বিদেশী উৎস থেকে প্রত্যাশা অনুযায়ী ঋণ না পেয়ে দেশের ব্যাংক খাতনির্ভরতা বাড়িয়েছে সরকার। এক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদির চেয়ে স্বল্পমেয়াদি ঋণ বাড়ছে বেশি হারে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, সদ্য বিদায়ী অর্থবছর শেষে সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩৫ হাজার ৩৫ কোটি টাকা। এ ঋণের ১৮ দশমিক ২ শতাংশই পরিশোধ করতে হবে মাত্র এক বছরের মধ্যে। অর্থাৎ ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে সরকারের এমন ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, জুনে এসে বিদেশী উৎস থেকে সরকারের নেয়া ঋণের স্থিতি ৭ লাখ ৯৯ হাজার ৫০৫ কোটি টাকায় ঠেকেছে। আর ব্যাংক খাতসহ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেয়া ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৩৫ হাজার ৫২৯ কোটি টাকা। ডলারের হিসাবে দেশী-বিদেশী উৎস থেকে নেয়া ঋণ এখন ১৫ হাজার ৬৮৪ কোটি বা ১৫৬ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার। জিডিপির অনুপাতে সরকারের নেয়া ঋণ ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ঋণের বিপরীতে সরকারকে এখন জিডিপির ২ দশমিক ২ শতাংশের সমান সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে।
প্রতি তিন বছর পরপর সরকারের ‘মধ্যমেয়াদি ঋণ ব্যবস্থাপনা কৌশল’ প্রণয়ন করে অর্থ মন্ত্রণালয়। আগামী তিন অর্থবছরের ঋণ ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত কৌশলপত্রটি প্রকাশ করা হয়েছে ৩০ জুন। তাতে সরকারের ঋণ স্থিতি, ব্যয় ও ঝুঁকিসংক্রান্ত কৌশল কী হবে তার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। কৌশলপত্রে বলা হয়, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেয়া ঋণের মেয়াদপূর্তির সময় কম। এক বছরে ৩০ দশমিক ৭ শতাংশ ঋণের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার কারণে এক্ষেত্রে উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। ঋণ পরিশোধের চাপ কমাতে অভ্যন্তরীণ ঋণের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার সময় বাড়ানো প্রয়োজন।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রতি বছরই সরকার বিরাট অংকের ঘাটতি রেখে বাজেট ঘোষণা করছে। তাতে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে, সেটিও পূর্ণ হচ্ছে না। এ কারণে অর্থবছর শেষে ঘাটতি বাজেটের আকার আরো বড় হচ্ছে, যা পূরণ করা হচ্ছে দেশী-বিদেশী উৎস থেকে ঋণ নিয়ে। এতে সরকারের ঋণের স্থিতি দ্রুতগতিতে বাড়ছে। সরকার নিজেই ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধের মতো দুষ্টচক্রে আটকে গেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের জুন শেষে সরকারের মোট ঋণ স্থিতি ছিল ১১ লাখ ৪৪ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭ লাখ ২৩ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা নেয়া হয়েছিল অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। বাকি ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকার ঋণ ছিল বিদেশী উৎসের। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে ২০২৩ সালের জুনে এসে সরকারের মোট ঋণ স্থিতি ১৬ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। চলতি বছরের জুন শেষে তা দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩৫ হাজার ৩৫ কোটি টাকায়। তবে এক্ষেত্রে মার্চ পর্যন্ত ঋণের প্রকৃত তথ্য নেয়া হলেও পরবর্তী তিন মাসে ঋণের তথ্য প্রাক্কলন করা হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অর্থনীতিতে “রোলওভার” বলে একটি কথা আছে। সরকারের পক্ষে দেশের ব্যাংক খাত থেকে নেয়া ঋণ রোলওভার করা সহজ। ট্রেজারি বিল-বন্ডের অকশন ডেকে মেয়াদ বাড়িয়ে নিলেই হলো। এক্ষেত্রে কেবল ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।’
তিনি আরো বলেন, ‘রাজস্ব আয় দিয়ে এত পরিমাণ ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা সরকারের নেই। এজন্য ঋণের মেয়াদ নবায়ন করা হবে। সরকার আগে বিল-বন্ডের বিপরীতে ৬ শতাংশ সুদ দিলে সেটি এখন ১২ শতাংশ দিতে হবে। কিন্তু বিদেশী ঋণের ক্ষেত্রে রোলওভার করা অনেক কঠিন। এক্ষেত্রে সরকারকে যথাসময়ে বিদেশী ঋণ পরিশোধ করতে হবে।’
অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, সরকারকে আগামী এক বছরের মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেয়া ঋণের ৩০ দশমিক ৭ শতাংশ পরিশোধ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে পরিশোধ করতে হবে এমন ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ লাখ ১৭ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি বাজেট ঘোষণা করেছে সরকার। এ ঘাটতি পূরণে ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকার ঋণ নেয়া হবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। এক্ষেত্রে দেশের ব্যাংক খাত থেকে নেয়া হবে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ঋণ। সে ক্ষেত্রে পরিশোধ করতে হবে এমন ঋণ ও নতুন মিলিয়ে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের নেয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে প্রায় ৪ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যমেয়াদি ঋণ ব্যবস্থাপনা কৌশলপত্রে বলা হয়, সরকারের বেশির ভাগ ঋণ স্থানীয় মুদ্রায় থাকার পাশাপাশি বিদেশী ঋণ পরিশোধের সময়সীমা দীর্ঘ হওয়ায় বিদ্যমান ঋণ পোর্টফোলিওর ঝুঁকি মাঝারি মাত্রার। সুদের হার বেশি হওয়ায় বিদেশী ঋণের তুলনায় স্থানীয় ঋণ বেশি ব্যয়বহুল। তবে বিদেশী ঋণের প্রতি উচ্চ নির্ভরতার কারণে বিনিময় হারজনিত ঝুঁকি সময়ের সঙ্গে বেড়ে গেছে। এক বছরে ৩০ দশমিক ৭ শতাংশ ঋণের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ায় এক্ষেত্রে পরিশোধের উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। ঋণ পরিশোধের চাপ কমাতে অভ্যন্তরীণ ঋণের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার সময় বাড়ানো প্রয়োজন।
সরকারের নেয়া উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ঋণের সুদহার নির্ধারিত। তবে স্থানীয় উৎসের ক্ষেত্রে ঋণ নবায়নের সময় সুদহার নতুন করে নির্ধারণের গড় সময়সীমা ৩ দশমিক ৮ বছর, যেখানে বিদেশী ঋণের ক্ষেত্রে এ সময় ৮ দশমিক ৮ বছর। ফলে স্থানীয় ঋণের ক্ষেত্রে সুদহার পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি। এক্ষেত্রে নির্ধারিত সুদহারের দীর্ঘমেয়াদি অভ্যন্তরীণ ঋণের অনুপাত বাড়ানো প্রয়োজন বলে কৌশলপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
ঋণ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সামষ্টিক অর্থনীতির মূল ঝুঁকির বিষয়টিও উঠে এসেছে অর্থ বিভাগের এ কৌশলপত্রে। এক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতিজনিত ঝুঁকিকে উচ্চমাত্রার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি বজায় থাকলে কঠোর মুদ্রানীতি অবলম্বন করতে হবে, যার ফলে সুদহার ঊর্ধ্বমুখী থাকবে। এতে সরকারি সিকিউরিটিজের ইল্ড ঊর্ধ্বমুখী থাকবে এবং সুদ বাবদ সরকারের ব্যয় বেড়ে যাবে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয় সুদের হার ঊর্ধ্বমুখী থাকলে স্থানীয় মুদ্রা টাকার আরো অবমূল্যায়ন হতে পারে। সে ক্ষেত্রে স্থানীয় মুদ্রার হিসাবে বিদেশী ঋণ পরিশোধের ব্যয় বেড়ে যেতে পারে এবং এটিকেও মাঝারি মাত্রার ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। খেলাপি ঋণের উচ্চ হার ও ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট আর্থিক খাতে চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। এর ফলে স্থানীয় উৎস থেকে সরকারের ঋণ নেয়া চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠতে পারে। এটিকেও মাঝারি মাত্রার ঝুঁকি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। রাজস্ব ঘাটতি কিংবা প্রক্ষেপণের তুলনায় ব্যয় বেড়ে গেলে সেটিও সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনাকে মাঝারি মাত্রার ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। কারণ এক্ষেত্রে ঘাটতি মেটাতে সরকারের অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হবে। ঊর্ধ্বমুখী বেঞ্চমার্ক সুদের হারের প্রভাবে বিদেশী ঋণের সুদও ঊর্ধ্বমুখী থাকবে এবং সেটি সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনা কৌশলকে মাঝারি মাত্রার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এতে বিদেশী ঋণের সুদ বাবদ সরকারের ব্যয় প্রক্ষেপণের চেয়েও বেশি হতে পারে এ কৌশলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ঋণ ব্যবস্থাপনায় চার ধরনের কৌশল পর্যালোচনা করে কোনটি সরকারের জন্য সবচেয়ে বেশি সুবিধাজনক হবে সে বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। সদ্যসমাপ্ত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদেশী ও সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ঋণ নেয়ার পরিমাণ কমিয়ে স্থানীয় উৎসের মাধ্যমে অর্থায়ন চাহিদা পূরণের কৌশল অবলম্বন করা হয়। সরকার চাইলে এ কৌশল বর্তমানেও অনুসরণ করতে পারে। তবে ঋণের ব্যয়, ঝুঁকি ও অভিঘাত বিশ্লেষণ করে তৃতীয় কৌশল অবলম্বন করাটা সরকারের জন্য মধ্যমেয়াদে সবচেয়ে বেশি সুবিধাজনক হবে বলে মনে করছে অর্থ বিভাগ। এ কৌশল অনুসারে, ধারাবাহিকভাবে ট্রেজারি বিলের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বিভিন্ন ধরনের ট্রেজারি বন্ড ইস্যুর কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় উৎস থেকে বিদেশী ঋণ নেয়ার কথা বলা হয়েছে। কৌশলটি অনুসরণ করা হলে সরকারি সিকিউরিটিজ মার্কেটের উন্নয়ন হবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। এজন্য অর্থ বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) অভ্যন্তরীণ ঋণের বাজার উন্নয়নে পদক্ষেপ নেবে।
সাবেক অর্থ সচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী মনে করেন, রাজস্ব ঘাটতি থাকায় সরকারের ঋণ স্থিতি ক্রমেই বাড়তে থাকবে। কোনো সরকারই ঋণের স্থিতি আর কমাতে পারবে না। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘সরকার প্রতি বছর ঘাটতি বাজেট দিচ্ছে। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যও পূরণ হচ্ছে না। এ কারণে দেশী-বিদেশী উৎস থেকে সরকারের ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। এটা অবশ্য উদ্বেগের নয়, দেখতে হবে সেটি জিডিপির অনুপাতের সঙ্গে সামঞ্জস্য কিনা। জিডিপির অনুপাতে সরকারের ঋণ ৪০ শতাংশের মধ্যে থাকলে সেটি টেকসই মনে করা হয়।’
মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো দেশের ক্ষেত্রে এটি শুধু জিডিপির অনুপাতের সঙ্গে তুলনা করলে হবে না। কারণ আমাদের জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আয় খুবই কম। বিদেশী ঋণের ক্ষেত্রে আমাদের “ডেট টু এক্সপোর্ট রেশিও” আমলে নিতে হবে। সরকারের ঋণ যে হারে বাড়ছে, তাতে বেসরকারি খাত ঋণবঞ্চিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় সরকারের সুদ ব্যয়ও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে সরকারকে মিতব্যয়ী হতে হবে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ও প্রকল্প থেকে বিরত থাকতে হবে।’
bonik barta