারেন।
এরমধ্যে একটি প্রতিবেদন চট্টগ্রামে অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা সংক্রান্ত, যেখানে দাবি করা হয়েছে যে গত বছর অনেকগুলো ক্যাসিনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বন্ধ করে দিলেও সেগুলো এখন আবার খোলা হচ্ছে। এতে আরো বলা হয় যে ডিজিটাল গেমের নাম দিয়ে ক্যাসিনোর যন্ত্রাদি অবৈধভাবে আমদানি করা হচ্ছে। এ প্রতিবেদনে কোন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হয়নি।
দ্বিতীয় প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় ২৪ অক্টোবর, সরওয়ারের অপহরণের ঠিক পাঁচদিন আগে। এতে ডেভেলপার কোম্পানি জেসি কনস্ট্রাকশন লিমিটেড এর একটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তুলে ধরে বলা হয় যে, ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের ভাই আনিসুজ্জামান চট্টগ্রামে ওই কোম্পানির একটি জমি অবৈধভাবে দখলের চেষ্টা করছে। এই প্রতিবেদনটি ছিলো বেশ বিস্তারিত, যেখানে কোম্পানির চেয়ারম্যান বলছেন:
“সোমবার রাতে দেখতে পাই আমার দখলীয় জায়গার সীমানা দেয়াল ভাঙ্গা অবস্থায় রয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে আমি থানায় একটা সাধারণ ডায়েরি করি। পরে জানতে পারি ভূমি মন্ত্রীর ভাই আনিসুজ্জামান আমার জায়গা দখলে নিতে এমনটা করেছে। তিনি তাঁর বাড়ির সীমানা দেয়াল বাড়িয়ে আমার সীমানার সাথে যুক্ত করে জায়গা দখলে নিতে চাইছেন। আমি বিষয়টি নিয়ে ব্যবস্থা নেয়ায় (থানার জিডি করায়) তিনি আমাকে ফোন করে হত্যার হুমকি দিয়েছেন।”
উপরে উল্লেখ করা হয়েছে যে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু এটাও সম্ভব যে সরওয়ারের প্রতিবেদনে নাম এসেছে বা এর ফলে ক্রুদ্ধ হয়েছে এমন কেউ নিজহাতে এ ঘটনা ঘটিয়েছে।
এ বিষয়ে তদন্ত চলছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ বিষয়টাকে কতখানি গুরুত্বের সাথে দেখবে তা পরিষ্কার নয়। সরওয়ার হয়তো এতই আতঙ্কিত যে তদন্তে কোনো সহযোগিতা করার সাহস পাবে না। কিন্তু এমন প্রত্যাশা স্বাভাবিক যে সরওয়ারের সহযোগিতা থাকুক বা না থাকুক, জমি দখলের প্রতিবেদনে উল্লেখিত মন্ত্রীর ভাইকে পুলিশ অন্তত জিজ্ঞাসাবাদ করবে। তবে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে এমনটা এখনো জানা যায়নি। অবশ্য উপর থেকে নির্দেশ না এলে এমন হবে তা আশা করাও বৃথা। ধারণা করা যায়, ক্ষমতাবান রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের আদেশে ঘটা গুমের ঘটনাগুলোও রাষ্ট্রীয় গুমের মতোই তদন্তহীন থেকে যাবে।
সমধিক উদ্বেগের আরেকটি বিষয় হলো- স্থানীয় বা জাতীয় রাজনীতিবিদরা গুমের ঘটনায় নিন্দা প্রকাশ করতে এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখার আহবান জানাতে চরমভাবে ব্যর্থ। অথচ এটা প্রত্যাশিত যে বর্তমান পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দলের কোনো না কোনো জ্যেষ্ঠ নেতা একজন সাংবাদিকের অপহরণের ঘটনায় নিন্দা জানানো জরুরি মনে করবেন- কিন্তু কেউ সেটা করেননি। নীরবতা কেবলেই গভীরতর হচ্ছে।
// ডেভিড বার্গম্যান
[১০ নভেম্বর ইংরেজি ভাষায় প্রথম প্রকাশিত।]
নেত্র নিউজের মূল ওয়েবসাইট দেখুন
বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য
বাংলাদেশের বাইরের পাঠকদের জন্য
ইউটিউব চ্যানেল