সমন্বয়হীনতায় অস্থির ডলার বাজার

দেশে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে চলছে ডলার সংকট। তা সামাল ব্যর্থ হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য একটা সময় ডলার বিনিময় হার নির্ধারণের দায়িত্ব দেয়া হয় দুই সংগঠন বাফেদা ও এবিবিকে। গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে এই দুই সংগঠন ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব পালন করছে। তবে সংকট না কেটে ক্রমেই তা ঘনীভূত হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক, এক্সচেঞ্জ হাউস, বাফেদা ও এবিবির সঙ্গে সমন্বয় রেখে চলতে পারছে না। ফলে ডলার বাজার নিয়ে আরও জটিলতা বাড়ছে। এতে বারবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করে পরিবর্তন করা হচ্ছে ডলারের দাম। বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়েও তা বাতিল বা স্থগিত করা হচ্ছে।
ডলারের দাম নির্ধারণ নিয়ে এক ধরনের সমন্বয়হীনতা চলছে। রেমিট্যান্সে প্রণোদনা বৃদ্ধি, পরে তা বাতিল, ব্যাংকগুলোকে ইচ্ছামতো প্রণোদনা দেয়ার স্বাধীনতা, আবার সে স্বাধীনতায় লাগাম টানাÑএসব নিয়ে বিশৃঙ্খল একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এতে ব্যাংক রেটের সঙ্গে খোলা বাজারে ডলারের রেটে ১৫-১৬ টাকার ব্যবধান তৈরি হয়ে গেছে। এভাবেই সমন্বয়হীনতায় চলছে বর্তমানে ডলার বাজার। তবে এভাবে চলতে থাকলে সংকট আরও বাড়বে বলে মত দিয়েছেন ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা ও বিশেষজ্ঞরা।
জানা যায়, গত ২২ অক্টোবর এবিবি ও বাফেদার অনুষ্ঠিত সভায় সিদ্ধান্ত হয় ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ১১০ টাকা ৫০ পয়সায় রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের ডলার কিনবে। তবে সরকারের ঘোষিত আড়াই শতাংশের সঙ্গে আরও আড়াই শতাংশ বাড়তি প্রণোদনা দিতে পারবে ব্যাংকগুলো।
২৩ অক্টোবর থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ায় আট দিনের মাথায় তা পরিবর্তন করা হয়। ৩১ অক্টোবর আবার এবিবি-বাফেদার মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্স আয়ে ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রণোদনা দেয়ার সীমা তুলে নিয়ে ইচ্ছামতো প্রণোদনা দিয়ে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করতে পারবে। তবে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে গিয়ে তৈরি হয়েছে বিশৃঙ্খলা।
ইচ্ছামতো প্রণোদনা দিয়ে কিছু ব্যাংক ১২২-১২৪ টাকা দামে প্রবাসী আয় কিনছে। যেসব ব্যাংকের আমদানি দায় মেটানোর চাপ আছে, তারা এই দামে ডলার কিনে দায় মেটাচ্ছে। এতে ডলারের দাম এক ধাক্কায় ১২-১৩ টাকা বেড়ে যায়। আবার কিছু ব্যাংক বাড়তি কোনো প্রণোদনাই দেয়নি রেমিট্যান্সে।
বাড়তি দামে ব্যাংকগুলোর ডলার কেনার খবর গণমাধ্যামে প্রকাশ হওয়ার পর গত বুধবার জরুরি সভা ডাকে বাফেদা ও এবিবি। সেখানে ৩১ অক্টোবরের সিদ্ধান্ত যথাযথভাবে পালন করার তাগিদ দেয়া হয়। আর প্রবাসী আয়ে ব্যাংকের নিজস্ব ও সরকারের প্রণোদনাসহ ডলারের দর কোনোভাবেই ১১৬ টাকার বেশি দেয়া যাবে না বলে সিদ্ধান্ত হয়।
এরপর গতকাল বৃহস্পতিবার এই দুই সংগঠনের ২১ প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সভায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ এবিবির চেয়ারম্যান এবং ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসাইন সাংবাদিকদের বলেন, নতুন করে ডলার বাজারে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। মূলত কিছু ব্যাংক বেশি দরে রেমিট্যান্স কেনার কারণে এ অস্থিরতা তৈরি হয়। তাই এ সমস্যা সমাধানে আমাদের সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে। আর ডলারের যে দর দেয়া হয়, তা সবাইকে মেনে চলার নির্দেশ দেন গভর্নর।
বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কারণ জানতে চাইলে এবিবির চেয়ারম্যান বলেন, পরিস্থিতি অত্যন্ত কঠিন। ডলার বাজারে স্থিতিশীলতা আনার জন্য সবাই মিলে কাজ করতে হচ্ছে। এটাই নিয়ম। তিনি বলেন, দর না মানার কারণ হতে পারে নিশ্চয়ই কোনো ব্যাংকের বড় কোনো ঝামেলা আছে। সেগুলো বুঝেশুনে সমাধান করতে হয়। সব সিদ্ধান্ত সব ব্যাংক মেনে চলতে পারে, তেমন নয়।
আমদানিকারকেরা নির্ধারিত দামের ডলার পাচ্ছে নাÑএমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, যদি কোনো আমদানিকারকের এরকম অভিযোগ থাকে, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে এসে জানাতে হবে। তাছাড়া সকল বিষয়ে লাইন বাই লাইন লিখিতভাবে নির্দেশনা দেয়া যায় না বলেও মনে করেন এই ব্যাংকার।
বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এবং মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, এবিবি ও বাফেদার গৃহীত সিদ্ধান্ত অনেকে মানছে না। তাই ডলার বাজারে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। এখন থেকে দুই সংগঠনের নির্ধারিত রেট যাতে সবাই বাস্তবায়ন করে, সেজন্য সাহায্য চাইতে এসেছিলেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে বলা হয়।
তিনি বলেন, নির্দেশনার বাইরে কোনো ব্যাংক অথবা এক্সচেঞ্জ হাউস ডলার কেনাবেচা করলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিষয়টি আগের চেয়ে শক্তভাবে তদারকি করা হবে এখন। তাই প্রয়োজন হলে সর্বোচ্চ আড়াই শতাংশ অতিরিক্ত প্রণোদনা দিয়ে ডলার সংগ্রহ করা যাবে, কিন্তু এর বেশি নয়। যদি কেউ বেশি দামে ডলার কিনেও থাকে তাহলে ১১১ টাকাতেই বিক্রি করতে হবে। অন্যথায় আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যাংকাররা জানান, ডলারের দাম বাজারভিত্তিক না করে নির্ধারণ করে দেয়া হচ্ছে। তবে ডলারের ঘোষিত দরের সঙ্গে বাজার পরিস্থিতির কোনো সামঞ্জস্য নেই। তাই নির্ধারিত দরে কোনো ব্যাংক ডলার পাচ্ছে না। এ কারণে আগের দেনা শোধ ও আমদানি ঋণপত্র (এলসি) পরিশোধের জন্য অনেক বেশি দামে রেমিট্যান্স কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। বিদেশি মানি এক্সচেঞ্জগুলো ডলারের যে দর প্রস্তাব করছে, সেটি ঘোষিত দরের চেয়ে ১২-১৪ টাকা বেশি। ব্যাংকগুলো যদি ওই দামে ডলার না কেনে, তাহলে রেমিট্যান্সের বড় অংশ হুন্ডিতে চলে যাবে। আর ধস নামবে ব্যাংক ব্যবসায়। তাই এ পথ বেছে নিয়েছে অনেক ব্যাংক। নির্ধারিত রেট থেকে সরে না এলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
এদিকে রেমিট্যান্সে প্রণোদনা নিয়েও চলছে বিশৃঙ্খলা। সম্প্রতি ব্র্যাক ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স আনা এক গ্রাহক শেয়ার বিজকে জানান, তিনি সরকার-নির্ধারিত আড়াই শতাংশ প্রণোদনা পেয়েছেন। বাড়তি কোনো প্রণোদনা দেয়নি ব্যাংকটি। এতে তাকে প্রতি ডলারের বিনিময় হার দেয়া হয়েছে ১১৩ টাকা ২৬২৫ পয়সা।
একই দিনে সিটি ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স আনা অপর এক গ্রাহক শেয়ার বিজকে জানান, তিনি প্রতি ডলারের সরকার-নির্ধারিত প্রণোদনার চেয়েও ১২ টাকা ২৯ পয়সা বাড়তি প্রণোদনা পেয়েছেন। তাকে প্রতি ডলারের বিনিময় হার দেয়া হয়েছে ১২৫ টাকা ৫৫২৩ পয়সা।
অন্যদিকে ব্যাংকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খোলাবাজারের ডলারের দরও। গতকাল বৃহস্পতিবার এক দিনের ব্যবধানে ডলারের দর আড়াই টাকা বেড়ে হয়েছে ১২৬ দশমিক ৫০ টাকা, যা এ যাবৎকালে সর্বোচ্চ, যদিও নির্ধারিত দাম অনুযায়ী খুচরা ডলারের দাম ১১৩ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। গত বুধবারও ডলারের দর ছিল ১২৩ থেকে ১২৪ টাকা। এর আগে গত বছরের আগস্টে সর্বোচ্চ ১২০ টাকা উঠেছিল।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংকগুলো বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে ১২২ টাকার বেশি দরে ডলার কেনার বিষয়টি জানাজানির পর খোলাবাজারেও নগদ ডলারের দর দ্রুত বাড়ছে। গত সপ্তাহেও প্রতি ডলার ১১৮ থেকে ১২০ টাকার মধ্যে ছিল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেশিরভাগ মানি চেঞ্জারের কাছে ডলার নেই। যাদের কাছে আছে তারাও সরাসরি ডলার বিক্রি করছেন না, পরিচিত কারও মাধ্যমে ডলার বিক্রি করছেন।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, এবিবি ও বাফেদা যে পদ্ধতিতে ডলারের দর নির্ধারণ করে দেয়, সেটার কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। আসলে রেট নির্ধারণ করে দেয়াটাই ঠিক হচ্ছে না। এটা থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বের হয়ে আসা উচিত। বাজারে প্রতিযোগিতা তৈরি ও স্বচ্ছতা বাড়াতে আগের মতো বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার ব্যবস্থাপনায় ফেরত যেতে হবে।
তিনি বলেন, একটা ভীতি আছে যে, বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে বাজার কোথায় গিয়ে উঠবে! তবে নিয়ন্ত্রণ রেখে বাজারের অস্থিরতা কমানো গেছে, এমনটিও নয়। বলা হচ্ছে, বেশি দামে ডলার কিনতে পারবেন, কিন্তু বিক্রি করতে পারবেন না। এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাজার সুষ্ঠুভাবে কাজ করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এর মাধ্যমে অনেক ধরনের ম্যানিপুলেশন এবং দেনদরবার করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। ডলারের দর নিয়ে এক ধরনের সমন্বয়হীনতা কাজ করছে। তাই বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে।

শেয়ার বিজ