সরকারের কাছ থেকে প্রণোদনা ও ভর্তুকির অর্থ পাচ্ছে না ব্যাংক

রেমিট্যান্সের নগদ প্রণোদনা বাবদ সরকারের কাছে প্রায় ৪৬ কোটি টাকা পাবে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি) পিএলসি। অন্যান্য খাতের প্রণোদনা বা ভর্তুকি হিসেবেও প্রায় ৬০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে ব্যাংকটির। রফতানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে ব্যাংকটির পাওনা অর্থের পরিমাণও প্রায় ১৪ মিলিয়ন ডলার। সব মিলিয়ে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রায় ২৬০ কোটি টাকা পাবে এমটিবি।

এমটিবির চেয়েও সরকারের কাছে বেশি অর্থ পাবে ঢাকা ব্যাংক পিএলসি। ব্যাংকটির শুধু সার আমদানির ভর্তুকি বাবদ সরকারের কাছে ৪৩৭ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। রেমিট্যান্সের নগদ প্রণোদনা বাবদও প্রায় ৬০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে ঢাকা ব্যাংকের। বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজের সুদ ভর্তুকি বাবদ আরো প্রায় ২০ কোটি টাকা পাবে ব্যাংকটি।

শুধু বেসরকারি এ দুটি ব্যাংকই নয়, বরং সরকারের কাছে অর্থপ্রাপ্তির এ তালিকায় দেশের সবক’টি ব্যাংকেরই নাম রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের বিপরীতে সরকারের কাছে প্রাপ্য প্রণোদনার অর্থ প্রায় ছয় মাসের বকেয়া পড়েছে। ব্যাংকগুলোর সার আমদানির ভর্তুকিও বকেয়া পড়েছে প্রায় দুই বছরের। এছাড়া সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ও পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের ভর্তুকিও যথাসময়ে পরিশোধ করা হচ্ছে না। দেশের বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে সরকারের কেনা প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার বিদ্যুৎ বিলও বকেয়া পড়েছে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) বকেয়া এ বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করলে সে অর্থ ব্যাংকগুলোয় জমা পড়ত। এ অর্থ থেকে ব্যাংকের ঋণের কিস্তি সমন্বয় করা সম্ভব হতো।

এরই মধ্যে বস্ত্র খাতসহ অন্যান্য খাতের রফতানিতে নগদ সহায়তা বাবদ প্রাপ্য বকেয়া ৪ হাজার কোটি টাকা চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়েছে খাতটির উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিকেএমইএ। আবার বকেয়া বিদ্যুৎ বিল চেয়ে সরকারের কাছে এক বছরের বেশি সময় ধরে চিঠি দিয়ে আসছে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন (বিআইপিপিএ)। ব্যাংকগুলোও নিজেদের বকেয়া অর্থ চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবেদন জানিয়ে আসছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের বকেয়া বিদ্যুৎ বিল, বিভিন্ন ধরনের ভর্তুকি ও প্রণোদনার অর্থের পরিমাণ অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকা। সরকার এ অর্থ পরিশোধ করলে সেটি দেশের ব্যাংক খাতে তারল্য হিসেবে যুক্ত হতো। এতে বিরাজমান তারল্য সংকট অনেকাংশেই কেটে যেত।

সরকারের কাছ থেকে বকেয়া অর্থ না পাওয়ায় দেশের ব্যাংক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘‌ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্সের প্রণোদনার অর্থ তাৎক্ষণিকভাবে গ্রাহকদের পরিশোধ করে। নগদে পরিশোধ করে দেয়া সে অর্থ পেতে যদি তিন-চার মাস লেগে যায়, সেটি দুঃখজনক। এক বছর আগে রেমিট্যান্সের প্রণোদনার অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অগ্রিম পেতাম। এখন বকেয়া অর্থ চেয়েও আবেদন করতে হচ্ছে। ইডিএফসহ বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনার অর্থ চেয়ে আবেদন করেছি।’

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘‌দেশের ব্যাংক খাতে এখন তারল্য সংকট চলছে। ঋণগ্রহীতারা যথাসময়ে ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ করছে না। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলোয় নগদ প্রবাহ (ক্যাশ ফ্লো) কমে যাচ্ছে। সরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে বকেয়া অর্থ পরিশোধ করলে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকট কাটিয়ে উঠতে পারত।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হকও মনে করেন, সরকারের কাছে পাওনা প্রণোদনা ও ভর্তুকির অর্থ পাওয়া গেলে ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট কিছুটা হলেও কমত। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘‌আগে রেমিট্যান্সের প্রণোদনার অর্থ অগ্রিম পরিশোধ করা হতো। এখন সেটি বকেয়া পড়েছে। রফতানি প্রণোদনাসহ বিভিন্ন খাতের কিছু ভর্তুকিও বকেয়া রয়েছে। এ অর্থ পরিশোধ করা হলে ব্যাংকগুলো উপকৃত হতে পারত।’

মূল্যস্ফীতি কমানোর লক্ষ্য বাস্তবায়নেও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এসব অর্থ ছাড় কমিয়ে দেয়া হতে পারে বলে জানান মেজবাউল হক। তিনি বলেন, ‘‌মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য সরকার তার নিজস্ব ব্যয় কমিয়েছে। পাশাপাশি বাজার থেকে ঋণ নেয়ার মাধ্যমে সরকার অতিরিক্ত তারল্য তুলে নিচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোভাবও একই। সরকারের নীতির কারণেই প্রণোদনা, ভর্তুকিসহ এ খাতের অর্থ ছাড় কমতে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এসব অর্থ বিতরণের দায়িত্ব পালন করে। মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ ছাড় করা না হলে আমরা বিতরণ করতে পারি না।’

২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে প্রথমবারের মতো দেশে রেমিট্যান্সের বিপরীতে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা বা নগদ সহায়তা প্রদানের ঘোষণা দেয়া হয়। ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি এ প্রণোদনার হার বাড়িয়ে আড়াই শতাংশে উন্নীত করা হয়। শুরুর দিকে সরকারের পক্ষ থেকে রেমিট্যান্সের প্রণোদনার অর্থ অগ্রিম পরিশোধ করা হতো বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রতি ত্রৈমাসিকের শুরুতে আমরা ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে প্রণোদনার সম্ভাব্য একটি বাজেট নিতাম। ব্যাংকগুলো ওই তিন মাসে কী পরিমাণ রেমিট্যান্স আসবে, সেটি পর্যালোচনা করে বাজেট দিত। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগ থেকে প্রণোদনার সে অর্থ ব্যাংকগুলোর হিসাবে অগ্রিম পরিশোধ করে দেয়া হতো। পরবর্তী সময়ে রেমিট্যান্স আসার নিরিখে অগ্রিম পরিশোধ করা অর্থ সমন্বয় হতো। কিন্তু চলতি বছরের শুরু থেকে অন্যান্য প্রণোদনা ও ভর্তুকির মতো রেমিট্যান্সের প্রণোদনাও বকেয়া পড়তে শুরু করেছে।

রেমিট্যান্স ছাড়াও সব ধরনের পণ্য রফতানির বিপরীতে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন হারে প্রণোদনা বা নগদ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া সার আমদানির এলসির বিপরীতে সরকারের পক্ষ থেকে ৭০ শতাংশ অর্থ ব্যাংকগুলোকে ভর্তুকি হিসেবে পরিশোধ করা হয়। কভিড-১৯ সৃষ্ট দুর্যোগের সময় সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা প্যাকেজ ও পুনঃঅর্থায়ন তহবিল ঘোষণা করা হয়। প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট হারে সুদ ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে।

দেশের অন্তত এক ডজন ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বণিক বার্তাকে বলেছেন, সরকার ঘোষিত প্রণোদনা ও ভর্তুকির অর্থ অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বকেয়া ভর্তুকির মেয়াদ দুই বছরে গিয়ে ঠেকেছে। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলোর তারল্য ব্যবস্থাপনাও চাপের মুখে পড়েছে।

শুধু সার আমদানির ভর্তুকি বাবদ সরকারের কাছে ১ হাজার ৯১২ কোটি টাকা পাবে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি। এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও ব্যাংকটি সরকারের কাছ থেকে এ অর্থ আদায় করতে পারছে না। আবার রেমিট্যান্সের নগদ প্রণোদনা বাবদ ব্যাংকটির পাওনা অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৬০ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি বাবদ ১৯৪ কোটি টাকা, প্রণোদনা খাতের ভর্তুকি বাবদ ৫১ কোটি টাকা, কৃষি ঋণের পুণঃঅর্থায়ন স্কিমের বিপরীতে ৩২ কোটি টাকা পাবে ব্যাংকটি। এ কয়েকটি খাতেই সরকারের কাছে দেশের সর্ববৃহৎ এ ব্যাংকের বকেয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌দেশের বৃহৎ ব্যাংক হিসেবে ইসলামী ব্যাংকের দায়দায়িত্ব অনেক বেশি। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ রেমিট্যান্স আমাদের ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে আসে। রফতানির দিক থেকেও ইসলামী ব্যাংকের অবস্থান সবার শীর্ষে। এ কারণে সরকারের কাছে রেমিট্যান্স ও রফতানি খাতের প্রণোদনা বাবদ আমাদের পাওনা অর্থের পরিমাণ অনেক বেশি। সার আমদানি বাবদ প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি আমরা অনেক দিন থেকেই পাচ্ছি না। অন্যান্য প্রণোদনা প্যাকেজের প্রণোদনা ও ভর্তুকির অর্থও আটকে আছে। সরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমাদের প্রাপ্য অর্থ পরিশোধ করে দিলে দেশের ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট অনেকাংশেই কেটে যেত।’

রেমিট্যান্সের প্রণোদনা বাবদ সরকারের কাছে প্রায় ২৮ কোটি টাকা পাবে শাহ্‌জালাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি। বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজের ভর্তুকি বাবদ আরো প্রায় ২৫ কোটি টাকা পাবে ব্যাংকটি। কৃষিসহ বিভিন্ন পুনঃঅর্থায়ন স্কিমের জন্য ব্যাংকটির আরো ৮ কোটি টাকার বকেয়া জমেছে। সব মিলিয়ে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে শাহ্‌জালাল ইসলামী ব্যাংকের পাওনার পরিমাণ প্রায় ৬১ কোটি টাকা।

শাহ্‌জালাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসলেহ্ উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘‌দেশের ব্যাংক খাত এখন তারল্য সংকটের মধ্যে রয়েছে। সরকার ব্যাংকগুলোর পাওনা পরিশোধ করে দিলে উপকৃত হতাম।’

দেশের বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো (আইপিপি) থেকে কেনা বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করতে পারছে না বিপিডিবি। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত আট মাসের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া পড়েছে। বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ এ বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। বিল না পাওয়ায় এরই মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থ সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে। শীর্ষস্থানীয় বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোও এখন কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে। আবার বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিনিয়োগ করা ব্যাংকগুলোর ঋণের কিস্তিও মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এতে দেশের অনেক বিদ্যুৎ কোম্পানিই খেলাপির ঝুঁকিতে রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।

বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্যোক্তারা বলছেন, বিদ্যুতের বকেয়া পাওনাসংক্রান্ত জটিলতা প্রায় দুই বছর ধরে চলছে। বিভিন্ন সময়ে বকেয়া পরিশোধে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হলেও তাতে খুব বেশি গতি আসেনি। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে বকেয়া পরিশোধ ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অবস্থা তুলে ধরলেও তার কোনো সমাধান পাওয়া যাচ্ছে না। গত এপ্রিল থেকে এ বকেয়া পাওনা পরিশোধ হয়নি। প্রতি মাসে যে পরিমাণ বিল বিপিডিবিতে জমা পড়ছে তার ২৫-৩০ শতাংশ পাওয়া যাচ্ছে।

বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র মালিকদের সংগঠন বিআইপিপিএর সভাপতি ফয়সাল খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আইপিপিগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। এ পরিস্থিতি আরো দীর্ঘায়িত হলে এবং বিপিডিবির বিদ্যুৎ চাহিদা বাড়লে তার প্রভাব (লোডশেডিং) পড়বে। দেরিতে বিল পরিশোধ এবং টাকার অবমূল্যায়নজনিত ক্ষতি সামাল দেয়ার মতো সক্ষমতা আইপিপিগুলো হারিয়ে ফেলেছে।’

দেশের বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোয় সবচেয়ে বেশি অর্থ বিনিয়োগ করা ব্যাংকগুলোর শীর্ষে রয়েছে ঢাকা ব্যাংক পিএলসি। ব্যাংকটির বিনিয়োগ করা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো সরকারের কাছে ২ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকার বিদ্যুৎ বিল পাবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমরানুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশের বেসরকারি খাতের সব বড় বিদ্যুৎ কোম্পানিতে ঢাকা ব্যাংকের বিনিয়োগ আছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রজেক্ট ফাইন্যান্সের পাশাপাশি জ্বালানি তেল আমদানিতেও ঢাকা ব্যাংকের অবস্থান শীর্ষস্থানীয়। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে আমাদের অর্থায়ন করা বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর বিল বকেয়া পড়েছে। এতে উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি অর্থায়নকারী ব্যাংক হিসেবে আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। আশা করছি, সরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিদ্যুৎ বিলের পাশাপাশি রেমিট্যান্স, রফতানিসহ বিভিন্ন খাতের বকেয়া প্রণোদনা ও ভর্তুকি পরিশোধ করে দেবে।’

বিভিন্ন খাতের প্রণোদনা ও ভর্তুকি বাবদ সরকারের কাছে ১৯৬ কোটি টাকা পাবে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি। এর মধ্যে এক বছর আগের সার ভর্তুকির বকেয়া রয়েছে ৪২ কোটি টাকা। রেমিট্যান্সের বিপরীতে প্রণোদনা বাবদ সরকারের কাছে ৯৪ কোটি টাকা পাবে ব্যাংকটি। রফতানির বিপরীতে নগদ সহায়তা হিসেবে প্রাপ্য অর্থের পরিমাণ ৫২ কোটি টাকা। কৃষিসহ বিভিন্ন খাতের প্রণোদনা ও পুনঃঅর্থায়ন খাতের বকেয়াও পায়নি ইসলামী ধারার এ ব্যাংক। সরকারের কাছে বিভিন্ন খাতের প্রায় ৩৪ কোটি টাকা পাবে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। প্রায় ৭০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসির।

এদিকে নগদ সহায়তা বাবদ ৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়ের আহ্বান জানিয়েছে নিটওয়্যার শিল্পের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন বিকেএমইএ। গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংক বরাবর এ-সংক্রান্ত চিঠি দেয়া হয়।

সংগঠনটির নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম স্বাক্ষরিত চিঠিতে বিকেএমইএ বলেছে, দ্রুততম সময়ের মধ্যে নগদ সহায়তা বাবদ বকেয়া ৪ হাজার কোটি টাকা দেয়া না হলে বস্ত্র খাতে মারাত্মক বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। চিঠিতে বস্ত্র খাতসহ অন্যান্য খাতের রফতানি ভর্তুকি বা নগদ সহায়তা বাবদ প্রাপ্য বকেয়া ৪ হাজার কোটি টাকা জরুরি ভিত্তিতে চলতি ডিসেম্বরের মধ্যে ছাড়করণের ‘সবিনয়ে অনুরোধ’ জানানো হয়।

চিঠিতে বিকেএমইএ জানিয়েছে, গত অর্থবছরের (২০২২-২৩) জুন পর্যন্ত রফতানি ভর্তুকি বা নগদ সহায়তার ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা এখন পর্যন্ত ছাড় করা হয়নি, যা বকেয়া রয়েছে। এছাড়া চলতি অর্থবছরের প্রথম কিস্তিতে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা গত ২২ আগস্ট ছাড় করা হলেও বর্তমানে সর্বমোট ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি নগদ সহায়তা বাবদ বাংলাদেশ ব্যাংকে বকেয়া দাবি রয়েছে, যা এ খাতকে চরম আর্থিক সংকটে ফেলে দিয়েছে। তাছাড়া চলতি ডিসেম্বরে ব্যাংক ক্লোজিং হওয়ায় ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে উদ্যোক্তাদের ওপর ঋণের কিস্তি পরিশোধের ব্যাপক চাপ রয়েছে।

গতকাল বিকালেই রফতানি সহায়তা বাবদ বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে ১ হাজার কোটি টাকা ছাড় করার আদেশ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ বিভাগের উপসচিব মো. হেলাল উদ্দীন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে অর্থ ছাড়ের বিষয়টি জানানো হয়েছে।

প্রসঙ্গত, লক্ষ্য অনুয়ায়ী রাজস্ব আদায় না হওয়ায় সরকারের অর্থ সংকট বাড়ছে। ব্যয় সংকোচনের মাধ্যমে এ সংকট উত্তরণের চেষ্টা করছে সরকার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর পর্যন্ত অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রাজস্ব আহরণে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি। ঘাটতি সংস্থানে সরকার দেশী-বিদেশী উৎস থেকে উচ্চ সুদেও ঋণ নিচ্ছে। এরই মধ্যে ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার উঠে গেছে ১১ শতাংশে।

এ বিষয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেও অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কারো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ বিষয়ে কথা বলার দায়দায়িত্ব কেবল অর্থ মন্ত্রণালয়ের। নিশ্চয় ঘাটতি বাজেট পূরণ ও অর্থ ছাড়ের বিষয়ে তাদের কোনো বিশেষ পরিকল্পনা রয়েছে।’

বনিক বার্তা