করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে গণপরিবহন বন্ধ ঘোষণার পর কর্মহীন হয়ে পড়েছেন দেশের সড়ক পথের পরিবহন শ্রমিকরা। দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কাজ করা এই শ্রমিকদের পরিবার নিয়ে এখন অনাহারে-অর্ধাহারে কাটছে দিন। তারা বলছেন, শ্রমিকদের নিয়ে রাজনীতি করে সরকারের ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ হয়ে ওঠা এ সেক্টরের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা শাজাহান খান ও মসিউর রহমান রাঙ্গাও তাদের কোনও খোঁজ নিচ্ছেন না। করোনার এই সংকটকালে শ্রমিকদের নিয়ে তাদের কোনও কর্মকাণ্ডও দেখা যাচ্ছে না।
শ্রমিকদের অভিযোগ, এই দুর্দিনে নেতাদের কেউই তাদের পাশে নেই। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার তুলে দিতে পারছেন না তারা। তবে এই দুই নেতার নেতৃত্বাধীন সংগঠনগুলো বলছে, তারা নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী শ্রমিকদের সহযোগিতা করে আসছেন।
জানা গেছে, বর্তমানে দেশের পরিবহন সেক্টরের সঙ্গে ৭০ লাখের বেশি শ্রমিকের রুটি রোজগার জড়িত। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রভাবে পরিবহন চলাচল বন্ধ ঘোষণার পর এসব শ্রমিক কার্যত বেকার হয়ে পড়েছেন। শ্রমিকরা বলছেন, তাদের কল্যাণ তহবিলের নামে প্রতিদিন যে অর্থ আদায় করা হয়, সেই টাকার সামান্য অংশও যদি তাদের জন্য ব্যয় করা হতো, তাহলে শ্রমিকরা উপকৃত হতো।
পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালিত দেশের প্রতিটি যানবাহন থেকে দৈনিক ঘোষিত ৭০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হয়। কিন্তু মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নামে আদায় করা এই টাকা শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয় হচ্ছে না। যদিও সংগঠনগুলোর দাবি, আদায় করা তহবিল থেকে এখন শ্রমিকদের কল্যাণে অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে।
রাজধানীতে দৈনিক ভিত্তিতে একাধিক পরিবহনে চাকরি করতেন গাড়িচালক ইসরাফিল হোসেন। তিনি জানান, ‘গত ২৬ মার্চ থেকে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে তার চাকরি নেই। কোনও মালিক ও শ্রমিক সংগঠন তার খোঁজ-খবর নেয়নি। এ কারণে ছয় সদস্যের পরিবার নিয়ে এখন তিনি বিপদে রয়েছেন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সভাপতি মো. হানিফ খোকন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে কল্যাণ তহবিলের নামে মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো হাজার হাজার কোটি টাকা চাঁদা আদায় করেছে। কিন্তু আজ করোনার এই দুর্দিনে তারা শ্রমিকদের পাশে নেই। সরকারের উচিত হবে এসব নেতার সম্পদের হিসাব নিয়ে এই টাকা কোথায় গিয়েছে তা বের করা।’
পরিবহন শ্রমিকদের অভিযোগের বিষয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে তার সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সারা দেশের শ্রমিকরা এখন খুবই কষ্টে রয়েছে। আমরা বিভিন্ন জেলায় প্রশাসনের কাছে চাই এক টাকা, তারা দেয় চার পয়সা। প্রধানমন্ত্রী প্রথমদিকে বলেছিলেন শ্রমিকদের ত্রাণ দেবেন। তখন কিছু কিছু জেলার প্রশাসন থেকে ১ হাজার জনের ত্রাণ চাইলে তারা ৩০০ জনের ত্রাণ দিতো। এখন তাও দেওয়া হয় না।’
তাকে ও তার সংগঠনের সিনিয়র নেতাদের এই দুর্যোগের সময় শ্রমিকরা পাশে পাচ্ছেন না—এমন অভিযোগের বিষয়ে এই পরিবহন নেতা বলেন, ‘আমাদের কল্যাণ তহবিলে যে টাকা ছিল, সেই তহবিল থেকে এতদিন চালিয়ে এসেছি। ঢাকার বিভিন্ন টার্মিনালে আমরা প্রতি ১০ দিন পর পর প্রত্যেক শ্রমিককে ১০ কেজি চাল, ২ কেজি আলু, ২ কেজি ডালসহ অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী দিয়েছি। সায়েদাবাদে রান্না করা খাবার দিয়েছি। এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। আমরা প্রতিদিনই শ্রমিকদের খোঁজ-খবর নিচ্ছি। তাদের খোঁজ-খবর নিতে সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। তাদের জন্য আমার ফোন নম্বর সব সময় খোলা। আমাদের সিনিয়র নেতারাও চেষ্টা করছেন।’
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, দেশে নিবন্ধিত যানবাহন আছে প্রায় ৪৪ লাখ। এরমধ্যে ৮ লাখের বেশি বাণিজ্যিক যানবাহন। এসব যান চালনার সঙ্গে যুক্ত আছেন প্রায় ৭০ লাখ শ্রমিক। এরমধ্যে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত রেজিস্টার্ড শ্রমিকের সংখ্যা ৫০ লাখ। এর বাইরে আরও ২০ লাখ শ্রমিক বিভিন্ন ছোটখাটো পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। আবার কেউ কেউ আছেন, যারা পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তারা এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নন।
২৬ মার্চ থেকে সারা দেশে সড়কে পরিবহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। এরপর থেকেই এই সেক্টরের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় শ্রমিকদের জন্য সরকারের বিশেষ প্রণোদনা চেয়েছেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব ও সংসদ সদস্য মসিউর রহমান রাঙ্গার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। গত ৮ এপ্রিল সংগঠনটির সভাপতি রাঙ্গা ও মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ এক যৌথ বিবৃতিতে এই দাবি জানান।
বিবৃতিতে বলা হয়, পরিবহন সেক্টরে থাকা চালক-শ্রমিকরা লকডাউনের কারণে দীর্ঘদিন ধরে কর্মহীন। যারা দৈনিক বেতনের ভিত্তিতে কাজ করেন, তারা পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। দেশের ইতিহাসের এই দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে অসহায় শ্রমিক পরিবারগুলোর প্রতি সহায়তার হাত বাড়ানো জরুরি।
এতে আরও বলা হয়, পরিবহন সেক্টর বন্ধ থাকলে দৈনিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। এই বিশাল ক্ষতির কথা বিবেচনা করে এই সেক্টরের মালিক-শ্রমিকদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা দিতে সরকারের কাছে অনুরোধ করা হচ্ছে। বিবৃতিতে পরিবহন খাতের কর্মহীন শ্রমিকদের বাঁচাতে পরিবহন সেক্টরের মালিকদের প্রতিও আহ্বান জানানো হয়।
শ্রমিকদের সংকট ও অভিযোগের বিষয়ে মসিউর রহমান রাঙ্গা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি তো শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করি না। আমি পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি। শ্রমিকদের জন্য শাজাহান খান আছেন। তিনি কাজ করবেন। মালিক হিসেবে আমার শ্রমিকদের জন্য যা যা করার দরকার, তা আমি করেছি। তাদের বেতন-ভাতা যা দেওয়ার তা দিয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি হিসেবে তাদের জন্য যা কিছু করা দরকার, সেটা আমি করবো।’