সরকারির দ্বিগুণ উৎপাদন ব্যয় বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে!

ঘাটতি মোকাবিলায় ২০০৯ সালের শুরু থেকেই বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে জোর দেয় সরকার। রেন্টাল-কুইক রেন্টালের পর আসে বড় আকারের বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র। এতে সরকারির তুলনায় বেসরকারি খাতে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেশি। তবে বেসরকারি খাতের বেশিরভাগ কেন্দ্র অদক্ষ। তারপরও বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ দেখা হয় এসব কেন্দ্রের জন্য। এতে সরকারি কেন্দ্রের তুলনায় দ্বিগুণ ব্যয়ে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে।

২০২২-২৩ অর্থবছরের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে। এতে দেখা যায়, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও অন্যান্য সরকারি কোম্পানির কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় পড়ছে কাছাকাছি। তবে বেসরকারি খাতে এর দ্বিগুণ ব্যয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে।

পিডিবির তথ্যমতে, গত অর্থবছর সংস্থাটির কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে এক হাজার ৭৪৩ কোটি ২৫ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে জ্বালানি ব্যয় পড়ে সাত হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা এবং পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ (ওঅ্যান্ডএম) ব্যয় ৩৫৮ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এছাড়া বেতন-ভাতাসহ স্থায়ী ব্যয় ছিল পাঁচ হাজার ১৭২ কোটি ২৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ মোট ব্যয় পড়ে ১৩ হাজার ৩০৬ কোটি ৬২ লাখ টাকা। এতে পিডিবির কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় পড়ে সাত টাকা ৬৩ পয়সা।

এদিকে পিডিবি ছাড়া অন্যান্য সরকারি কোম্পানির কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে এক হাজার ৫৭৪ কোটি ২৩ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে জ্বালানি ব্যয় পড়ে পাঁচ হাজার ৬৬৭ কোটি ৪৭ লাখ টাকা এবং ওঅ্যান্ডএম ব্যয় ৩৩৭ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। আর বেতন-ভাতাসহ স্থায়ী ব্যয় ছিল চার হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট ব্যয় পড়ে ১০ হাজার ৭৮৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এতে অন্য সরকারি কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় পড়েছে ছয় টাকা ৮৫ পয়সা।

অন্যদিকে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর কেন্দ্রগুলোয় গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে চার হাজার ৩৩৪ কোটি ৯৪ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে জ্বালানি ব্যয় পড়ে ৪৩ হাজার ৭০ কোটি ১১ লাখ টাকা এবং ওঅ্যান্ডএম ব্যয় দুই হাজার ৫৪০ কোটি ৬২ লাখ টাকা। আর স্থায়ী ব্যয় তথা ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ১৭ হাজার ১৫৫ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ মোট ব্যয় পড়ে ৬২ হাজার ৭৬৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এতে বেসরকারি কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড়ে ব্যয় পড়েছে ১৪ টাকা ৪৮ পয়সা।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতিটি খাতেই উচ্চ ব্যয় হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল জ্বালানি ব্যয়। গত অর্থবছর পিডিবির গড় জ্বালানি ব্যয় ছিল চার টাকা ৪৬ পয়সা এবং অন্য সরকারি কেন্দ্রে তিন টাকা ৬০ পয়সা। তবে বেসরকারি খাতের কেন্দ্রগুলোর গড় জ্বালানি ব্যয় ছিল ৯ টাকা ৯৪ পয়সা। যদিও ওঅ্যান্ডএমে গড় ব্যয় পিডিবির ২১ পয়সা ও অন্য সরকারি কেন্দ্রে ৫০ পয়সা। আর বেসরকারি খাতে এ ব্যয় গড়ে ৫৯ পয়সা। একইভাবে পিডিবির গড় স্থায়ী ব্যয় মাত্র দুই টাকা ৯৭ পয়সা এবং অন্য বেসরকারি কেন্দ্রে গড়ে তিন টাকা চার পয়সা। তবে বেসরকারি খাতে গড় স্থায়ী ব্যয় তথা ক্যাপাসিটি চার্জ তিন টাকা ৯৬ পয়সা।

এ প্রসঙ্গে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম শেয়ার বিজকে বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে স্বল্প চাহিদা মেটাতে পিডিবিকে কিছু ছোট ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে হয়। ডিজেলচালিত ওই কেন্দ্রগুলোর ব্যয় অনেক বেশি। তারপরও পিডিবির বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সার্বিক জ্বালানি ব্যয় কম, কারণ এগুলোর দক্ষতা তুলনামূলক বেশি। তবে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রে বেশিরভাগই নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়েছে। এগুলোয় জ্বালানি ব্যবহার করতে হয় বেশি।

তিনি আরও বলেন, নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে এগুলোর পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও বেশি। অল্প কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি ভালো মানের। সেগুলোয় গড় ব্যয় পিডিবির চেয়েও কম পড়ে। তবে বেশিরভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্রের অবস্থাই খারাপ। তার ওপর রয়েছে উচ্চ ক্যাপাসিটি চার্জ। এ কারণেও বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেশি পড়ছে।

তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছর পিডিবির কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে এক হাজার ৫৯৬ কোটি ৪১ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে জ্বালানি ব্যয় পড়ে তিন হাজার ৪৮৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকা এবং ওঅ্যান্ডএম ব্যয় ৩০৫ কোটি ১৮ লাখ টাকা। এছাড়া বেতন-ভাতাসহ স্থায়ী ব্যয় ছিল চার হাজার ২১৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা। অর্থাৎ মোট ব্যয় পড়ে আট হাজার ১৪ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। এতে পিডিবির কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় ছিল পাঁচ টাকা দুই পয়সা।

ওই অর্থবছর পিডিবি ছাড়া অন্যান্য সরকারি কোম্পানির কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছিল এক হাজার ৪৭৮ কোটি পাঁচ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে জ্বালানি ব্যয় পড়ে দুই হাজার ৭০৬ কোটি ২০ লাখ টাকা এবং ওঅ্যান্ডএম ব্যয় ২৬৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। আর বেতন-ভাতাসহ স্থায়ী ব্যয় ছিল প্রায় চার হাজার ৪৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট ব্যয় পড়ে সাত হাজার ১৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এতে অন্য সরকারি কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় ছিল চার টাকা ৭৫ পয়সা।

অন্যদিকে বেসরকারি খাতে কোম্পানির কেন্দ্রগুলোয় ২০২১-২২ অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় চার হাজার ৫৪৭ কোটি ৬৭ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে জ্বালানি ব্যয় পড়েছিল ৩৬ হাজার ৭৫২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা এবং ওঅ্যান্ডএম ব্যয় এক হাজার ৫৪৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। আর স্থায়ী ব্যয় তথা ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ১৩ হাজার ৭০০ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ মোট ব্যয় পড়ে ৫২ হাজার দুই কোটি ৭৪ লাখ টাকা। এতে বেসরকারি কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড়ে ব্যয় পড়েছে ১১ টাকা ৪৪ পয়সা।

এ হিসাবে গত অর্থবছর পিডিবির উৎপাদন বেড়েছে ৯ দশমিক ২০ শতাংশ ও গড় ব্যয় বেড়েছে ৫২ শতাংশ। আর অন্যান্য সরকারি কেন্দ্রের উৎপাদন বেড়েছে সাড়ে ছয় শতাংশ। তবে গড় ব্যয় বেড়েছে ৪৪ শতাংশ। এর মূল কারণ জ্বালানি ব্যয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। গত অর্থবছর পিডিবির জ্বালানি ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১২৩ শতাংশ ও অন্য সরকারি কেন্দ্রে বেড়েছে ১১০ শতাংশ। তবে বেসরকারি খাতে উৎপাদন কমলেও জ্বালানি ব্যয় বেড়েছে ১৭ শতাংশ। যদিও এ সময় বেসরকারি খাতে উৎপাদন কমেছে সাড়ে চার শতাংশের বেশি। এরপরও বেসরকারি খাতে গড় ব্যয় বেড়েছে ২৭ শতাংশ।

শেয়ারবিজ