আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কৌশল বুঝতে পারছে না জাতীয় পার্টি (জাপা)। ২৯৮ আসনে নৌকার প্রার্থী থাকায় অতীতের অভিজ্ঞতায় শঙ্কিত লাঙ্গলের প্রার্থীরা। জাপার কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের কথা বললেও এমপি হওয়া নিশ্চিত করতে লাঙ্গলের প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা চান।
জাপার একটি সূত্রের ভাষ্য, আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতার আলাপ না হলেও, একটি সংস্থার মাধ্যমে কথা চলছে। তারা আশ্বস্ত করেছে, জাপাকে ফের প্রধান বিরোধী দলে বসাতে কিছু আসন ছাড়বে আওয়ামী লীগ। তবে জাপার প্রত্যাশা ৫০ আসন হলেও, সংখ্যার বিষয়ে কিছুই বলা হচ্ছে না।
তবে কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় জাপাকে আসন ছাড়া হবে, তা বলতে পারছেন না দলটির নেতারা। কিছু আসনে ‘ম্যাচ ফিক্সিং’ হতে পারে ধারণা করা জাপার এক কো-চেয়ারম্যান বলেন, পুরোপুরি অন্ধকারে আছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া কেউ জানেন না কীভাবে নির্বাচন হবে। প্রার্থী হওয়া এ নেতার ভাষ্য, সাংগঠনিক শক্তি ও ভোটের অঙ্কে বহু পিছিয়ে থাকায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোথাও পেরে ওঠা অসম্ভব। জিততে সমঝোতা দরকার। আসন না পেলে নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার কথাও বলেছেন তিনি।
গত তিনটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট এবং সমঝোতা করে জাপা। ২০০৮ সালে ৪৯ আসনে লাঙ্গলের প্রার্থী ছিল। এর ২৯টিতে নৌকার প্রার্থী ছিল না। বাকি ২০ আসনে নৌকা ও লাঙ্গল; দুই দলের প্রার্থী ছিল। এসব আসনের সবটিতে হারে জাপা।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিএনপিবিহীন নির্বাচন জাপার প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বর্জন করলেও, রওশন এরশাদের নেতৃত্বে দলটির একাংশ ভোটে যায়। আওয়ামী লীগের ছাড় দেওয়া ৩৩ আসনে জাপা জিতলেও, যে ৪৬ আসনে নৌকা ও লাঙ্গল; উভয় প্রতীকের প্রার্থী ছিল, তার মাত্র একটিতে জেতে। গত নির্বাচনে নৌকার বিরুদ্ধে ১৪৫ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে একটিতেও জামানত বাঁচেনি লাঙ্গলের।
এই পরিসংখ্যানে স্পষ্ট, বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলেও ফাঁকা মাঠে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতার শক্তি নেই জাপার। তবে দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সমকালকে বলেছেন, ‘এবার আমাদের নীতি একলা চলো।’
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জেতা অসম্ভব বলে মনে করা জাপা প্রার্থীদের প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘ভয় পেলে নির্বাচন করার দরকার নেই। ২৮৮ আসনে লাঙ্গল আছে। এবার আর সমঝোতা হবে না; সমঝোতার প্রশ্নও নেই।’
নৌকার বিরুদ্ধে লড়াইকে অসম মানছেন না মুজিবুল হক চুন্নু। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগবিরোধী ভোট এখন বেশি। ওই ভোটাররা কেন্দ্রে আসতে পারলে জাপা সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাবে। সরকার ও নির্বাচন কমিশন আশ্বস্ত করেছে– ভোটাররা কেন্দ্রে আসতে পারবে। এ কারণে নির্বাচনে যেতে রাজি হয়েছে জাপা।’ আশ্বাস পূরণ না হলে বিকল্প পথ খোলা বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি। সেই বিকল্প পথ কোনটি– সে প্রশ্নে চুন্নুর বক্তব্য, সময়ই বলবে।
পটুয়াখালী-১ আসনে জাপার কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দলের সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন। তারপরও হাওলাদার বলছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে হৃদয়ের সমঝোতা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আসন নিয়ে যেসব প্রশ্ন উঠেছে, তার সমাধান হয়ে যাবে বলে আমি আত্মবিশ্বাসী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ চালান। তিনি জাতীয় পার্টির সম্পর্কেও ধারণা রাখেন। জাতীয় পার্টি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে; দেশের উন্নয়নে বিশ্বাসী।’
জাপার একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা সমকালকে বলেন, ভোটের হিসাবে লাঙ্গলের অবস্থান জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী আন্দোলনেরও পেছনে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে জাপার পক্ষে দুই-তিনটি আসন পাওয়াও কঠিন। আবার সমঝোতা করলে আন্তর্জাতিক মহলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখাতে জাপা এবং জোটের শরিকদের আগের মতো সরাসরি আসন ছাড়ছে না আওয়ামী লীগ। এতে অন্তত ২৯৫ আসনেই নৌকা বা আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতবেন। তাহলে আগামী সংসদে বিরোধী দল না থাকার বিড়ম্বনায় পড়বে সরকার। এতে আওয়ামী লীগেরই ক্ষতি। সেই কারণে কিছু আসনে নৌকাকে হারিয়ে লাঙ্গলকে জেতানো হবে বলে মনে করছেন জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এই নেতা।
তবে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা এই কৌশল মানবেন কিনা, তা নিয়ে তাঁর নিজেরও সংশয় রয়েছে। তিনি বলেছেন, ঢাকা থেকে যে নির্দেশই যাক, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা হারতে চাইবেন না। এতেই ভয়ে জাপা প্রার্থীরা।
গাইবান্ধা-১ আসনে ২০১৮ সালে উপনির্বাচনে নৌকাকে হারিয়ে এমপি হন জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী। তাঁরও অভিমত, আসন সমঝোতা প্রয়োজন। তিনি বলেন, ‘বিএনপি ও জামায়াত নির্বাচন বর্জন করায় অশান্তি হতে পারে। আওয়ামী লীগ ও জাপা যদি যুদ্ধরত অবস্থায় থাকে, তাহলে নিয়ন্ত্রণের বাইরে অনেক কিছু হয়ে যেতে পারে। নির্বাচনের পরিবেশকে শান্ত রাখতে কিছুটা সমঝোতা প্রয়োজন। সমঝোতা হলেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ঝুঁকি নেই।’
চারবার নির্বাচিত হওয়া বৃহত্তর রংপুরে জাপার এক সাবেক এমপি বলেন, ‘২০১৮ সালে আমার আসনে আচমকা প্রার্থী দেয় আওয়ামী লীগ। কোনোদিন লাখের কম ভোট পাইনি। হারজিত আছে; কিন্তু গত নির্বাচনে আমাকে পাঁচ হাজার ভোট দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের প্রার্থী থাকলে আগামী নির্বাচনেও একই অবস্থা হবে। সরকার, নির্বাচন কমিশন নৌকার প্রার্থীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে বলে বিশ্বাস করি না।’
এদিকে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় দলটির সমর্থকদের ভোটে ভালো ফলের আশা করছেন জাপার অনেক শীর্ষ নেতা। কয়েক মাস আগে পাঁচ সিটির নির্বাচনেও বিএনপি ছিল না। কিন্তু সিলেট বাদে কোথাও তৃতীয় হতে পারেনি জাপা। ঢাকায় প্রার্থী হওয়া জাপার এক প্রেসিডিয়াম সদস্য সমকালকে বলেন, ‘সিটিতে কাউন্সিলর প্রার্থীদের কারণে আত্মীয়তা ও মহল্লার ইস্যুতে ভোটার উপস্থিতি বাড়ে। সেখানে সুষ্ঠু ভোট হলেও, জাতীয় নির্বাচনে তাও হবে না। আওয়ামী লীগ সমর্থকরাই আসবেন ভোট দিতে। তাঁরা নৌকা অথবা দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীকে ভোট দেবেন। সমঝোতা না হলে জাপাকে ভোট দেবে কে?’
গত দুই নির্বাচনে ঢাকার দুটি আসনে জয়ী হয়েছেন জাপার দুই কো-চেয়ারম্যান। এবারও তাঁরা প্রার্থী। তবে এবার তাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থী রয়েছে। জাপার প্রার্থী হওয়া একজন বলেছেন, আওয়ামী লীগ প্রার্থী না সরালে নির্বাচন করে লাভ নেই। আওয়ামী লীগের যাকে প্রার্থী করা হয়েছে, তাঁর পক্ষে প্রশাসন ও পেশিশক্তি রয়েছে। তিনি সকাল বেলায় জিতে যাবেন ক্ষমতার জোরে। এমন হলে জাপাকে নির্বাচন থেকে সরে যেতে হবে।
নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে নৌকার প্রার্থী নেই। জাপার এমপি এ কে এম সেলিম ওসমান সেখানে ফের প্রার্থী হয়েছেন। দলীয় সূত্রের ভাষ্য, ওসমান পরিবারকে ছাড়া হয়েছে আসনটি। এখানে ছাড়া আর কোথাও জাপার জয় নিশ্চিত নয়। আওয়ামী লীগ ছাড় না দিলে রংপুর-৩ আসনে জি এম কাদেরের জয়ও অনিশ্চিত।