সংবিধান ও ক্ষমতার ভারসাম্য

Daily Nayadiganta

সংবিধান ও ক্ষমতার ভারসাম্য – নয়া দিগন্ত

‘অক্সফোর্ড ডিকশনারি অব পলিটিক্স’-এ সংবিধানকে একটি জাতির শাসনব্যবস্থার মৌলিক নীতিমালা বলা হয়েছে। টমাস পেইন তার সংজ্ঞায় এক্ষেত্রে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সম্পৃক্ততার ওপর জোর দিয়েছেন। অপরদিকে এস ই ফাইনার বলেন, ‘সংবিধান হচ্ছে রাষ্ট্রক্ষমতার সম্পর্ক বিন্যাসের আত্মবিবৃতি’। সমসাময়িক পৃথিবীতে সংবিধান পর্যালোচনায় রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অঙ্গসংগঠন ও ক্ষমতাধারীদের পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়টি ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। পৃথিবী যতটা এগিয়ে চলেছে ততটাই বাড়ছে জনগণের সচেতনতা। রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনা, নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ এবং বিকেন্দ্রীকরণের মতো জনপ্রিয় বিষয়গুলোর মোকাবেলায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সংবিধানের চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন। এসব বিশ্লেষণে সংবিধান ও ক্ষমতার ভারসাম্যের বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। সরকার ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন। আর জনগণের প্রত্যাশা হচ্ছে ক্ষমতার স্বাতন্ত্রীকরণ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বিশ্লেষণেও একই প্রবণতার প্রমাণ মিলবে।

বাংলাদেশ তার আবির্ভাবের স্বল্পকালীন সময়ের মধ্যে সর্বতোভাবে নাগরিক অধিকার সংবলিত একটি চমৎকার সংবিধান লাভ করে। কিন্তু যারা এর প্রণেতা তারাই এর সর্বনাশ সাধন করেন। গত ৫০ বছরে কাঙ্ক্ষিত ও অনাকাক্সিক্ষতভাবে ১৭ বার পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংশোধনের পর এর মৌলিকত্ব বলতে কিছুই নেই। অবস্থা দাঁড়িয়েছে, সিরাজউদদৌলা নাটকে ভাঁড় গোলাম হোসেনের পোশাকের মতো। গায়ে এক দিকে কোট অপর দিকে চাপকান। নিচে ধুতি আর পাজামা। কিম্ভূতকিমাকার চানাচুরওয়ালার পোশাকের মতো।

সংসদীয় সরকার, বাকশাল, সামরিক শাসন, রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা, আবার রাষ্ট্রধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতার সমান্তরাল অবস্থান, সবমিলিয়ে সংবিধান তার মৌলিকত্ব ও ক্ষমতার ভারসাম্য দুটোই হারিয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন সময়ের সরকারগুলো তাদের সুযোগ-সুবিধা মোতাবেক সংবিধানের অদলবদল করেছে কিন্তু জনগণের ভাগ্য বদল হয়নি। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র এই সময়ে এমন একটি পর্যায় অতিক্রম করছে যেখানে সংবিধানিক প্রথা-প্রতিষ্ঠান ও মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়েছে।

মূল সংবিধান প্রথমবারের মতো সঙ্কটের মোকাবেলা করে তখনই, যখন এর মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলোর অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটিয়ে একদলীয় বাকশাল কায়েম করা হয়। পরবর্তী সামরিক শাসনামল দুটোতেই এর পরিবর্তন ঘটে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, ১৯৯০-২০ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক সময়কালের সমীক্ষা। এ সময় সংবিধানের সংশোধনী যেমন হয়েছে তেমনি হয়েছে সর্বনাশ। সংবিধান রীতিমতো অকার্যকর হয়ে পড়েছে। নাগরিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। বিরোধী দল ও মতকে ভূলুণ্ঠিত করার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়ন করে মানবাধিকার দলিত করা হয়েছে। খুন, গুম, হামলা-মামলা দিয়ে গোটা দেশকে রীতিমতো জেলখানায় পরিণত করা হয়েছে। রাজনৈতিক প্রথা-প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। আইনসভাকে রাবার স্ট্যাম্পে পরিণত করা হয়েছে। আমলাতন্ত্র দলতন্ত্রে পর্যবসিত হয়েছে। বিচারব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে দলীয় প্রতিষ্ঠানের রূপ নিতে দেখা গেছে। সবচেয়ে বড় সর্বনাশ হয়েছে যে ক্ষেত্রে, তা হলো, নির্বাচন ব্যবস্থা। ইউনিয়ন কাউন্সিল থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত সবগুলোই গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। নির্বাচনকে জনগণের ভোটাধিকারবিহীন এক তামাশায় পরিণত করা হয়েছে। এ অবস্থায় নাগরিক সাধারণ স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন করতে গিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ভিন্নমত পোষণ একরকম অসম্ভব হয়ে উঠেছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে যতই দিন গেছে ততই যেন ক্ষমতার রাহু গ্রাস করেছে পূর্ণ সূর্যকে। এখনকার অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বুদ্ধিজীবীরা অসহায় অবস্থা ও শ^াসরুদ্ধকর পরিস্থিতির কথা বলছেন। তবে এই কঠিন সময়কালেও দেশের বরেণ্য ব্যক্তিরা তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর ১৫১ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যখন অনির্বাচিত সরকার এক বছর অতিক্রম করে, তখন সিভিল সোসাইটি ‘উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজ’-এর পক্ষ থেকে প্রতিবাদের চেষ্টা করে। ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি ঢাকার ব্র্যাক সেন্টারে এক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়। ‘পূর্ণ গণতন্ত্রের জন্য ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য’ শীর্ষক ওই সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা। গোলটেবিল বৈঠকে উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হয়। বুদ্ধিজীবীরা এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায়ও বাতলে দেয়ার চেষ্টা করেন। তারা মনে করেন, রাষ্ট্র ও সরকারে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার কারণে কর্তৃত্বমূলক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা গোলটেবিল বৈঠকে বলেন, ‘যে সরকারই ক্ষমতায় আসছে তারা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে নজর দিচ্ছে না। গত কয়েকটি সরকারের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এসব সরকার যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নির্বাচনকে প্রধান্য দিয়েছে।’ অস্থায়ী নয় বরং টেকসই সমাধানের দিকে যেতে হবে উল্লেøখ করে তিনি সংবিধানের কিছু কিছু ক্ষেত্রে ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারের প্রয়োজনের কথা বলেন। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, ‘সংবিধানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত। তিনি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া সব ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিতে বাধ্য থাকেন।’ তার প্রশ্ন, যেখানে রাষ্ট্রপতির চাকরি নির্ভর করে প্রধানমন্ত্রীর ওপর। সেখানে রাষ্ট্রপতিকে প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগের ক্ষমতা দিয়ে লাভ কী? তিনি বৃহত্তর ইলেকটোরাল কলেজ ব্যবহার করে রাষ্ট্রপতি পদে সরাসরি নির্বাচন আয়োজন এবং রাষ্ট্রপতির ওপর অধিক ক্ষমতা ন্যস্ত করার প্রস্তাব করেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক রওনক জাহান বলেন, ‘১৯৯১ পরবর্তী অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর যে ক্ষমতা দেয়া আছে, তার চর্চা বা প্রয়োগ হচ্ছে না। তাই জাতীয় সংসদ ক্ষমতার ভারসাম্য ও নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি বড় জায়গা হলেও বিরোধী দল সংসদে যথার্থ ভূমিকা রাখছে না।’ বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির পদটি এখন অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে।’ তিনি ক্ষমতার ভারসাম্য বিধানের পরামর্শ দেন। এ বৈঠকে অংশগ্রহণকারী বিশিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং গণতন্ত্রের স্বার্থে সংবিধান সংশোধন হওয়া জরুরি। বিগত সময়গুলোতে এভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও দেশের সচেতন নাগরিক শ্রেণী সময়ে সময়ে সভা-সমিতি ও সেমিনার করে জাতির এই অস্বাভাবিক অবস্থা বোঝাতে চেয়েছেন।

একদল সচেতন নাগরিক ‘রাষ্ট্রচিন্তা’ ব্যানারে এই দুর্ভোগের উৎসমূল সন্ধানের চেষ্টা করে। ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধান ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে তারা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন পেশ করে ‘বাংলাদেশের সংবিধান পর্যালোচনা’ পুস্তকে। তারা খোদ সংবিধানে ‘অন্তর্নিহিত বৈপরীত্য’র সন্ধান পান। তাদের বিশ্লেষণে দেখা যায়, ক্ষমতার মালিক জনগণ। তবে প্রয়োগের মালিক প্রধানমন্ত্রী। সংবিধানের প্রথম অধ্যায়ের অনুচ্ছেদ ৭(১) বলা হয়েছে- ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ।’ অথচ অনুচ্ছেদ ৪৮(৩) এ বলা হয়েছে- ‘কেবল প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।’ তারা দেখান যে, ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তাও আসলে কথার মারপ্যাচ। এ ক্ষমতাও তার নয়, এ ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের। ৫৬(৩) বলছে- ‘যে সংসদ সদস্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন বলিয়া রাষ্ট্রপতির নিকট প্রতীয়মান হইবেন, রাষ্ট্রপতি তাহাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করিবেন।’ এতে বোঝা যায়, প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া ছাড়া অন্য কোনো ক্ষমতাই সংবিধান রাষ্ট্রপতির জন্য বরাদ্দ করেনি। তারা মনে করেন, সংবিধান দৃশ্যত প্রধানমন্ত্রীর জন্য যতটুকু ক্ষমতা বরাদ্দ করেছে বলে মনে হয়, অনুচ্ছেদ ৪৮(৩)-এর বদৌলতে তিনি তার চেয়ে অনেক বেশি ভোগ করার অধিকারী। নির্বাহী বিভাগের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ হলো মন্ত্রিপরিষদ সংক্রান্ত। এখানে এসে সংবিধান মূলত রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রযুক্ত যাবতীয় ক্ষমতা এবং তার বাইরে যা কিছু নির্বাহী ক্ষমতা রয়েছে তার সবটুকুই প্রয়োগের ক্ষমতা তুলে দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর হাতে। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী নিয়োগ ও নিয়োগের অবসান, মন্ত্রিসভার আকার-আয়তন তার সবকিছুই প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ারাধীন। অনুচ্ছেদ ৫৫(৩) অনুযায়ী যদিও মন্ত্রিপরিষদ যৌথভাবে সংসদের কাছে দায়ী থাকার কথা, কিন্তু অনুচ্ছেদ ৭০ দেখলেই বোঝা যায়, গোটা সংসদই দলীয় প্রধানের কাছেই শুধু দায়বদ্ধই নয়, একান্ত অনুগত ও বাধ্যগত হতে সংবিধান অনুযায়ী বাধ্য। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী সংসদকে যখন যে ধরনের আইন প্রণয়নের নির্দেশ দেবেন জাতীয় সংসদ তখন সেই ধরনের আইন প্রণয়ন করতে বাধ্য। কারণ, অনুচ্ছেদ ৭০ অনুযায়ী- কোনো সংসদ সদস্য যদি তার নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেয় তাহলে সংবিধান অনুযায়ী তার সদস্যপদ বিলুপ্ত হবে। রাষ্ট্রচিন্তা গ্রুপ মন্তব্য করে যে, অনুচ্ছেদ ৭০-এর সাথে ১৪২ মিলিয়ে পড়লে দেখা যাবে, যিনি প্রধানমন্ত্রী তিনি যদি দলীয় প্রধান হন আর তার দল যদি জাতীয় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেন তাহলে তিনি সংবিধান সংশোধনের এমন অপরিমেয় ক্ষমতা ভোগ করবেন যে, পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক দেশের প্রধানমন্ত্রী কল্পনাও করতে পারেন না। রাষ্ট্রচিন্তা গ্রুপের এই মন্তব্যের বাস্তব প্রমাণ মেলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলে ক্ষমতাসীন সরকারের সিদ্ধান্ত থেকে। এটা বিস্ময়ের ব্যাপার যে, যে রাজনৈতিক দলটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা চালায় তারাই ক্ষমতাসীন হয়ে সে ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। কারণ তারা নির্বাচনগুলো পর্যালোচনা করে বুঝতে পারে, জনগণের ভোটে আর কখনোই তাদের ক্ষমতায় ফিরে আসা সম্ভব নয়। উল্লেখ্য, প্রথম জাতীয় সংসদে চতুর্থ সংশোধনী একইভাবে কার্যকর করা হয়। বাকশাল সংশোধনীতে এ কথা বলা হয়, ‘এই সংবিধান বা ইহার কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকদের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ নিলে- তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে।’ ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনী বিলে অনুরূপ ধারা সংযোজন করা হয়েছে। রাষ্ট্রচিন্তা গ্রুপ মনে করে, ১৯৭২-এর সংবিধান একজন প্রধানমন্ত্রীর কাছে যে ক্ষমতা অর্পণ করেছে পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক সংবিধান তো দূরের কথা, অগণতান্ত্রিক সেনাশাসকদের কাছেও এই পরিমাণ ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার নজির নেই। রাষ্ট্রচিন্তা গ্রুপ সংবিধানের পরবর্তী অধ্যায়গুলো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে এটা প্রমাণ করার প্রয়াস পায় যে, আসলে সংবিধান ব্যক্তি ও অন্যান্য বিধিবিধানের কাছে বন্দী। এভাবে বর্ণিত মৌলিক অধিকারগুলো আইনের মারপ্যাঁচে প্রয়োগযোগ্য নয়। যদি, তবে, কিন্তু, সাপেক্ষে- ইত্যাদি শব্দের মারপ্যাঁচে মৌলিক অধিকারগুলো অস্বীকার করা হয়েছে। ব্যক্তির অধিকার সংরক্ষণে খুব শক্ত কথা বলা হলেও আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীতে ৩৩ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বলে যে, যদি কাউকে নিবর্তনমূলক আইনে আটক করা হয় তাহলে তার ক্ষেত্রে অনুচ্ছেদ ৩৩ প্রযোজ্য হবে না। আর এ সংশোধনীর পরে যখন স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট ১৯৭৪ প্রণয়ন করা হয় তখন এই আইন যতই মৌলিক অধিকার পরিপন্থী হোক না কেন, অনুচ্ছেদ ২৬ কিংবা অনুচ্ছেদ ৩৩ কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। এভাবে সংবিধানের বিচার-বিশ্লেষণ করে রাষ্ট্রচিন্তা গ্রুপ দেখায় যে- স্বাধীন বিচার বিভাগ আসলে স্বাধীন নয়। তারা নির্বাহী বিভাগ ও প্রচলিত আইনের দ্বারা পরাধীন। এভাবে রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও প্রকারান্তরে প্রধানমন্ত্রীর অধীন। এই গ্রুপের বিশ্লেষণে দেখা যায়, পঞ্চদশ সংশোধনী জাতির সাংবিধানিক সঙ্কটকে আবার প্রকট করে তুলেছে।

এই সঙ্কট থেকে মুক্তির জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানীসহ দেশের সিভিল সোসাইটি ক্ষমতার ভারসাম্যের কথা বলেছেন। প্রয়াত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর এমাজউদ্দিন বলেন, ‘বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া জরুরি।’ তিনি তার বিশ্লেষণে বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বলা যায় মন্ত্রিপরিষদে তিনি স্থাপত্যের প্রধান প্রস্তর।’ তিনি মন্তব্য করেন, ৭০ অনুচ্ছেদের ভীতির কারণে কোনো সংসদ সদস্য প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে মুখ খুলতে পারেন না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক কালচার এবং ৭০ ধারার মতো বাধ্যবাধকতার কারণে প্রধানমন্ত্রী সাংবিধানিক ক্ষমতাকে ‘পারসোনালাইজড পাওয়ার’ বা ব্যক্তিগত ক্ষমতায় রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব সচিবালয় রয়েছে। এক অর্থে এটি সুপার সচিবালয়। কেননা, এর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী সব মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের শুধু সমন্বয় করেন না, নিয়ন্ত্রণও করেন। পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী সংসদের মাধ্যমে বিচার বিভাগকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।

আজকের অবস্থা বিশ্লেষণ করে সবাই একমত হবেন যে, এ অবস্থা কারো কাম্য হতে পারে না। তাই ক্ষমতার ভারসাম্য দরকার। মনীষী প্লেটো প্রথমত তার বিশ^ বিখ্যাত গ্রন্থ ‘রিপাবলিক’এ মানুষের জ্ঞান-গরিমা ও বিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করেছেন। তিনি চেয়েছেন দার্শনিকের শাসন। পরে আরো পরিণত বয়সেই তিনি উপলব্ধি করেন বিজ্ঞতার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু শুধু বিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করলে চলবে না। অবশেষে তিনি লিখলেন আরেকটি কালজয়ী গ্রন্থ ‘দ্য লস’। বিজ্ঞতাকেও আইনে সমর্পিত হতে হয়। মানুষ হিসেবে কেউই ভুল, ত্রুটি ও মানবিক দুর্বলতার ঊর্ধ্বে নয়। আর সেই প্রচলিত কথাটি তো সত্য যে, ‘এবসোল্যুট পাওয়ার করাপ্টস এবসোল্যুটলি’। সুতরাং বাংলাদেশের জন্য কাক্সিক্ষত ক্ষমতার ভারসাম্যের জন্য সংবিধান সংশোধনসহ আর কী করা যেতে পারে সে বিষয়ে নাগরিক সাধারণের ভাবনা, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]