অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নতুন বাংলাদেশ নিয়ে মানুষের স্বপ্ন, গুরুত্বপূর্ণ নানা খাতে সংস্কারের মাধ্যমে সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন, গণতন্ত্রের উত্তরণ ও চলমান পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। ২ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও কূটনৈতিক প্রতিবেদক রাহীদ এজাজ। আজ পড়ুন শেষ পর্ব।
ড. ইউনূস: এসবে আমাদের থাকার দরকার নেই। আমরা বিচারব্যবস্থা সংস্কারে বসেছি। বিচারব্যবস্থার সংস্কার করলে সংস্কারের ভেতর দিয়ে কার বিচার করবেন, কীভাবে বিচার করবেন, কে বিচার করবে, সবকিছু আসবে। এখন আমরা তো পলিটিক্যাল ডিসিশন দিতে যাচ্ছি না। আমরা শুধু পরিমণ্ডলটা সৃষ্টি করতে যাচ্ছি। এই পরিমণ্ডল দিয়ে যেভাবে অগ্রসর হতে চান, সেভাবে হবে। আপনারাই বানিয়ে দিয়েছেন, আমরা শুধু ফেসিলিটেট করে দেব।
ড. ইউনূস: সে জন্য তাঁদের যেখানে পাওয়া যাচ্ছে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, জেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সবকিছু হচ্ছে। বিচার করছি না কিন্তু। বিচারটা আগে ঠিক করেন, কীভাবে বিচারপ্রক্রিয়া হবে। সেই বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিচার করবেন।
ড. ইউনূস: সে জন্যই জুডিশিয়ারির সংস্কার দরকার। আমি একা বলে দিলে তো হবে না। এটা তো তাহলে বিচার হলো না। এটা আইনের ভেতর দিয়ে আইনমতো হচ্ছে। কিন্তু আইনটা ভালো নয়। এ আইনগুলো পাল্টানো দরকার। কাজেই সেভাবেই আসতে হবে। আমরা এককভাবে একটা ঘোষণা দিয়ে দিলাম, তাহলে তো আবার আমরা একনায়কতন্ত্রের দিকে চলে গেলাম। আমরা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আসতে চাচ্ছি। ধীরে আসতে চাচ্ছি। বিচারপ্রক্রিয়া এমন জিনিস, এখানে যে ভুল হচ্ছে না, তা নয়। ভুল হচ্ছে। ভুলটা ধরিয়ে দিলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে সংশোধন করার চেষ্টা করছি। আবার বলছেন আপনারা সিদ্ধান্ত পাল্টান। এ জন্যই আমাদের ভুল ধরিয়ে দিলে আমরা সিদ্ধান্ত পাল্টাই।
ড. ইউনূস: ওই যে ল অ্যান্ড অর্ডার স্টাবলিশ করা। এগুলো হলো ল অ্যান্ড অর্ডার সিচুয়েশনের বিষয়। এখানে কোনো রাজনৈতিক বিষয় নেই। এখানে যে হত্যাকাণ্ড, মব জাস্টিস হচ্ছে, এগুলো হচ্ছে ল অ্যান্ড অর্ডারের বিষয়। ল অ্যান্ড অর্ডার শক্ত করতে পারলে এ জিনিসগুলো হবে না। সামাজিক তৎপরতা যদি বাড়াই, মানুষ মানুষের প্রতি যত্ন নেয়, তাহলে এগুলো হবে না। সরকার গিয়ে মারামারি থামাতে পারবে না। মারামারি করলে শাস্তি হবে, এটুকু আমরা বলতে পারি। আমরা বারবার বলছি, আমরা একটি পরিবার। আমাদের মতের ভিন্নতা থাকতে পারে। এ জন্য কেউ কারও শত্রু নই। এ জিনিসটা যেন আমরা পরিষ্কার রাখি।
ড. ইউনূস: এটাও আমাদের কোনো সিদ্ধান্তের বিষয় নয়। কাজেই যখন রাজনৈতিক দলগুলো বসবে, তারা সিদ্ধান্ত নেবে। যত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আছে, সেগুলো আমরা রাজনীতিবিদদের কাছে নিয়ে যাব। তাঁরা যেভাবে সিদ্ধান্ত দেন।
ড. ইউনূস: কমিশন যদি মনে করে যে দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে, যখন নির্বাচনের বিষয় আসবে, সেখানে আলাপ হবে। অতএব ওটাও আবার রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে যাবে। ওটা খসড়া করবে তারা। কমিশন করলেই যে সেটা চূড়ান্ত হয়ে গেল, তা কিন্তু নয়। কমিশনের সুপারিশ রাজনৈতিক দলের কাছে যাবে। রাজনৈতিক দল নিজেদের মধ্যে বিতর্ক করে, আলাপ-আলোচনা করে এটার সিদ্ধান্ত দেবে, কোন দিকে আমরা অগ্রসর হব।
ড. ইউনূস: আপনি ১৫ বছর পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢুকতে পেরেছেন। এই ১৫ বছরে আপনাকে ঢোকার সুযোগ আগের সরকার দেয়নি। এই যে সরকারের কাছে যেতে পারাটা, এটা হিমালয় পর্বত অতিক্রমের মতো। এখন অতিক্রম হয়ে গেছে। এখন তো কোনো বাধা আপনার জন্য নেই। আপনি কখন আসবেন, কখন যাবেন, কখন চাইবেন, সেটা আপনার ওপর নির্ভর করবে। আমাদের এটার ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। প্রথম আলো পত্রিকা কার কাছে যেতে পারবে, কার কাছে যেতে পারবে না, সেই নির্দেশ দেওয়ার মালিক তো আমি নই। কারা বিজ্ঞাপন পাবেন, আর কারা বিজ্ঞাপন পাবেন না, সেটা বলার কোনো ক্ষমতা আমার নেই। আমরা এই ক্ষমতা চাই না। কেন আমরা সেই ক্ষমতা নিতে যাব? আপনারা মন খুলে লেখেন। সমালোচনা করেন। না লিখলে আমরা জানব কী করে যে কী হচ্ছে আর কী হচ্ছে না। আমরা তো ফেরেশতা নই যে সবকিছু ঠিকমতো হয়ে যাচ্ছে। কাজেই আপনারা বললে আমরা একটু সতর্ক হই।
ড. ইউনূস: সে জন্য আমরা মিডিয়া কমিশনের কথা বলেছি। মিডিয়া কমিশন আমাদের ধরিয়ে দেবে, হয় আইনগুলো পাল্টানো দরকার, না হলে বাতিল করে দেওয়া দরকার। আমরা এখানে কোনো আইনের জন্য লড়াই করছি না। আমাদের তো কোনো স্বার্থ নেই; যাতে পরবর্তী সময়ে কোনো প্রজন্ম এই অভিযোগ আমাদের দিতে না পারে যে এরা বাধার সৃষ্টি করে গেছে।
ড. ইউনূস: আমরা নিজেদের মধ্যে এ বিষয়ে আলাপ করি। আমাদের কাছে কাজটা তো পরিষ্কার। কাজটা হলো নির্বাচনের প্রস্তুতি। এই কাজ আমাদের শুরু করে দিতে হবে। কাজেই নির্বাচনের প্রস্তুতির একটা স্টিম চলতে থাকবে। তার সঙ্গে সংস্কারের কাজ। দুটি একসঙ্গে যাবে। এটি কোনো আলাদা জিনিস নয়। একটা শেষ করে আরেকটা ধরব। নির্বাচনের প্রস্তুতি দিয়ে নির্বাচন চলবে। কখন, কোথায় কী করা যায়, কত দূর যাব। আবার সংস্কার। কারণ, সংস্কার হলো আমাদের কেন্দ্রবিন্দু। এই নির্বাচনটা হচ্ছে সংস্কারকে এস্টাবলিশ করার জন্য। কাজেই যখন দেখা যাবে নির্বাচনের প্রস্তুতিও হয়ে গেছে, সংস্কারের কাজ গোছানো হয়ে গেছে। এক্সিকিউট করা হয়নি। তখন প্রশ্ন উঠবে, সংস্কারটা করে যাবেন, নাকি নির্বাচনে চলে যাবেন। এটা আপনাদের বিষয়। আমরা প্রস্তুতিটা চালিয়ে যাব। আপনারা দেখবেন, আমরা কোনটাতে কত দিন খাটাচ্ছি। এটা আপনাদের দৃষ্টিতে থাকবে। কাজেই সময় বেঁধে দিলাম, এর মধ্যে দেব। এর মধ্যে যা পান দিয়ে যান, এ রকম তো বিষয়টা নয়। বিষয়টা হলো দুটি প্রস্তুতি থাকবে। যদি বলেন যে নির্বাচন দিন। নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত তো আমরা আছি। আগে নির্বাচন হলে সেটা ভুল কাজ হবে। আরেকটা হতে পারে, আগে সংস্কারটা করে দেন। নির্বাচনটা পেছনে রেখে এসেছি, যাতে আমরা সময়টা পাই। আমরা নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে একই গতিতে যাব। এক জায়গাতে গিয়ে নির্বাচনের কাজ সমাপ্ত হয়ে যাবে। যেকোনো তারিখ ঘোষণা করলে নির্বাচন হয়ে যাবে। বলব যে আমরা নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করব, নাকি আরেকটু এগিয়ে যাব। সেভাবেই সময় নির্ধারণ হবে।
ড. ইউনূস: অনেকটা নির্ভর করে। পুরো জিনিসটা হচ্ছে আপনারা কী চান, সেটার ওপর নির্ভর করছে। তারিখ ঘোষণা করে আমার কী লাভ। যদি কেউ মনে করে ওদের একটা অভিসন্ধি আছে। বহুদিন ধরে থাকতে চায়। আপনি তাঁদের (উপদেষ্টাদের) চেহারাগুলো দেখেন। সব বন্দীর মতো রয়েছে, আমাদের ছেড়ে দিন, আমরা যাই। কেউ কেউ বলে যে আমি তো ছেলেমেয়ে নিয়ে বাঁচতে পারব না। আমাকে যে বেতন দেন, আমি একটা ছেলেকে বিদেশে পাঠাই। খরচ দিতে হয়, আমি কোথা থেকে দেব। তাড়াতাড়ি শেষ করে দিই আমরা—এ–ই হলো আমাদের অবস্থা। আমরা কেউ থাকার দিকে নই। আমরা চাই বিষয়গুলো যেন সঠিক হয়। সেটাই আমাদের লক্ষ্য। বারবার যে কথাটা বলছি, এ জাতির জীবনে এই সুযোগ আর আসবে না। এই সুযোগ তো এখন আছে। সুযোগটা পুরোপুরি ব্যবহার করুন। আমাদের উপলক্ষ করে কাজটা আপনারা করেন, যেন আমরা সবাই মিলে বলতে পারি আমাদের সুযোগ এসেছিল, আমরা সেই সুযোগটা গ্রহণ করেছিলাম। কেউ যেন না বলে সুযোগ এসেছিল, আমরা সেই সুযোগ গ্রহণ করিনি। তোমরা পারোনি।
ড. ইউনূস: আমাদের দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কটা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হতে হবে। এর কোনো ব্যত্যয় নেই। এটা তাদেরও দরকার, আমাদেরও দরকার। এটা অর্থনীতি, নিরাপত্তা, পানির প্রবাহ—যেদিক থেকেই চিন্তা করুন না কেন। একে অপরকে ছাড়া চলা তো আমাদের জন্য মুশকিল হয়ে যাবে। কাজেই এটা স্বাভাবিক যে আমাদের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ হতে হবে, সুসম্পর্ক হতে হবে সবকিছুতেই। কারও মনে যাতে এমন ধারণা না হয় যে কেউ কারও ওপর কিছু চাপিয়ে দিচ্ছে। সার্বভৌম দুটি দেশের মধ্যে যে ধরনের সুসম্পর্ক হয়, সে ধরনের সম্পর্ক এটা। এটা আমরা সব সময় চেষ্টা করে যাব। হয়তো ভারত মনঃক্ষুণ্ন হয়েছে যে সমস্ত ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেছে তাতে। তারা এই পরিবর্তনগুলো পছন্দ করেনি। এটা তাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে, সারা পৃথিবী যখন আমাদের গ্রহণ করছে, তারা আমাদের গ্রহণ না করে কোথায় যাবে। যেহেতু তাকে সুসম্পর্কে আসতে হবে এটা এমন নয় যে আমরা তাকে বাধ্য করছি। এটা তার নিজের কারণেই প্রয়োজন। আমাদের প্রয়োজনে যেমন তাদের দরকার, তেমনি তাদের প্রয়োজনে আমাদের দরকার। কাজেই সাময়িক বিষয়গুলো আমাদের ভুলে যেতে হবে। কে কার সম্পর্কে কী বলল, কটু মন্তব্য করল, এগুলো বলে লাভ নেই। এগুলো কথার ফুলঝুরি। মূল জিনিসটা হলো আমাদের সুসম্পর্ক করতে হবে। সে জন্য যা কিছু দরকার, সেটা নিয়ে আমাদের অগ্রসর হতে হবে।
আমি বারবার সার্কের কথা বলে এসেছি। এবারও বলেছি। উৎসাহ ছিল। সার্কের সরকারপ্রধানেরা আমার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। কিন্তু শুধু ভারতের সঙ্গে আমার বৈঠকটা হলো না। না হলে সবার সঙ্গে আমার বৈঠক হয়েছে। শ্রীলঙ্কা আসতে পারেনি। কারণ, মাত্র সে প্রেসিডেন্ট হয়েছে। এলে তার সঙ্গেও বৈঠক হতো। কাজেই আমরা চেষ্টা করছি অন্তত আনুষ্ঠানিকতার খাতিরে হলেও সার্কের দেশগুলো দাঁড়িয়ে একটা ছবি তুললাম, এই সার্কের সঙ্গে আমরা একত্রে আছি।
ড. ইউনূস: সম্পর্কটাকে অত্যন্ত মজবুত করা এবং একই সঙ্গে সার্ককে জোরদার করা।
ড. ইউনূস: সার্কের জন্ম থেকে আমি এটার পেছনে আছি। আমি মনে করি যে এটাই আমাদের ভবিষ্যৎ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি এত ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব–বিভেদ থাকা সত্ত্বেও জোট করে ঘনিষ্ঠভাবে চলতে পারে, আমাদের তো ওই রকম দ্বন্দ্বের কোনো ইতিহাস নেই। আমরা কেন পারব না? একত্রে হলে আমাদের কত সুযোগ-সুবিধা বেড়ে যেত। সার্কে আমাদের ঘুরেফিরে আসতে হবে, সেটা আমরা সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছি। আমার সঙ্গে যাদের দেখা হয়েছে, তারা সবাই বলেছে, আমরা সার্ক চাই।
ড. ইউনূস: ওটা তো সমাধান করা যায়। সমস্যা হলেই যে রাখতে হবে বলে তো কথা নেই। এটার সমাধান আছে তো। আমি সার্ক রাখব এবং এই সমস্যা জিইয়ে রাখব, ওটা তো হবে না। সমস্যার যে শেষ সমাধান হতে হবে, তা নয়। একটা মোটামুটি সমাধান সার্ক চলার মতো আমরা করতে পারি। যে সমস্ত বিষয় আপনি স্থগিত রাখতে চান, পাকিস্তানের সঙ্গে সেগুলো রেখেও তো এগোনো যায়। কাজেই এটা আমার একটা বড় নীতি থাকবে, আমি চেষ্টা করব।
আরেকটা হলো আসিয়ান। আসিয়ানের সদস্যপদ আমরা যেন পাই। তাহলে সার্ক একদিকে আর আসিয়ান একদিকে, মাঝখানে বাংলাদেশ। দুই জোটের সঙ্গে একত্রে থাকলাম। তাহলে আমরা একটা বৃহত্তর অবস্থানে থাকলাম।
প্রথম আলো :
আসিয়ানে যোগ দেওয়ার বিষয়ের সঙ্গে কি অর্থনৈতিক, ব্যবসায়িক, কূটনৈতিক, নাকি অন্য কোনো দিক আছে?
ড. ইউনূস: মূলত অর্থনৈতিক। বিরাট বাজার, এই বাজারের সঙ্গে আমরা সংযুক্ত হলাম। ইন্দোনেশিয়া বলে যে একটা দেশ আছে, বাংলাদেশের মানুষ তো খবরই রাখে না। বিশাল এক দেশ আসিয়ানের অন্তর্ভুক্ত। এখন আমরা তাকে অবহেলা করে ফেলে রেখেছি। অথচ আমাদের দরকার ছিল তাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা। তাদের সুযোগ–সুবিধা আমাদের গ্রহণ করা। আমাদের জগৎটাকে বৃহত্তর পরিমণ্ডলে নিয়ে আসা।
ড. ইউনূস: বহু বছর আগে আমি বলেছিলাম, এটা আমাদের একটা বড় সুবিধা। আমরা যে দুই বিশাল অর্থনীতির মাঝখানে আছি, এটা আমাদের দুর্বলতা নয়, সবলতা। দুই দেশের কাছ থেকে আমরা শিখব। দুই দেশ আমাদের বাজার হবে। দুই দেশই আমাদের কাছে আসবে। এই দুই দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেই আমাদের চলতে হবে। এটা আমাদের সুযোগ।
ড. ইউনূস: চীনের শক্তি আর সামর্থ্য তো ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। ক্রমাগতভাবে দেশটিতে সায়েন্টিফিক ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে। কাজেই তার সঙ্গে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে বহু সুযোগ আছে। বহু জিনিস তার দরকার নেই, সেগুলো আমরা নিয়ে নিতে পারি। আমাদের দেশে সেগুলো আসতে পারে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত একটি বিষয়। আমি চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছি, তিনিও সম্মতি দিয়েছেন। এ সমস্ত জিনিস তাদের লাগছে না। তাদের বাজার সংকুচিত হয়ে গেছে, আমেরিকানরা তাদের জিনিস কিনবে না। নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কাজেই আমি বললাম যে তোমাদের ওই শিল্পগুলো এখানে রিলোকেট করো। এখানে দাও। আমরা উৎপাদন করে সারা দুনিয়ায় বিক্রি করি। সোলার এনার্জির সুযোগ তো ক্রমাগত বাড়বে, কমবে না। কাজেই আমরা সেই সুযোগটা গ্রহণ করি। এবার জাতিসংঘে গিয়ে সবার কাছে বলেছি, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে আমরা এক নম্বর হতে চাই। কে কত রিনিউয়েবেল এনার্জি দেবে, কোন কোন সূত্রে দেবে…নেপালের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার সময় তিনি বললেন, আপনার যত হাইড্রো এনার্জি দরকার, নিয়ে যান। আপনার যত বিদ্যুৎ দরকার আমরা দেব। টাকারও অসুবিধা নেই। শুধু বিষয়টি হচ্ছে ভারতের মাঝখান দিয়ে ট্রান্সমিশন লাইনটা। এটা আমরা ভারতের সঙ্গে আলাপ করে করব।
ড. ইউনূস: অন্তত হাইড্রো ইলেকট্রিসিটি আনা বা সোলার এনার্জি করার ব্যাপারে চীনের সঙ্গে ভারতের দ্বন্দ্ব হবে বলে মনে হয় না। এটা তো কারও বিপক্ষে যাচ্ছে না।
ড. ইউনূস: চিন্তাগুলো পরিষ্কার করতে হবে, নতুনভাবে চিন্তা করতে হবে। সেখানেও সংস্কার দরকার। আগের মতো করে একই ভঙ্গিতে চিন্তা করলে তো হবে না। আমরা ভারত থেকে বিদ্যুৎ আনছি না! তাহলে নেপাল থেকে আনলে সমস্যা কোথায়! এবং সেটা হাইড্রো। যেটার জন্য আমাদের পৃথিবী সর্বনাশ হয়ে যাবে!
আমি বারবার বলে যাচ্ছি, আমাদের তিন শূন্যের পৃথিবী গড়তে হবে। তিন শূন্যের পৃথিবী হলো সমাধান, এর আগে–পরে কোনো সমাধান নেই। জিরো নেট কার্বন এমিশন, জিরো ওয়েলথ কনজাম্পশন, জিরো আনএমপ্লয়মেন্ট। এই তিনটাকে সামনে রেখে আমাদের সব চিন্তাভাবনাকে সামনে আনতে হবে। আমাদের শুধু উন্নয়নের পেছনে ঘুরলে তো হবে না। আমাদের এটাকে সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে ফেলতে হবে। এটা উন্নয়নের মহাসড়ক নয়, এটা সামাজিক সমঝোতার মহাসড়ক। এই সামাজিক সমঝোতা এবং আবহাওয়ার সমঝোতা না হওয়া পর্যন্ত হবে না। এ জন্য নেট কার্বন এমিশন নাম্বার ওয়ানে। তারপর হবে জিরো ওয়েলথ কনজাম্পশন। সম্পদের সদ্ব্যবহার।
ড. ইউনূস: বার্তা হচ্ছে, তারা খুশি। আমি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে গিয়েছি। নতুন যে বাংলাদেশ হবে, সে ব্যাপারে তারা আনন্দিত। দুর্নীতিমুক্ত একটা দেশ হবে। সামাজিক দিক থেকে উন্নত একটা দেশ হবে। আমরা বলে এসেছি যে পরিবর্তন হবে, সংস্কার হবে। এই বার্তাগুলো তারা গ্রহণ করেছে। তারা বলেছে, তোমাদের যা যা সাহায্য করতে পারি, আমরা করব। কাজেই এটা একটা আশ্বাস পাওয়া গেছে। এবং দেখলাম যে এ ব্যাপারে তারা আগ্রহী। এটা এমন নয় যে কথাবার্তা বলে, দেওয়ার বেলায় কিছু পাইনি। আমরা দুটো বিষয়ে এমফেসাইজ করেছি জাতিসংঘে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা—যাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে, তাদের সবার সঙ্গেই। আমাদের বাংলাদেশের সঙ্গে আগে যেভাবে লেনদেন হতো, সেটার চিন্তা থেকে বের হয়ে যেতে হবে। এখন আমরা বড় আকারে যেতে চাই, বড় চিন্তার মধ্যে যেতে চাই। আমাদের আদান-প্রদান সেই প্ল্যাটফর্মের ওপর হতে হবে। প্রথমত, চিন্তাটা ভিন্ন করতে হবে। অতীতের চিন্তা, অতীতের ক্রমধারায় করলে হবে না। দ্বিতীয়ত দ্রুত করতে হবে। আমরা অন্তর্বর্তী সরকার যদি কাজ দেখাতে না পারি, তাহলে মানুষ উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। কাজেই তুমি যদি দিতে দিতে এমন সময় লাগালে, অন্তর্বর্তী সরকার চলে গেল, আরেকটা সরকার এসে কয়েক বছর কাটিয়ে গেল, তারপর এটা দেওয়া শুরু হলো, তখন এটা হয়তো কাজে লাগবে না। অতীত হয়ে গেছে। কাজেই মানুষের মধ্যে উৎসাহ থাকতে থাকতে টাকাটা দাও, যাতে আমরা কাজগুলো করতে পারি। বর্তমানে আমাদের অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়। কাজেই এটাকে সবল করতে হলে তোমাদের সাহায্য দরকার। কাজেই যে অর্থনীতি আছে, এটা ভাঙাচোরা আর লুটপাট করা অর্থনীতি। এই লুটপাট করা অর্থনীতিকে সোজা করতে হলে আমাদের সাহায্য দরকার। সেই জিনিসগুলো আমরা বারবার বলেছি।
ড. ইউনূস: সবার কাছ থেকে। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ, সবাই।
ড. ইউনূস: নিশ্চয়। জাতিসংঘে যে রকম উৎসাহ আমি দেখেছি, শুধু বড় রাষ্ট্রই নয়, ছোট রাষ্ট্র; আমাদের সার্কভুক্ত রাষ্ট্রগুলো প্রত্যেকের উৎসাহ। প্রত্যেকে বলেছে, আমরা আছি। কী করতে হবে আমাদের বলেন। ইতালির প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বললাম, কানাডার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বললাম, সবাই উৎসাহী।
ইতালির প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হলো। ইতালির প্রধানমন্ত্রী বললেন, তোমরা তো বাংলাদেশের মানুষ যথেষ্ট আসো, আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আমর লিগ্যাল ওয়েতে কীভাবে আনতে পারি সেটার জন্য চেস্টা করি। ইতালির রাষ্ট্রদূত আজ আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন, তিনিও বিষয়টি কীভাবে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কে নিয়ে আসা যায়, সে বিষয়ে কথা বলেছেন।
ড. ইউনূস: শুধু যদি গত ১৫ বছরই ধরি, আমরা তো শুধু দলাদলি শিখেছি, বিভক্তি শিখেছি, দূরত্বই শিখেছি। কে কাকে মারবে, কাটবে, কেড়ে নেবে, কাকে কত দূরে সরাবে; কাজেই সে সংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।
মিডিয়ার অধিকার রক্ষা করতে বলছেন, একইভাবে মানুষের অধিকার রক্ষার কথা বলব। মানুষ যেন কথা বলতে পারে। বলার অধিকার তার কাছ থেকে কে কেড়ে নেবে? মত ভিন্ন হতে পারে। ওই যে বললাম, আমরা একটি পরিবার। আমাদের মতের বিভেদ থাকতে পারে, আমরা কেউ কারও শত্রু নই। এই কথাটা যদি আমরা মনে রাখি, আমরা শত্রু নই।
আমরা যেকোনো উপলক্ষ বানিয়ে শত্রু বানিয়ে ফেলি। কীভাবে শত্রু বানাতে হয়, শত্রু বানানোর প্রক্রিয়াটাকে আমাদের আগের সরকার ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছে। আপনাকে শত্রু বানিয়েছে, আমাকে শত্রু বানিয়েছে, এখানে কতজনকে শত্রু বানিয়েছে, আপনি দেখেন। খালি শত্রু, শত্রু যে কঠিন শত্রু। এমন যে সে দেশের শত্রু, শুধু আমার শত্রু না; ওই ভঙ্গিতে নিয়ে গেছে। কাজেই ওই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আজকে সংস্কারের জন্য আমরা গলা ফাটাচ্ছি কেন? সেই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
ড. ইউনূস: আপনারা বলেন, আপনারা পত্রিকায় লেখেন। শুরু করেন, কথা বলেন। যদি এটা কাজে লাগে, একত্র করা, সবাই একমত হওয়া; একমত হওয়ার কাজে। একমত হতে হবে না, একত্র হতে হবে। মত যার যার হতে পারে। নানা মত থাকবে। বাপে ছেলের মতে বা মেয়ের মতে একমত হয় না, দেশের একমত কেমনে হবে? মত থাকবে, কিন্তু আমরা একমত হব।
ড. ইউনূস: আসতে পারে। আপনারা তাদের উৎসাহিত করুন।
ড. ইউনূস: ঐক্যের জন্য একটা বিষয় লাগে। কী নিয়ে ঐক্যটা সৃষ্টি হবে, সবাই যাতে মানে, এ জন্য আসে। অন্তর্বর্তী সরকারের ঐক্যটা এল সংস্কার থেকে। সংস্কার বিষয়ে যদি একমত হই, সেটা কিন্তু একটা মস্ত বড় ঐক্য। যত মত আছে, আমরা সংস্কারে একমত।
ড. ইউনূস: পরিবর্তন, আমরা অতীতে ফিরে যেতে চাই না। এটার চেয়ে বড় ঐক্য আর হতে পারে না। আমরা যদি এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারি, দেখবেন বাকি কাজটা সহজ হয়ে যাবে। ঠুনকো সংস্কার না, লোকদেখানো সংস্কার না, একদম ফান্ডামেন্টাল সংস্কার। এটা এমনভাবে করব আর কেউ পাল্টাতে পারবে না।
ড. ইউনূস: কী সুন্দর একটা ঐক্য হঠাৎ করে জমেছিল! পাথরের মতো সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ করে সব চুরমার হয়ে গেল। বলে যে আমরা এক।
ড. ইউনূস: অসম্ভব নয় তো! গত দুই মাস আগের ঘটনা তো। ঐক্য হলো তো। সারা দেশ এক হয়ে গেল। কোনো বিভেদ ছিল না। যে যত কথা বলে, ধর্মীয় পার্টি বলেন, বাম বলেন, ডান বলেন, মাঝ বলেন—সব এক। একটা ব্যাপারে একমত, আমরা এটা চাই না, পুরোনো অতীত শেষ।
ড. ইউনূস: সব, কেউই বাদ যায়নি। এই শক্তিটা যেন আমরা ভুলে না যাই। আমরা নানা কথার মধ্যে এগুলো ভুলে যাই। এই দুই মাসের মধ্যে আমরা ভুলে যেতে আরম্ভ করেছি। এটা যেন না হয়। এই সময়টাকে আমরা যেন রক্ষা করতে পারি। এই পিরিয়ডের ঐক্যটা এমনভাবে করব, যাতে তা স্থায়ী হয়ে যায়। যাতে করে ওই সংস্কারগুলোর মাধ্যমে একটা কাঠামোর রূপ আমরা দিতে পারি।
ড. ইউনূস: আমার একটাই কথা—সংস্কার, সংস্কার, সংস্কার। সংস্কারের জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ হোন। এই সুযোগ আর আসবে না। প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান মুহূর্ত। কাজেই এটা নিয়ে দ্বন্দ্বের মধ্যে যাবেন না। সংস্কারে কী কী বিষয় হবে, সেটা নিয়ে বাগ্বিতণ্ডা করেন। কিন্তু সংস্কার, এটা করে যেতে হবে। দুই দিন পর যদি বলেন সংস্কার বাদ দেন, আমরা নির্বাচন করে চলে যাই—ওটা যেন না হয়। সংস্কার না করে যেন নির্বাচন না করি। এটা আপনাদের সবার কাছে আমার আবেদন। এই সুযোগ হারাবেন না।
source : প্রথম আলো