বিরূপাক্ষ পাল
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের গভীরে ছিল অর্থনীতির দুই পাপ—বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি। এর পেছনের মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলোর মধ্যে প্রথমেই ছিল বাক্স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক অধিকারের দাবি। এই দাবির দমন কাজে সবচেয়ে অন্যায্যভাবে ব্যবহৃত হয়েছে বিগত সরকারের গোয়েন্দা বিভাগগুলো।
এরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। জনগণের অর্থে লালিত হয়েও কাজ করেছে ক্ষমতাসীন পার্টির দলীয় ক্যাডার বাহিনীর মতো। এটি অসাংবিধানিক। এটি গোয়েন্দা বিভাগগুলো পুষে রাখার যে রাষ্ট্রীয় উদ্দেশ্য, তার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। গোয়েন্দাবৃত্তির এই অসংগত ব্যবহার থেকেই কখনো ‘আয়নাঘর’ কিংবা কখনো ‘ভাতের হোটেল’ জনতাকে চমকে দিয়ে বাংলা সাহিত্যে স্থান করে নিয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার ছয়টি ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য কমিটি গঠন করেছে। কিন্তু এর মধ্যে কেন জানি ‘গোয়েন্দা বিভাগগুলোর সংস্কার’-এর বিষয়টি অনুচ্চারিত রয়ে গেল। অথচ এটিই হওয়া উচিত ছিল এক নম্বর সংস্কারের বিষয়বস্তু। কয়েক দিন আগে বর্তমান সরকার যে পাঁচটি বিষয়ের সংস্কারকল্পে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করেছে, সেগুলো হলো—১. জনপ্রশাসন, ২. দুর্নীতি দমন, ৩. নির্বাচন কমিশন, ৪. বিচার বিভাগ ও ৫. পুলিশ সংস্কার। এই সবগুলোর মাথায় বসে থাকা ডান্ডাওয়ালা গুরুর নামই তো হচ্ছে গোয়েন্দা বিভাগ।
আওয়ামী লীগের মতো তৃণমূল থেকে উঠে আসা একটি দল শেষকালে আমলা, ব্যবসায়ী ও গোয়েন্দাদের ত্রিবেণি সংগমে নিজেদের ভাসিয়ে দিয়েছিল। ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান’ নামক যে বিদ্যা নিখুঁত রাজনীতি মানুষকে শেখায়, তা আর অবশিষ্ট ছিল না বলেই আওয়ামী লীগের এই দুর্ভাগ্যজনক বিদায় ঘটেছিল। এর মূলে গোয়েন্দা বিভাগগুলোর ব্যর্থতাও দায়ী। কারণ, এরা ক্ষমতার অপব্যবহার, অপেশাদারি ও রাজনৈতিক দলীয়বৃত্তিতে জড়িয়ে পড়েছিল। তাই এই বিভাগগুলোর সংস্কার প্রয়োজন।
এগুলোকে সংস্কারের বাইরে রেখে আর সব সংস্কার দিনান্তে অর্থহীন হয়ে পড়বে। কারণ, এই সংস্থাগুলোর বিচরণ সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। তাই পরবর্তী সরকারের মনভোলানোর কাজ গোয়েন্দারা করবে। কদিন বাদে নির্বাচিত সরকারও ভাববে, এদের সাহায্য নিয়ে বিরোধী দল বা ভিন্নমতাবলম্বীকে চিপাগলিতে ফেলে ঠ্যাঙালে ক্ষতি কী? তখন আয়নাঘরের বদলে আসবে ‘চিরুনিঘর’ আর ভাতের হোটেলের জায়গায় চালু হবে ‘ক্যাফে বিরিয়ানি’।
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোতে ব্যাপক পরিবর্তনের দাবি শুরু হয়। কারণ, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর স্নায়ুযুদ্ধের অবসানে পৃথিবী বদলে যায়। মার্কিন কংগ্রেসে গোয়েন্দাদের কাজের পুনঃসংজ্ঞায়ন শুরু হয়। সিনেটর ড্যানিয়েল মইনিহ্যান বলেছিলেন যে সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি বা সিআইএ-কে এখন কাজ খুঁজতে হবে। বিগত স্নায়ুযুদ্ধের ক্যাডারদের এখন অবসর নেওয়ার সময় হয়েছে।
আসলে এই কথা বলে তিনি বুঝিয়েছিলেন যে সিআইএ সেই সময় থেকে মনোযোগ দেবে অর্থনীতি ও প্রযুক্তির যুদ্ধে। তখনো চীন এতটা তাজা হয়ে ওঠেনি। রাশিয়া ছিল কোমরভাঙা সৈনিকের মতো। তাই কংগ্রেসে প্রস্তাব এল যে মূলত তিনটি বিষয়ে শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা নজর দেবে, ১. অর্থনৈতিক গুপ্তচরবৃত্তি ২. পরিবেশগত হুমকির মোকাবিলা ও ৩. অর্থ পাচার ঠেকানো।
ওই সময় মার্কিন গোয়েন্দাবৃত্তির সংস্কারের লক্ষ্যে একটি সিনেট কমিটি গঠিত হয়। এর চেয়ারম্যান ডেনিস ডিকনসিনি তখন যুক্তি উত্থাপন করেন যে পরিবর্তিত বিশ্বে সামরিক যুদ্ধের চেয়েও বড় যুদ্ধের নাম হচ্ছে অর্থনীতি ও প্রযুক্তির প্রতিযোগিতা।
এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে সর্বাগ্রে এক ধাপ এগিয়ে রাখাই হোক মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাজ। কংগ্রেসে সে প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর থেকে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কর্মবৃত্তান্ত ও ওয়েবসাইট পাল্টে গেল। এদের ওয়েবসাইট দেখলে মনে হবে এরা বাংলাদেশ ব্যাংক বা বিআইডিএসের মতো কোনো গবেষণাপ্রতিষ্ঠান। আন্তর্দেশীয় এক গবেষণাকর্মের সময় আমি যেন সিআইএর দেওয়া তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যবহার করি, সে রকম উপদেশও দিয়েছিলেন আমার একজন আমেরিকান সুপারভাইজার।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১৮টি গোয়েন্দা সংস্থা থাকলেও মূলত সিআইএ, ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি বা এনএসএ, ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি বা ডিআইএ ও ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা এফবিআই—এদের কথাই বেশি শোনা যায়। সংখ্যাটি একটু বেশি শোনালেও বুঝতে হবে যে এখানে প্রত্যেকের কাজ আলাদা করে সীমারেখা দেওয়া আছে।
বাংলাদেশে ভাতের হোটেল কিংবা আয়নাঘর যে রকম একই প্রকৃতির রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করে, মার্কিন মুলুকে তা নয়। অ্যাডাম স্মিথের শ্রমবিভাজন মান্য করা হয়। যেমন সিআইএ মানুষ সম্পর্কিত আর এনএসএ সংকেত বার্তা–সম্পর্কিত বা ইলেকট্রনিক গোয়েন্দাগিরিতে লিপ্ত, যদিও দিন শেষে এরা দুটোই রাষ্ট্রকে নিরাপদ রাখার লক্ষ্যে কাজ করে। কোনো রাজনৈতিক দলের শাসন দীর্ঘায়িত করার ব্রত গ্রহণ করে না।
সিআইএ সর্বোচ্চ সংস্থা হলেও এর কাজ বিদেশি নাগরিক নিয়ে। মার্কিন কোনো নাগরিক নিয়ে এর নাক গলানোর অধিকার নেই। কাউকে গ্রেপ্তার করার অধিকার এফবিআইয়ের রয়েছে, কিন্তু সিআইএর নেই। সিআইএ শুধু যুদ্ধ ও প্রতিরক্ষা–সম্পর্কিত তথ্য ও গুপ্ত খবর প্রদান করে। কৌশলবিদ, বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, উপাত্ত বিশ্লেষক, হিসাববিদ ও গবেষকদের সমন্বয়ে সিআইএকে বলা হয় পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ জ্ঞানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জন ন্যাশ বিখ্যাত হয়েছিলেন তাঁর দেওয়া গেম থিওরির জন্য। এই ব্যবসায়িক কৌশলবিদ্যা কাজে লাগিয়ে কূটনীতি ও সমরবিদ্যায় প্রয়োগ করা হয়। তাই তিনি গোয়েন্দাবৃত্তির কৌশলেও ছিলেন এক আদৃত পণ্ডিত। এভাবে গোয়েন্দাগিরির শাস্ত্রটি নিজেকে সমৃদ্ধ করলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কোথায় যেন তাদের একটা অধঃপতন হয়েছে। সরকারগুলো এদের নিছক নিজস্ব দলীয় স্বার্থ হাসিলের কাজে রাতদিন ব্যবহার করে একেবারে ‘ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো’ বানিয়ে ফেলেছে। এদের ভাবমূর্তি উদ্ধারের সমূহ প্রয়োজনে এই বিভাগগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে।
বাংলাদেশে ডিজিএফআই, ডিবি, এসবিসহ প্রায় সব গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে যেন এক অলিখিত প্রতিযোগিতা চলতে থাকে, কে কার আগে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের স্বার্থ হাসিল করবে। এটি প্রমাণের অগ্নিপরীক্ষা হচ্ছে কে কার আগে কত বেশি তথাকথিত শত্রুপক্ষের পেটে ঢুকতে পারবে। পারলে শয়নকক্ষের কথাবার্তাও রেকর্ড করা হয়। এতটা ব্যক্তিজীবনে সরকার ঢুকতে পারে না। এটি অপরুচির পরিচায়ক।
ব্যক্তিগত গোপনীয়তা মানবাধিকারের অঙ্গ। বিভাগীয় শিক্ষক হওয়ার সমুদয় যোগ্যতা যার রয়েছে, সে রকম আমার এক প্রিয় ছাত্র আমাকে দুঃখ করে বলেছিল যে ভাইভার আগের রাতে গোয়েন্দা বিভাগ থেকে তাকে ফোন করে মানসিক যন্ত্রণা দেওয়া হয়েছে। তার রাজনৈতিক বিশ্বাস নিয়ে খোঁচানো হয়েছে। এটা কি উত্তর কোরিয়া না রাশিয়া? স্বাধীন বাংলাদেশে খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে স্বাধীনতার মূল্য কী থাকে? পাকিস্তান আমলেও এটি হতো কি না সন্দেহ।
এখানেই থেমে নেই। চট্টলার বিখ্যাত ব্যাংকখেকোকে সহায়তা দিয়ে কীভাবে আরও ব্যাংক গ্রাসের সহায়তা করা যায়, সেখানেও তৎপর গোয়েন্দা। কাকে টক শোতে নেওয়া যাবে, কাকে যাবে না, সেখানেও গোয়েন্দা। কী খবর ছাপব, কী ছাপব না, সেখানেও ওরা। সাবেক প্রধান বিচারপতিকে কীভাবে প্রচ্ছন্ন চাপ দিয়ে দেশছাড়া করতে হবে, সেখানেও ওরা। এভাবে চলতে দিলে কিছুদিন বাদে ওরাই ঠিক করত কার সঙ্গে কার বিয়ে বা বিচ্ছেদ হবে।
এই অশনিসংকেত বোঝায় যে ক্ষমতার দীর্ঘায়নলিপ্সু সরকারি দলের চাপে পড়ে গোয়েন্দা বিভাগগুলো রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যে বর্ণিত সেই ‘পথভোলা পথিক’ হয়ে পড়েছে। সংস্কারের লক্ষ্য হবে এই বিভাগগুলোর কাজের সুনির্দিষ্ট সীমারেখা তৈরি করে এদের মধ্যে পেশাদারি বাড়ানো।
উন্নত দেশের উত্তম চর্চাগুলো অনুসরণ করে এরা যেন জ্ঞান ও গবেষণা দিয়ে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন নিশ্চিত করে রাষ্ট্রস্বার্থ রক্ষায় ব্রতী হতে পারে। মানুষের মৌলিক অধিকার ও ব্যক্তিজীবনের ভদ্রোচিত গোপনীয়তা রক্ষা এবং রাষ্ট্রের সামরিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা বাড়ানোই গোয়েন্দা বিভাগগুলোর সংস্কারের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
● ড. বিরূপাক্ষ পাল যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ড-এ অর্থনীতির অধ্যাপক
prothom alo