‘সরকারের ভেতরেও আরেকটা সরকার আছে’

logo

স্টাফ রিপোর্টার

২৪ জুলাই ২০২৫, বৃহস্পতিবার

mzamin

facebook sharing button

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরেও আরেকটা সরকার আছে বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। বলেছেন, এখন সরকারের নিরপেক্ষতার প্রশ্নটা, বিশেষ করে দলীয় নিরপেক্ষতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে। কারণ, এখন মোটামুটি পরিষ্কার হয়েছে যে, আমরা সরকার বলতে যাদের দেখি আনুষ্ঠানিকভাবে, আসলে তার ভেতরেও আরেকটা সরকার আছে। এটা এখন আর কোনো গোপন বিষয় নয়।

গতকাল দৈনিক প্রথম আলো কার্যালয়ে এক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেন। ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান: এক বছরের অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন,  এখানে খুবই পরিষ্কার, জনগণ আর কোনো বিষয় নয়। দেশ কোনদিকে যাবে, কীভাবে পরিচালনা হবে, জনগণ কোনো বিষয় নয়। জনগণের নামেই সবকিছু হচ্ছে, তাদের কথা বলেই সবকিছু হচ্ছে, কিন্তু জনগণকে আমরা গণনার বাইরে ফেলে দিয়েছি। আলোচনায় বিশিষ্টজনরা অংশ নেন।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বৈষম্যবিরোধী চেতনায় আমরা নতুন সরকার আনলাম। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী চেতনাকে তারা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ও সংস্কার প্রক্রিয়ায় প্রতিফলন করতে পারলো না। সরকারের কোনো নৈতিক অবস্থান পরিষ্কার করা নেই। সর্বজনীন মানবাধিকারের ভিত্তিতে অর্থনৈতিক বিকাশকে চিন্তা করছে এবং দুর্বল জনগোষ্ঠীর পক্ষে দাঁড়াবে, সেই দুর্বল জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে তার পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য পদক্ষেপের ভেতরে গেল না এখন পর্যন্ত। সেহেতু সংস্কারের যেটুকু সম্ভাবনা ছিল, সংস্কারের সেই সম্ভাবনাটুকু গরিব মানুষ তো পরের কথা, এমনকি উৎপাদনশীল উদ্যোক্তা শ্রেণিও তার ভেতর এলো না।

তিনি বলেন, দু’টি মৌলিক প্রশ্ন এখন সামনে এসেছে। একটি হলো অন্তর্বর্তী সরকার। অর্থাৎ তার শুরুও আছে এবং একটা সুনির্দিষ্ট সীমিত সময়ের পরে তার শেষ আছে। এই জিনিসটাকে সামনে নিয়ে আসার এখন সময় হয়েছে যে, এটা একটা অনন্তকালীন সরকার নয়, এটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তাহলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি হয়, তাহলে প্রথমে এখন যে দু’টি প্রশ্ন সবাইকে বিচলিত করছে, অন্তত আমাকে করে, এক নম্বর প্রশ্ন হলো- সরকারের নিরপেক্ষতা। একটা সরকারের নিরপেক্ষতা বললে তার মৌল আদর্শগত নিরপেক্ষতার কথা বলা হয় না। কারণ, সে পিছিয়ে পড়া মানুষের পক্ষে থাকবে এবং এটার একটা সংকট সৃষ্টি হয়েছে, যেহেতু দুর্বল জনগোষ্ঠীরা আরও বেশি দুর্বল বোধ করছে, অনেক বেশি বিপন্ন বোধ করছে। একটা স্বৈরাচারী সরকারের আমলে যে রকমভাবে তাদের প্রতি অত্যাচার বা তাদের প্রান্তিকীকরণ হয়েছে, ঠিক একই রকমভাবে নারী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, জাতিগত সংখ্যালঘু…। লিঙ্গ বৈচিত্র্যের কথা তো বলাই যাচ্ছে না। এটা আরেক সমস্যা হয়ে গেছে।

অন্তর্বর্তী সরকার চাইলেও এখন একটা ভালো নির্বাচন করতে পারবে কিনা, বৈঠকে সেই প্রশ্ন রেখে অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আপস, আঁতাত বা সিট ভাগাভাগির নির্বাচন নয়, একটা প্রকৃত নির্বাচন। যেখানে মানুষ ভোট দেয়ার পর শান্তিতে থাকবে। শুধু ভোটের দিন নয়, ভোটের পরের দিনও সে থাকবে। সেহেতু দ্বিতীয় প্রশ্নটা দাঁড়িয়েছে এটা এবং এই প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই নির্বাচন করতে হলে অবশ্যই শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা খুব ভালো বুঝছি যে, প্রশাসনিক ক্ষমতা ও প্রচলিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে এটা করা সম্ভব নয়। সেনাবাহিনীর বৃহত্তর অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে এটা করা সম্ভব নয়। আমি সাধারণভাবে বুঝি যে, তিন-চার মাসের জন্য তাদের মাঠে থাকতে হবে এবং তারা আসার পরেই প্রথমে অস্ত্র উদ্ধারের কাজটা করতে হবে। একই রকমভাবে হয়তো স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে যুক্তভাবে তারা কী করবে…।

সেক্ষেত্রে ইন এইড টু সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অথবা স্ট্রাইকিং ফোর্সের বাইরে গিয়ে কিছু একটা হতে হবে এবং সেনাবাহিনীর আরেকটু প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় অংশগ্রহণ লাগবে উল্লেখ করে দেবপ্রিয় বলেন, ‘কিন্তু সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সম্পর্ক মানুষের দুশ্চিন্তার কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ফলে সরকারের নিরপেক্ষতা ও সরকারের সক্ষমতা- এই দুটো বিষয় এখন দুটো বড় প্রশ্ন। যেহেতু এটা অন্তর্বর্তী সরকার, আমি মনে করি সরকারের সময় হয়েছে একটা ডেস্ক ক্লিয়ারিং লিস্ট করার। এখন যদি জাতির উদ্দেশ্যে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা বক্তৃতা দেন, আমি প্রত্যাশা করবো যে, তিনি কী দিয়ে সমাপ্ত করতে চাইছেন, সেটাকে তিনি পরিষ্কার করবেন। যেসব সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেগুলো কোথায় কোথায় তিনি শেষ করবেন, কোথায় কোথায় অংশগ্রহণ করবেন…।’
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, ‘সংস্কার একটা অব্যাহত প্রক্রিয়া। রাজনৈতিক নেতাদের এখন নির্বাচনের ইশতেহার দিতে হবে। ওই ইশতেহারে আমাদের নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে আলোচনা বা আন্দোলন দরকার হলে, তা করা দরকার। দেশ থাকবে, জনগণ থাকবে, সরকার আসবে-যাবে। এই চিন্তাটা মাথায় রেখে জাতি গঠনের এই অবস্থান থেকে ওই উত্তরণের জায়গাটাতে পৌঁছাতে হবে। এখন গত বছরের মূল্যায়নের চেয়ে আমি আগামী এক বছরের এই নিষ্ক্রমণ পদ্ধতিটা কী হবে বা এক্সিট পলিসিটা কী হবে, সেটার জন্য কী কী প্রয়োজন পড়বে, সেগুলোর ওপর গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেছি।’

বৈঠকে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর হতে চলেছে। গত এক বছরে সরকারের কার্যক্রম নিয়ে শক্ত কথা বলার সময় এসেছে বলে মনে হচ্ছে।

জিল্লুর রহমান বলেন, মিষ্টি কথা, ভালো কথা, ভালো উদ্যোগ ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কিছু হয়েছে। আমরাও অনেক ধরনের আশাপ্রদ, অনেক কিছু দেখেছি। আজকের ফ্রেমিং আমার দৃষ্টিতে হতে হবে, পাওনার হিসাব এবং উত্তরণের পথরেখা। আজকে পাওনার হিসাবটা খুবই জরুরি। বিচার, সংস্কার, নির্বাচন- এই বিষয়গুলোতে এক বছরে কী কী হলো, সেই পাওনার হিসাবটা আজকে মূল কথা হতে হবে।

তিনি বলেন, ‘করণীয়র কথা যদি বলি, মানুষকে গণনার বাইরে ফেলে দিয়েছে, মানুষ যে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে; এখন দর্শক, এত বিশাল একটা পরিবর্তনে অংশগ্রহণকারী নয়। মূল কাজ হতে হবে এই মানুষকে কীভাবে দর্শক থেকে সক্রিয় অংশগ্রহণকারীর পর্যায়ে আবার নিয়ে আসা যায়। সেটার একটা মাধ্যম অবশ্যই নির্বাচন। কিন্তু এর পাশাপাশি আরও অনেকভাবে চিন্তা করতে হবে। এ ছাড়া সক্ষমতায় যে ধস নেমেছে, এ ব্যাপারে আমাদের একটা চিৎকার দিতে হবে। প্রয়োজন হলে এটার বিদায় দিতে হবে। যারা দায়িত্বে আছেন, তাদের এটা শুনতে হবে। তাদের শুনতে হবে, সক্ষমতার এই ধস পাল্টাতে হবে। মানুষকে গণনার বাইরে নিয়ে যাওয়া যাবে না। কাগুজে প্রক্রিয়ায় আমাদের মেধা ও মনোযোগ সবকিছু আটকে রেখে জাতীয় ঐক্যকে পশ্চাতে ফেলে দেয়া যাবে না।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার চার দলের শীর্ষ নেতাদের হওয়া বৈঠকের প্রতি ইঙ্গিত করে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, এখানে খুবই পরিষ্কার, জনগণ আর কোনো বিষয় নয়। দেশ কোনদিকে যাবে, কীভাবে পরিচালনা হবে, জনগণ কোনো বিষয় নয়। জনগণের নামেই সবকিছু হচ্ছে, তাদের কথা বলেই সবকিছু হচ্ছে, কিন্তু জনগণকে আমরা গণনার বাইরে ফেলে দিয়েছি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমি দেখতে পাচ্ছি, একধরনের বাংকার মেন্টালিটি আস্তে আস্তে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। বাংকার মেন্টালিটি হয় তখন, যখন সবকিছু একটা নির্দিষ্ট লেন্স দিয়ে শুধু দেখা হয়, মানুষকে সহযোগী হিসেবে না দেখে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিগুলোকে নিয়েই চেষ্টা করা হয়। এখানে একইসঙ্গে এটাও বলা দরকার, পতিত সরকারের অনুশোচনাহীন সমর্থক গোষ্ঠীর দেশকে অস্থিতিশীল করার নানামুখী প্রচেষ্টা একটা বিরাট বিপদ হিসেবে সমাজের মধ্যে আছে বটে; কিন্তু বাংকার মেন্টালিটি দিয়ে এটা কোনোদিনও সমাধান করা যাবে না।

কাগুজে ঐকমত্যের প্রক্রিয়া সরাসরি জাতীয় ঐক্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেন হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, জাতীয় ঐক্য ও কাগুজে ঐকমত্য প্রক্রিয়া মুখোমুখি অবস্থানে আছে। জাতীয় ঐক্য আসলে পেছনে পড়ে গেছে। জাতীয় ঐক্যের প্রতি মনোযোগ নেই। এই কাগুজে ঐকমত্যের প্রক্রিয়াটা জুলাই-আগস্টের জাতীয় ঐক্যের শক্তিটাকে আমরা পেছনে ফেলে দিয়েছি। কেতাবি যোগ্যতার একটা প্রচণ্ড সমাহার হয়েছে এবং একই সময়ে সক্ষমতার বিশাল ধস নেমেছে। কেতাবি যোগ্যতার সমাহার, একটা নির্দিষ্ট ধরনের আচরণ আর প্রকৃত সক্ষমতার ধস-এখানে আমরা একটা বড় ধরনের বৈপরীত্য দেখতে পাচ্ছি। মন্ত্রণালয়, নীতিনির্ধারণ, নেগোসিয়েশন-প্রতিটা ক্ষেত্রেই আমরা সক্ষমতার ধস দেখছি। কিন্তু ওই কেতাবি যোগ্যতার খুবই সরব ও খুবই প্রবল উপস্থিতি আছে। সেই অর্থে জনগণ গণনার বাইরে চলে গেছে। নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে।

বৈঠকে অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বিভিন্ন ক্ষেত্রে চলমান নানা সংকটের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, শিক্ষা, আইনশৃঙ্খলা ও বেকারত্ব- এখানে যদি পাওনার হিসাব দেখি, এটা একটা ভয়াবহ অবস্থা। গত পরশু তো ট্র্যাজেডি দেখলাম। কিন্তু সাধারণ সময়ে শিক্ষা ঘিরে যে আকাঙ্ক্ষাগুলো, সেখানে একটা ভয়াবহ বাস্তবতা আছে। সেদিন বগুড়ায় গেলাম, একটা মতবিনিময়ে একই চিত্র উঠে এলো। আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে মবের কথা বলা হচ্ছে বটে, কিন্তু বগুড়ায় গিয়ে অদ্ভুতভাবে শুনলাম যে সবাই নাকি ছুরি মারছে সবাইকে! ছুরি মারাটা স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে।

হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত হয়তো একটা ধারণা ছিল যে, প্রাতিষ্ঠানিক ভিন্ন পথে আমরা এগুবার চেষ্টা করবো। চেষ্টাও হয়তো ছিল। কিন্তু পরে নরমাল স্টেট ডাইনামিকস বুঝে গেছে যে বড় কিছু হবে না। ডিসেম্বরের পর থেকে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি পূর্ণোদ্যমে আবার নিজেকে এসার্ট করেছে। হাসিনার পলায়ন এবং ওই সরকারের পতন, এটাতে আমাদের অবশ্যই একটা আকাঙ্ক্ষার বিস্ফোরণ ঘটেছে। সেটা একটা বাস্তবতা আছে বটে; কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি প্রচণ্ডভাবে ফিরে এসেছে। আমলা কর্তৃত্ব পূর্ণাঙ্গভাবে জেঁকে বসে আছে।

যে মানুষ পরিবর্তন এনেছিলেন, যাদের অংশগ্রহণে পরিবর্তন এসেছিল, তারা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এই গুটিয়ে নেয়াটা একটা সিগনাল। এই গুটিয়ে নেয়াটা সর্বকালের জন্য নয়। তারা দেখেছে, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল, তারা দেখছে যে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ও কথার ফুলঝুরির মারপ্যাঁচে আসলে চলছে অন্য ব্যাপার।
বৈঠকে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে যেসব কাজ দরকারি ছিল, তার উল্টো যাত্রা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এক বছরের মাথায় এমনটা ঘটেছে। তিনি বলেন, স্পষ্ট করে অভিযোগ করতে পারি। জবাব চাইতে পারি। আনু মুহাম্মদ বলেছেন, মানুষের মধ্যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, শেখ হাসিনার মতো স্বৈরচারী সরকার আসবে না। একটা গণতান্ত্রিক রূপান্তর হবে। এই গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রক্রিয়াতেই মার খেয়ে গেলাম।

আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, বৈষম্যহীন বাংলাদেশের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ধর্ম, জাতি, শ্রেণি বা লিঙ্গের নামে বৈষম্যবাদী রাজনীতি ও দর্শন যারা ধারণ করে, তাদের দাপট দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, তারাই এই অভ্যুত্থান করেছে। অভ্যুত্থানে নারীর অংশগ্রহণ ব্যাপক ছিল উল্লেখ করে আনু মুহাম্মদ বলেন, নারীকে আক্রমণকারী প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার দাপট বেশি। আদিবাসী, সংখ্যালঘুদের অংশগ্রহণ ছিল। কিন্তু তাদের ওপর আক্রমণ হয়েছে। আন্দোলনে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পেরিয়ে গেলেও দেশের বিচার ব্যবস্থার ভেতরে ভয় এখনো কাটেনি। বলেছেন, বাংলাদেশে এখন কোনো ভয়ভীতি নেই, এমনটা কেউই বলতে পারবে না। ভয় বিচার ব্যবস্থার ভেতরেও আছে, বাইরেও আছে। বিচারপতিদের সবারই চিন্তা হচ্ছে, আমি কী করলে, কে আমার বিরুদ্ধে কথা বলবে। কোনো একটা গোষ্ঠী তার বিরুদ্ধে কিছু একটা নিয়ে জোরে আওয়াজ তুললেই তো শেষ। সে বিচারপতির আর কোনো ভবিষ্যতই থাকবে না। এমন ভয়ের পরিবেশে কে ঠিকমতো রায় দেবে বলুন? রায় তো দূরের কথা, আদেশই বা কে দেবে?

বৈঠকে সারা হোসেন বলেন, গত এক বছরে বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা নিয়ে অনেক কথা হলেও এর কাঠামোতে এমন কোনো পরিবর্তন আসেনি, যেটা নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। প্রাথমিকভাবে যেসব পরিবর্তন এসেছে, সেগুলো ঠিক ছিল কিনা, সেসব নিয়ে আরও আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। হাইকোর্টের বিচারকদের সরিয়ে দেয়া হয়েছে কেন? সেসব কারণ আমরা আজো জানি না। এগুলো নিয়ে কথাও বলা যাচ্ছে না। এ নিয়ে পত্রিকাগুলোও বেশি কিছু লেখার চেষ্টা করছে না।

বৈঠকে লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান বলেন, এখন নির্বাচন ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তিনি বলেন, আমরা একটা অদ্ভুত সমস্যার মধ্যে আছি, গণতন্ত্র চাই, কিন্তু নির্বাচন চাওয়া যাবে না। এখন নির্বাচনকে ঠেকিয়ে দেয়ার বা নির্বাচনকে বিলম্বিত করার একটা চেষ্টা আছে। নির্বাচন পিছিয়ে দেশ যদি গোল্লায়ও যায়, কিছু মানুষের লাভ আছে। কিন্তু আপনি যখন সামনে নির্বাচন দেখবেন না, তখন আপনার চরিত্র নষ্ট হবে।

জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচনের বিষয়ে উদ্বেগ জানানো হচ্ছে- উল্লেখ করে জাহেদ উর রহমান বলেন, এই প্রশ্নটা ভুলও নয়। আমি মনে করি, বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক উত্তরণে বাধা দেয়ার জন্য দেশের অভ্যন্তরে, বাইরে এবং বেশ কিছু শক্তি চায় যে, আমরা একটা মোটামুটি নৈরাজ্যকর অবস্থায় যাই। আমাদের এখন নির্বাচন ছাড়া আসলে আর কোনো উপায় নেই। এই জিনিসটা আমাদের প্রতিটি জায়গা থেকে বলতে হবে।

নির্বাচনকে খাটো করার প্রবণতা আছে বলে মন্তব্য করেন জাহেদ উর রহমান। তিনি বলেন, আই অ্যাম স্যরি, নির্বাচন এত ছোট বিষয় নয়। যথেষ্ট এম্পিরিকাল (প্রায়োগিক) প্রমাণ আছে যে, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন যদি একটার পর একটা হতে থাকে, তাহলে দেশের পরিবর্তন হতে বাধ্য হয়। আপনি যখন সামনে নির্বাচন দেখবেন না, তখন আপনার চরিত্র নষ্ট হবে। ফলে সামনে একটা অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখাটা জরুরি।

‘কিছু কিছু রাজনৈতিক দল হয়তো নির্বাচনে জিতবে না, কিন্তু সে এখন নানা রকম ক্ষমতা চর্চা করতে পারছে; বিভিন্ন নিয়োগ-পদায়ন, বদলি, বিভিন্ন রকম টেন্ডারে অনেকে তদবির করতে পারছে। ফলে নির্বাচন পেছানোর চেষ্টা থাকবে এবং মূল চেষ্টা হবে নিরাপত্তাকে কেন্দ্র করে।’

জাহেদ উর রহমান বলেন, সবকিছু যদি আমরা যোগ করি, আমরা আসলে ভালো অবস্থায় নেই। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। আসলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।… এখন নির্বাচনকে ঠেকিয়ে দেয়ার বা নির্বাচনকে বিলম্বিত করার একটা চেষ্টা আছে। নির্বাচন পিছিয়ে গেলে দেশ যদি গোল্লায়ও যায়, কিছু মানুষের লাভ আছে।

বাংলাদেশ এখন একটা অ্যাকিউট ইমার্জেন্সি সিচুয়েশনে (গভীর জরুরি অবস্থা) আছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, নির্বাচনটা হওয়া আমাদের রোগীর জীবন বাঁচা। এরপর কারণগুলো খুঁজে ক্রমাগত চিকিৎসা করে যেতে হবে এবং একটা দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা লাগবে। শেখ হাসিনা যে সংকট তৈরি করে গেছে, এগুলো থেকে প্রতিকারের সংক্ষিপ্ত কোনো উপায় নেই।
জুলাই অভ্যুত্থানে কোনো সংগঠিত শক্তি ছিল না উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা মনে করছি এটা একটা বিপ্লব, একটা বিপ্লবী সরকার হতে পারে এবং আমরা শিক্ষার্থীদের অনেকটা রেড গার্ডের মতো ব্যবহার করার চিন্তা করছি বা এখনো অনেকে সেই খোয়াব দেখছি। এগুলোর ফলে সমস্যা তৈরি হচ্ছে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর গত এক বছরে ভালো অভিজ্ঞতা অল্প, খারাপ অভিজ্ঞতাই বেশি বলে মন্তব্য করেন লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ। তিনি বলেছেন, স্বল্প দক্ষ বা অনেকটাই অদক্ষ এমন একটা সরকারের অধীনে থাকার দুঃখ গত এক বছরে মোকাবিলা করতে হয়েছে।

আলতাফ পারভেজ বলেন, এই প্রথম ফেসবুকের দিকে তাকিয়ে সরকার পরিচালনার একটা সংস্কৃতি দেখলাম এবং জনতুষ্টিবাদের কাছে বারবার আত্মসমর্পিত হতে দেখলাম। সমাজজুড়ে বিপজ্জনকভাবে সুনামির মতো একটা দক্ষিণপন্থি মনোভাবের বিস্তার ঘটেছে। ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে মব সহিংসতা বেড়েছে।

তিনি বলেন, ভবিষ্যতে যেটা দেখতে পাচ্ছি, যেটাকে আমরা ২০২৪ সালে ফেলে এসেছি, সেই একই ধরনের রাষ্ট্র যেন আবার হাজির হচ্ছে। একই ধরনের সরকারব্যবস্থা বোধ হয় আমরা পেতে যাচ্ছি। এই মুহূর্তে সবচেয়ে উদ্বেগের ব্যাপার, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে জুলাই সনদ নিয়ে যে আলোচনা হচ্ছে, তার ভেতরের খবর যদি আমরা বিবেচনা করি, জুলাই সনদে উল্লেখযোগ্য তেমন মৌলিক কোনো রূপান্তরের আলাপ থাকছে না। যদি না থাকে এবং না থাকার পরও যদি একটা সনদ হয়, তার সাংবিধানিক কী স্ট্যাটাস হবে, সেটাও একটা উদ্বেগের ব্যাপার। গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনায় আরও অংশ নেন- লেখক ও চিন্তক ফরহাদ মজহার, অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস, নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমন, লেখক ও গবেষক মাহা মীর্জা, তরুণ গবেষক সহুল আহমদ প্রমুখ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here