সরকার মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন ধ্বংস করে দিচ্ছে : মির্জা ফখরুল

Daily Nayadiganta

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর – সংগৃহীত


সরকার মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন ধ্বংস করে দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বীর মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকার স্মরণে এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় বিএনপির মহাসচিব এই অভিযোগ করেন।

তিনি বলেন, ‘‘ যখন আমরা একটা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে বাস করছি, যথন এই সরকার একটা দানবের মতো আমাদের সমস্ত মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, গণতন্ত্রের যে সংগ্রাম তাকে ধবংস করে দিচ্ছে।”

‘‘ তখন তাকে(সাদেক হোসেন খোকা) আমাদের প্রয়োজন ছিলো দেশনেত্রীকে মুক্ত করবার জন্য, দেশকে মুক্ত করবার জন্য, গণতন্ত্রকে মুক্ত করবার জন্য।”

খোকার বর্ণাঢ্য জীবনকর্ম তু্লে ধরে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘‘ তিনি(সাদেক হোসেন খোকা) আজীবন এক সংগ্রামী মানুষ। তার এই হঠাৎ করে চলে যাওয়া আমাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে অনেকখানি ব্যাহত করবে-এই একথা আমার বলতে কোনো সন্দেহ নেই। তার সাহস, তার ধরয্য, তার দেশপ্রেম আমাদের প্রয়োজন ছিলো আজকে।”

‘‘আসুন আমরা সবাই আজ শুধু তাকে স্মরণ নয়, তার যে কাজ, তার যে পথ চলা, তার যে সংগ্রাম তাকে সামনে নিয়ে আমরা তার মতো সাহসিকতা সঙ্গে এই গণতন্ত্রকে মুক্ত করবার চেষ্টা করি, দেশনেত্রীকে মুক্ত করবার চেষ্টা করি, সত্যিকার অর্থে দেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করি।”

খোকার সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কের স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘ আমরা মনে আছে তার(সাদেক হোসেন খোকা) মৃত্যুর কিছুদিন আগে আমি নিউইয়র্ক গিয়েছিলাম তার সঙ্গে দেখা করার জন্যে। তখন তার শরীর খুব খারাপ হয়ে গেছে- বলা যায় তার শরীর কাঠ হয়ে গেছে। তিনি আমাকে তার উপরের ঘরে নিয়ে গেলেন- অনেক কথা বললেন। আমাদের তিনি কয়েকটা পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, আপনি কখনো ধৈর্য্য হারাবেন না, বিএনপির যে সংগ্রাম, গণতন্ত্রের যে সংগ্রাম- এই সংগ্রাম একদিনে শেষ হবে না, বেশ একটা দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম।”

‘‘ এই সংগ্রামে সবচেয়ে যে জিনিস দরকার হবে তা হচ্ছে ধৈর্য্য আর সমস্ত মানুষকে সম্পৃক্ত করা, সমস্ত শক্তিকে সম্পৃক্ত করা আর দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বকে আরো বেশি করে প্রতিষ্ঠিত করা। তিনি বলেছিলেন, দেশনেত্রীকে মুক্ত না করলে আন্দোলন বেগবান হবে না।”

‘করোনার শঙ্কা’ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন,‘আপনারা সুস্থ থাকুন- একথা বার বার করে এজন্য বলছি যে, আমাদের অনেক নেতা, অনেক কর্মী কিন্তু এখন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আমাদের স্ট্যান্ডিং কমিটি থেকে শুরু করে জেলা নেতারা পর্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, কোভিডে আক্রান্ত হচ্ছেন।’

‘‘ সেজন্য সবাই পারদপক্ষে সুস্থ থাকার চেষ্টা করবেন, নিরাপদ থাকবেন- এই দোয়া চেয়ে আল্লাহ কা্ছে, সবাই আল্লাহ সুস্থ রাখুন, নিরাপদে রাখুন।”

সাদেক হোসেন খোকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে কয়েকবার লন্ডনে এসে দলকে সংগঠিত করার বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাথে আলাপ করার কথাও বলেন বিএনপি মহাসচিব।

‘দেশ গণতন্ত্রহীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে’

স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘‘ সাদেক হোসেন খোকার সবসময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। আমাদের অত্যন্ত কষ্ট লাগে যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আজকে যারা মুক্তিযুদ্ধে ফেরিওয়ালা বলে দাবি করে, আজকে সরকারের সব জায়গায় যারা রয়েছে সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বার বার হত্যা করছেন।”

‘‘ একবার পঁচাত্তর সা্লে হত্যা করেছেন আবার এই সময়টা পর্যায়ক্রমে এই গণতন্ত্রকে হত্যা করে আজকে গণতন্ত্রহীন এবং বিচারহীন একটি দেশে পরিণত করেছে। যেখানে মানুষ বিচার পাচ্ছে না। যেথানে সব প্রতিষ্ঠান সরকারের করায়ত্ত হয়ে গেছে যেখানে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হওয়ার কথা। যেমন দুর্নীতি দমন ব্যুরো, বিচারালয় –সব কিছু দলীয়করণ করে মুক্তিযুদ্ধের যে মূল চেতনা তার থেকে বাংলাদেশকে অনেক দূরে নিয়ে গেছে। সেই চেতনাকে ফিরিয়ে আনতে হলে অবশ্য দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে, এর কোনো বিকল্প নাই।”

বীর মুক্তিযোদ্ধা খোকা ঢাকার মেয়র খাকাকালে রাজধানীর উন্নয়ন ও ডেঙ্গু মশক নিধনে দলমত নির্বিশে্ষে সম্মিলিত উদ্যোগের কথা তু্লেন ধরেন সাবেক চার দলীয় জোট সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

‘গেরিলারা যুদ্ধ না হলে দেশ স্বাধীন হতো না’

জেএসডির সভাপতি আসম আবদুর রব গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা খোকার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন, ‘‘ আজকে অনেকে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেন, তারা মুক্তিযুদ্ধ করেও নাই, দেখেনও নাই। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ না হলে কনভেনশন ওয়ারে পাশের দেশের সীমানার মধ্য থেকে যুদ্ধ করলেও বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। দিস ইজ রিয়েলিটি।”

‘‘ আমি-খোকা আমরা একসাথে মাঠে-ময়দানে গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করি। আমি সেই খোকাকে সালাম করি। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জীবনকে বাজী রেখে দেশমাতৃকার জন্য যে ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। দুর্ভাগ্য তার একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে দেশ স্বাধীন করার জন্য জীবন দিতে গেলেও সেই মুক্তিযোদ্ধা তার নিজের মাটিতে এসে তার প্রাণ ত্যাগ করার সুযোগটা হলো না এই সরকারের কারণে।”

তিনি বলেন, ‘‘ আজকে ঢাকা শহরে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের নামে যে বিভিন্ন রাস্তার নাম দেখি, অধিকাংশ রাস্তার নাম তার দলের নেতার নামে নয়- এই ইতিহাসটা সৃষ্টি করেছেন অবিভক্ত ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকা। এর পরে আর কেউ এটা কনটিনিউ করেননি।”

‘‘ সাদেক হোসেন খোকাকে স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে চিরদিনের জন্য বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের সাথে সম্পৃক্ত করে দিয়েছে। যুদ্ধের পরে তিনি রাজনৈতিক দলে যোগদান করেন। তিনি স্বৈরাচারি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নিজের বুকের রক্ত দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। এই রাষ্ট্র আজ দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এই রাষ্ট্রকে উদ্ধারের জন্য খোকার মতো মানুষের আজকে প্রয়োজন ছিলো।”

‘খোকার অনুপস্থিতি আমাকে পীড়া দেয়’

সাদেক হোসেন খোকার সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্কে কথা স্মরণ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘‘আগে-পরে, সামনে-পিছনে যে যাই বলুক, খোকাকে সত্যিকার অর্থে আমি ভালোবাসতাম। তার অনুপস্থিতি এখনো আমাকে পীড়া দেয়। বন্ধু হিসেবে আমাদের মধ্যে ছিলো গভীর সম্পর্ক। আমাদের মধ্যে যে ধরনের একটা সম্পর্ক ছিলো, এই সম্পর্কটা আমি এখন কারোর মধ্যে দেখি না।”

‘‘ ওই সময়ে যদি কারো সাথে কোনো রকম মনোমালিন্য থাকে তার মধ্যে কিন্তু একটা আন্তরিকতা খাকে, যদি মান-অভিমান থাকে সেখানেও কিন্তু একটা আন্তরিকতা থাকে, যদি বন্ধুত্ব থাকে সেখানে কিন্তু একটা আন্তরিকতা থাকে। আর এখন আমাদের দলের বা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে দেখা যায়, আমাদের ম্যেধ্য মধ্যে সম্পর্কটা আছে খুব বাহ্যিক, এর মধ্যে কোনো গভীরতা নাই। সেই আন্তরিকতা আজকে কেমন জানি বিলিন হয়ে যাচ্ছে। আমি দেখিছি আমার দীর্ঘ দিন রাজনীতিতে কাজ করতে গিয়ে.. ১/১১ পরেই এই পরিবর্তনটা দেখা যাচ্ছে, আগে ছিলো না এরকম পরিবর্তন।”

দলের ঐক্যবদ্ধ শক্তি জরুরী উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘ আজকে যদি এই স্বৈরাচারী সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরাতে হয় তাহলে সবাইকে পাশাপাশি থাকতে হবে, রাজনৈতিকভাবে থাকতে হবে। একে অপরকে ঠ্যাং মারার যে রাজনীতি আজকে বিএনপির রাজনীতিতে চলছে কিংবা অন্যকোনো রাজনীতি চলছে, এই রাজনীতি করে ঠ্যাং মেরে নিজেদের পা ভাংগতে পারবো কিন্তু শত্রুর আমরা কোনো ক্ষতি করতে পারবো না, কিছুই করতে পারবো না। আমার এই কথা অনেক ব্যাখ্যা হতে পারে কিংবা বিভিন্ন কথা হতে পারে।”

‘‘ এখন আমাদের দলের মধ্যে কিছু ভালো ভালো লোক আসছেন, তারা নতুন নতুন, সুন্দর সুন্দর কথা বলেন। কিন্তু সুন্দর সুন্দর কথা আর নতুন নতুন কথা দিয়ে আন্দোলন চাঙ্গা হবে না। আন্দোলন চাঙ্গা করতে হলে যোগ্যতা হলো আন্দোলনের লোক যারা আন্দোলন করেছে। যারা প্রমাণ করেছে ৯০ সালে যে আমরা আন্দোলন করতে জানি, যারা প্রমাণ করেছে ৯৬ সালে আমরা আন্দোলন করতে জানি। বলতে পারেন যে, আপনারা তো ছিলেন। হ্যাঁ ছিলাম, এখন পারবো না। নজরুল (নজরুল ইসলাম খান) ভাই কী পারবেন, ফখরুল (ফখরুল ইসলাম আলমগীর) ভাই কী পারবেন, ড. খন্দকার মোশাররফ সাহেব কি পারবেন?…”

একাত্তরের বীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক মন্ত্রী ও অবিভক্ত ঢাকার নির্বাচিত মেয়র সাদেক হোসেন প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ‘সাদেক হোসেন খোকা ফাউন্ডেশন’ এর উদ্যোগে এই ভার্চুয়াল আলোচনা সভা হয়। ২০১৯ সালের ৪ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ক্যান্সার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। পরে তার লাশ দেশে এনে জুরাইনের কবরাস্থানে দাফন করা হয়।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সালামের সভাপতিত্বে ও সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্সের পরিচালনায় আলোচনা সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বক্তব্য রাখেন।