শেয়ারবাজার: নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিশেষ সুবিধা নিয়ে লিগেসির শেয়ারে বড় কেলেঙ্কারি

শেয়ারবাজার
শেয়ারবাজারগ্রাফিকস: প্রথম আলো

ব্যাংক ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) দেওয়া বিশেষ সুবিধায় শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত লিগেসি ফুটওয়্যারের শেয়ারের বড় ধরনের অনিয়ম ও কারসাজির ঘটনা ঘটেছে। আর অনিয়ম ও কারসাজির বড় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থার এই ‘বিশেষ সুবিধা’।

কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে অনিয়ম ও কারসাজিতে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন গুটিকয় উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারী। আর বেশির ভাগ সাধারণ বিনিয়োগকারী বঞ্চিত হয়েছেন তাঁদের প্রাপ্য সুবিধা থেকে।

গত ছয় মাসে শেয়ারবাজারে যেসব কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে, তার মধ্যে লিগেসি ফুটওয়্যার অন্যতম। মাত্র ছয় মাসে কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের বাজারমূল্য বেড়েছে ১৩৯ শতাংশ বা ৬৬ টাকার বেশি। গত ১৩ মার্চ কোম্পানিটির শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ৪৭ টাকা ৭০ পয়সা। গতকাল মঙ্গলবার দিন শেষে সেই দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৩ টাকা ৫০ পয়সায়।

লিগেসি ফুটওয়্যারের বর্তমান পরিশোধিত মূলধন ১৩ কোটি টাকা। ২০২১ সালে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির এক নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, শেয়ারবাজারের মূল বোর্ডে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ৩০ কোটি টাকার কম থাকতে পারবে না। সেই নির্দেশনা পরিপালনে নতুন শেয়ার ইস্যু করে মূলধন বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় লিগেসি ফুটওয়্যার। লিগেসি ফুটওয়্যারের এ উদ্যোগ ছিল অভিনব।

নিয়ম অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত কোম্পানির মূলধন বৃদ্ধির কয়েকটি উপায় আছে। তার মধ্যে রয়েছে অধিকারমূলক বা রাইট শেয়ার ইস্যু, পুনঃ প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা রিপিট আইপিও বা প্রাইভেট প্লেসমেন্ট ব্যবস্থা। এসব ব্যবস্থার মধ্যে রাইট শেয়ার ও রিপিট আইপিওর ক্ষেত্রে সব শেয়ারধারীর বিপরীতে সমানুপাতিক শেয়ার ইস্যু করতে হয়। এর বাইরে প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে পছন্দের লোকের বিপরীতে নতুন শেয়ার ইস্যু করেও মূলধন বাড়ানো যায়। লিগেসি ফুটওয়্যার শেষের পথটি বেছে নেয়। কোম্পানিটি মোট ১৭ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে নতুন করে ৩ কোটি শেয়ার ছেড়ে ৩০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। যার মধ্যে কোম্পানির তিনজন উদ্যোক্তা-পরিচালক রয়েছেন। বাকি ১৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কোম্পানির বিশেষ পছন্দের।

বাজারে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বেড়ে ১১৩ টাকায় উঠলেও প্লেসমেন্টে প্রতিটি শেয়ার ইস্যু করা হয়েছে মাত্র ১০ টাকা ফেসভ্যালু বা অভিহিত মূল্যে। গতকালের দাম অনুযায়ী, এসব শেয়ারের বাজারমূল্য হওয়া উচিত ৩৩৯ কোটি টাকা। তবে ৩৩৯ কোটি টাকার শেয়ার ১৭ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পাচ্ছে মাত্র ৩০ কোটি টাকার বিনিময়ে।

তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে প্লেসমেন্টের মাধ্যমে শেয়ার ইস্যুর সিদ্ধান্ত কেন দেওয়া হলো জানতে চাইলে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, কোম্পানিটি লোকসানি একটি প্রতিষ্ঠান। অর্থাভাবে ব্যবসা চালাতে পারছিল না। আইনি শর্ত মেনে রাইট শেয়ার বা রিপিট আইপিওর মাধ্যমে নতুন শেয়ার ছাড়াও সম্ভব হচ্ছিল না। আবার ঋণ খেলাপি হওয়ায় নতুন করে ব্যাংকঋণও পাচ্ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে কোম্পানিটি অর্থের সংস্থান করতে প্রাইভেট প্লেসমেন্টে শেয়ার ইস্যুর সিদ্ধান্ত নেয়। আইনি শর্ত পরিপালন করায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেটির অনুমোদন দিয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উদ্দেশ্য ছিল লোকসানি কোম্পানিটি যদি ব্যবসায় ফিরতে পারে, তাতে বিনিয়োগকারীরাই লাভবান হবেন।

যেভাবে কারসাজি

মূলধন বাড়াতে কোম্পানিটিকে প্লেসমেন্টের মাধ্যমে নতুন শেয়ার ইস্যুর অনুমোদন দেওয়া হয় গত এপ্রিলে। এ জন্য অনুমোদন চেয়ে মার্চে কোম্পানিটির পক্ষ থেকে বিএসইসিতে আবেদন করা হয়। প্লেসমেন্টে শেয়ার ইস্যুর আবেদনের পর থেকে বাজারে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম হু হু করে বাড়তে শুরু করে। এর মধ্যে কোম্পানিটি রূপালী ব্যাংকের কাছে ঋণের সুদ মওকুফেরও আবেদন করে।

৭ সেপ্টেম্বর লিগেসি ফুটওয়্যার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের জানায়, কোম্পানিটি রূপালী ব্যাংকের রমনা করপোরেট শাখা থেকে তাদের প্রায় সাড়ে ৩১ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে প্রায় ২০ কোটি টাকার সুদ মওকুফের সুবিধা পেয়েছে। এখন সাড়ে ১১ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করেই কোম্পানিটির ব্যাংকঋণের দায় থেকে মুক্ত হয়ে যাবে।

লিগেসি ফুটওয়্যার দীর্ঘদিন ধরে রূপালী ব্যাংকের খেলাপি গ্রাহক ছিল। খেলাপি গ্রাহকদের ক্ষেত্রে এককালীন পরিশোধের শর্তে সুদ মওকুফের বিশেষ সুবিধা রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। লিগেসি ফুটওয়্যারের আবেদনের ভিত্তিতে রূপালী ব্যাংক এককালীন অর্থ পরিশোধের শর্তে ২০ কোটি টাকার বেশি সুদ মওকুফ করে। জানা গেছে, লিগেসি ফুটওয়্যার প্লেসমেন্টে তাদের পছন্দের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে যে মূলধন সংগ্রহ করছে, তা থেকে ঋণের বাকি অর্থ পরিশোধ করবে। বাকি অর্থ চলতি মূলধন হিসেবে ব্যবহার করা হবে।

সুদ মওকুফের আনুষ্ঠানিক তথ্য ডিএসইর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের জানানোর আগে এ-সংক্রান্ত তথ্য বাজারে ঘুরছিল, যা কোম্পানিটির শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে কারসাজিকারকেরা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। শেয়ারবাজারে এ ধরনের খবর মূল্য সংবেদনশীল তথ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। এসব তথ্য আগাম জেনে কারসাজিকারকেরা সাধারণত শেয়ারের দাম বাড়ানোর কাজে লাগান। অনেক সময় কোম্পানির উদ্যোক্তারাও আড়ালে থেকে শেয়ারের দাম বাড়ানোর স্বার্থে কারসাজির সঙ্গে জড়িত থাকেন।

যাঁরা পেলেন প্লেসমেন্ট শেয়ার

আইনি সুযোগ থাকলেও সাধারণত তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে প্লেসমেন্টের মাধ্যমে শেয়ার ইস্যুর বিষয়টিকে নিরুৎসাহিত করা হয়। কারণ, তাতে গুটিকয় লোকের লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকলেও বেশির ভাগ বিনিয়োগকারীর স্বার্থহানি হয়। কিন্তু বিএসইসি দুর্বল মানের এ কোম্পানিকে বিশেষ আইনি এ সুবিধা দেয়। এ কারণে কোম্পানিটির শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হয়।

প্রাইভেট প্লেসমেন্টে লিগেসি ফুটওয়্যারের শেয়ার যাঁরা পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে তিনজন কোম্পানিটির উদ্যোক্তা পরিচালক। এ ছাড়া কোম্পানিটির স্বার্থসংশ্লিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান হলো কাজী রাফি আহমেদ, কাজী আজিজ আহমেদ, কাজী নাফিস আহমেদ ও এম কে ফুটওয়্যার। এঁদের মধ্যে কাজী রাফি আহমেদ কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

এঁদের বাইরে অন্য যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান শেয়ার পেয়েছে তার মধ্যে রয়েছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত অপর কোম্পানি সি-পার্ল বিচ রিসোর্ট, হোটেলটির মালিক আমিনুল হক, রিভারস্টোন, এনএসআরএ ইকুইটিস, এনএএসসিএফএস ইকুইটিস, নিরোদ বড়ুয়া, এসএএম ইকুইটিস, হায়াত ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, হাবিব এন্টারপ্রাইজ, শিরিনতা সাবরিন চৌধুরী, লামিম এন্টারপ্রাইজ, আহমেদ ফারাবী চৌধুরী ও টিএস ইকুইটি অ্যান্ড ভেঞ্চারস লিমিটেড। এর মধ্যে আহমেদ ফারাবী চৌধুরী ও টিএস ইকুইটি অ্যান্ড ভেঞ্চারসের ঠিকানা একই। তাই বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধারণা, উল্লিখিত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট।

ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন বিনিয়োগকারীরা

লিগেসি ফুটওয়্যারের এ ঘটনায় কোম্পানিটির সাধারণ বিনিয়োগকারীরা দুইভাবে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন। প্রথমত, সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বাজারমূল্যে কোম্পানিটির শেয়ার কিনলেও গুটিকয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে মাত্র ১০ টাকা মূল্যে ৩ কোটি শেয়ার ইস্যু করা হচ্ছে। তারা এসব শেয়ার বিক্রি করে পরবর্তী সময়ে বেশি লাভবান হবেন। যদিও প্লেসমেন্টে ইস্যু করা শেয়ারে ন্যূনতম এক বছরের বিক্রয় নিষেধাজ্ঞা বা লকইন থাকছে।
দ্বিতীয়ত, সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন দাম সমন্বয়ের কারণে। নিয়ম অনুযায়ী, যখন কোনো তালিকাভুক্ত কোম্পানি বিদ্যমান শেয়ারের বাইরে নতুন শেয়ার ইস্যু করে, তখন সেই অনুপাত বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট কোম্পানির শেয়ারের বাজারমূল্য সমন্বয় হয়। তাতে শেয়ারের বাজারমূল্য কমে যায়।

উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, কোনো একটি কোম্পানির শেয়ারের বাজারমূল্য ১০০ টাকা। বাজারে কোম্পানিটির শেয়ার রয়েছে ১০টি। এখন নতুন করে কোম্পানিটি আরও ১০টি শেয়ার ইস্যু করল। তাহলে স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ ওই শেয়ারের বাজারমূল্য সমন্বয় করবে। তাতে শেয়ারের বাজারমূল্য কমে দাঁড়াবে ৫০ টাকা। লিগেসি ফুটওয়্যারের শেয়ারের বাজারমূল্যও সমন্বয় করা হবে। সাধারণত রেকর্ড তারিখের পর দাম সমন্বয় করা হয়।

এখানে বিষয়টি হচ্ছে, সাধারণ বিনিয়োগকারীরা যাঁরা বর্তমানে ১১৩ টাকায় কোম্পানিটির শেয়ার কিনবেন, তাঁরা নতুন করে ইস্যু করা শেয়ার পাবেন না। কিন্তু ওই সব শেয়ারের কারণে শেয়ারের বাজারমূল্য সমন্বয় হলে তাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

বিশেষ সুবিধায় প্লেসমেন্টে শেয়ার ইস্যু, ব্যাংকের সুদ মওকুফ ও শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে জানতে ডিএসইর ওয়েবসাইটে দেওয়া লিগেসির কোম্পানি সচিব আবদুল বাতেন ভুঁইয়ার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এ ছাড়া কোম্পানির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁরাও ফোন ধরেননি।
এ বিষয়ে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোম্পানিটিকে যে সুবিধা দিয়েছে, তাতে লাভবান হবে একটি গোষ্ঠী। আইনে থাকলেও একটি গোষ্ঠীকে লাভবান করাতে এ ধরনের সুবিধা দেওয়া অন্যায়। আবার যে দামে কয়েক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে নতুন শেয়ার ইস্যুর সুযোগ দেওয়া হয়েছে, বাজারমূল্যের বিবেচনায় সেটিও ঠিক হয়নি। এর মাধ্যমে বিদ্যমান শেয়ারধারীদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে।
আইনে সুযোগ থাকলেও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি হয় এমন কোনো সুযোগ কাউকে দেওয়া নিয়ন্ত্রক সংস্থার কোনোভাবেই উচিত নয় বলে ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী মন্তব্য করেন।