ঢাকা
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তাঁর স্ত্রীর একটি মামলার বিচারপ্রক্রিয়া এখন এগিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে দলটি। একই সঙ্গে দলের আরও দুজন নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলার সাজা উচ্চ আদালতে বহাল রাখার রায় নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
আজ এক সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, বিএনপির নেতাদের নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্য থেকে হঠাৎ করে এসব মামলা সামনে আনা হয়েছে। তিনি বলেন, এর উদ্দেশ্য সরকার তাদের তৈরি করা সংবিধান অনুযায়ী একা একা খেলবে, গোল দিয়ে যাবে—প্রতিপক্ষ কেউ থাকবে না।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় গতকাল মঙ্গলবার বিএনপি নেতা আমানউল্লাহ আমানের ১৩ বছর ও তাঁর স্ত্রী সাবেরা আমানের ৩ বছরের কারাদণ্ড বহাল রাখেন হাইকোর্ট। দুদকের আরেক মামলায় বিএনপি নেতা ইকবাল হাসান মাহমুদের ৯ বছরের নিম্ন আদালতের সাজা হাইকোর্ট বহাল রাখেন। সম্পদের তথ্য গোপন ও আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০০৭ সালে দুদক এ মামলা করে।
অপরদিকে গতকাল ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তাঁর স্ত্রী জোবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। এ সময় আদালতে হট্টগোল ও আইনজীবীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।
এসব মামলা নিয়ে বিএনপির বক্তব্য তুলে ধরতে আজ বুধবার দুপুরে রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এই সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল ইসলাম মামলাগুলো নিয়ে তাঁদের বক্তব্য ও প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেন।
সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘হঠাৎ করে তারেক রহমান ও জোবাইদা রহমানের মামলা অস্বাভাবিক গতিতে শুরু করা হয়েছে। তাঁদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়নি। এখন প্রতিদিন একজন, দুজন, তিনজন সাক্ষী হাজির করে রাত পর্যন্ত সাক্ষ্য নেওয়া হচ্ছে।’ তিনি অভিযোগ করেন, ‘এই বিষয়গুলো নিয়ে যখন আমাদের আইনজীবীরা আদালতে কথা বলতে চেয়েছেন, তখন তাঁদের কথা বলতে দেওয়া হয়নি। শুধু তা নয়, সরকারি দলের আইনজীবীরা আক্রমণ করেছেন, এমনকি পুলিশ বেআইনিভাবে প্রবেশ করে নির্যাতন করেছে।’
বিএনপির মহাসচিব বলেন, আমানউল্লাহ আমান সম্পদের কোনো তথ্য গোপন করেননি। তাঁর সব সম্পদের হিসাব বিবরণীর সঙ্গে মিলেছে। তা সত্ত্বেও আমান ও তাঁর স্ত্রী সাবেরা আমানকে সাজা দেওয়া হয়েছে। আর ইকবাল হাসান মাহমুদের মামলাটি ইতিপূর্বে হাইকোর্টে খারিজ হয়ে গিয়েছিল। সেই মামলাকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে এসে সস্ত্রীক সাজা দেওয়া হয়েছে তাঁকে।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘অথচ একই ধরনের মামলায় আওয়ামী লীগের নেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীকে (মায়া) হাইকোর্ট খালাস দিয়েছেন। একই ধরনের মামলায় আওয়ামী লীগের নেতা প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিম, মহীউদ্দীন খান আলমগীর—তাঁদের মামলাগুলোও খারিজ করে দেওয়া হয়েছে।’
২০০৭ সালে মইনুদ্দীন-ফখরুদ্দীনের সরকারের সময়ে এ মামলাগুলো করা হয়েছিল জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব বলেন, তখন শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের সব নেতার বিরুদ্ধে মামলা ছিল। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধেও চারটি মামলা ছিল। পরে আওয়ামী লীগের সব মামলা খারিজ, অথবা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিএনপির একটি মামলাও খারিজ করা হয়নি। এখন এই মামলাগুলোতে সাজা দিয়ে বিএনপির নেতাদের কীভাবে নির্বাচন থেকে বিরত রাখা যায়, সেই পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এই যে ভয়াবহ পরিকল্পনা নিয়ে তারা মাঠে নেমেছে, এ কথাগুলো আমরা আগেও বলেছি। এখন আমাদের কানে এসেছে যে সাড়ে ১৩ শ মামলা চিহ্নিত করা হয়েছে। মামলাগুলো নির্বাচনের পূর্বেই শুনানি শেষ করে সাজা দিয়ে দেওয়া হবে। সবগুলোই রাজনৈতিক মামলা এবং আসামি হচ্ছেন বিএনপিসহ বিরোধী দলের শীর্ষ নেতারা।’
সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে মির্জা ফখরুল বলেন, অত্যন্ত চমৎকার উদ্দেশ্য। এঁদের (বিএনপি নেতাদের) যদি মামলায় আটকে ফেলা যায়, সাজা দিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে তাদের (আওয়ামী লীগের) কথামতো সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করতে পারবে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তারা (আওয়ামী লীগ) সংবিধান তৈরি করেছে। সেই সংবিধান অনুযায়ী তাঁরা একা একা খেলবেন, গোল দিয়ে যাবেন। প্রতিপক্ষ কেউ থাকবে না।
বিএনপির মহাসচিব আরও বলেন, ‘এর পরও আমরা কীভাবে বলব, এই দেশে একটা গণতান্ত্রিক নির্বাচন হওয়ার কোনো সুযোগ আছে। কীভাবে বলব, বিরোধী দলের রাজনীতি করার, জনগণের ভোট দেওয়ার, সাংবাদিকদের লেখার অধিকার আছে। তারা ভয়, ত্রাস, নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে চায়। এককভাবে নির্বাচনী বৈতরণি পার হতে চায়।’
মির্জা ফখরুল তাঁদের দলের নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার পরিসংখ্যানও তুলে ধরেন। তিনি জানান, ১৯ মে থেকে গতকাল ৩০ মে (মঙ্গলবার) পর্যন্ত সারা দেশে নতুন করে নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ১৫২টি মামলা দায়ের, সাড়ে পাঁচ হাজার জনকে আসামি এবং সাড়ে ৭ শ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এই সব মামলা–মোকদ্দমা দিয়ে, সাজা দিয়ে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পাওয়ার যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, এই আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না। নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া এই দেশে, এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হওয়া সম্ভব নয়। এখনো সময় আছে নির্দলীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে, দেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন।’
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু, বরকতউল্লা, নিতাই রায় চৌধুরী ও শামসুজ্জামান, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব মাহবুব উদ্দিন, কেন্দ্রীয় আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল প্রমুখ।